ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি কী? কী তার সমাধান?

ইউক্রেন যুদ্ধ দেড় বছর পার করল। এই দেড় বছরে কার কী লাভ হলো, পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় কতটা জল গড়াল- এসব নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু দুটি বিষয় নিয়ে কেউ সরাসরি কিছু লিখছেন না। এই যুদ্ধের পরিণতি কী? কীভাবে থামানো সম্ভব? এই সমীকরণের সমাধানের ওপর আপাতত অনেকটা নির্ভর করছে পশ্চিম ও সমগ্র বিশ্বের ভবিষ্যৎ। ইতোমধ্যে সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছে রুশ বাহিনীর প্যারামিলিটারির ভেতর থেকে। তা হয়েছে রাশিয়া ও পুতিন প্রশাসনকে থামাতে। সেটি ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো জোট এবং রুশদেশ ও তার মিত্রবাহিনীর কেউই একে অপরকে পুরোদস্তুর পরাস্ত করতে পারছে না। এর বাইরে অন্যরাও এই যুদ্ধের লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাহলে এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কী? 

একটি যুদ্ধের বাস্তবতা এবং তাকে চালিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা মূলত অর্থনীতিনির্ভর। রাজনৈতিক বাস্তবতাও অনেকাংশে তাই। মনোসমীক্ষণবাদী কিছু বাস্তবতা আছে, সেও আর্থ-রাজনৈতিক সমীকরণের বাইরে নয়। তবে যুদ্ধে হঠকারিতাও হয়, গোঁয়ার্তুমির বিষয় থাকে, দাম্ভিকতা ও অহং ইতিহাসে অনেক বড় বড় যুদ্ধের কারণ হয়েছে। মূলত এই সামগ্রিক বাস্তবতার ওপর পর্যালোচনা করে আমরা এই লেখায় ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে একটা ধারণায় পৌঁছব। এই যুদ্ধ আরও কতদিন চলতে পারে, তারও একটা অনুমান আমরা করার চেষ্টা করব। বলে নেওয়া ভালো, আমরা যুদ্ধের কারণ অনুসন্ধানের চেষ্ট করছি না। সে বিষয়ে ইতিপূর্বে বিস্তারিত লেখা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ শুরু হয় এক কারণে, কিন্তু তা সচল থাকে ও প্রলম্বিত হয় নানা কারণে। 

একটি কথা আবারও স্মরণ করছি, রুশ ফেডারেশন তার আগ্রাসনকে ন্যাটোর সম্প্রসারণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বলে আসছে। আবার আলেকসান্দর দুগিনের বই ‘চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্ব’ থেকে আমরা জানতে পারি, ২০০৫ সালে ভূতপূর্ব মার্কিন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা জিগনিউ ব্রেজেনস্কি দুগিনকে নিউইয়র্কে বলেছিলেন যে, ইউরেশিয়া ভূখণ্ডের ওপর রাশিয়ার আধিপত্য বজায় রাখতে হলে, তাকে ক্রিমিয়া ও ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ফলে রুশদেশের ইউক্রেন অভিযানের ছক তো তখনই কাটা হয়ে গিয়েছে। যে কারণে এই যুদ্ধ কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। কিন্তু যুদ্ধের একটা বাস্তবতা হচ্ছে, আপনি যতই পরিকল্পনা করুন, যুদ্ধে এত অধিক ভেরিয়েবল বা চলক কাজ করে যে, আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী সব এগোবে না। নতুন নতুন বাস্তবতা হাজির হতে থাকবে। এমনকি আপনি যদি অনেকগুলো বিকল্পও হাতে রাখেন, নতুন অপ্রত্যাশিত বাস্তবতার কারণে সেগুলোও অনেক সময় কাজে নাও আসতে পারে। ফলে আপনাকে ক্রমাগত পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধে দুই পক্ষের বাস্তবতা হয়তো তাই। আবার যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত লাভালাভের হিসাব-নিকাশের ওপরও যুদ্ধের স্থায়িত্ব বহুলাংশে নির্ভরশীল।

ফলে শুরুতে অর্থনীতির আলোচনায় আসা যাক। ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বা মার্কিন জোটের কি আদৌ লাভ হচ্ছে বা লাভ হলে কী কী লাভ হচ্ছে? রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তৃতীয় বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক দেশ। সে একাই বিশ্বের ১৭% প্রাকৃতিক গ্যাস ও ১২% তেল উৎপাদন করে। এই যুদ্ধের কারণে গ্যাসের উত্তোলন ও সরবরাহ মূল্য বেড়ে যাওয়ার ফলে রাশিয়া তার গ্যাস আন্তর্জাতিক গড় বাজার দরের চেয়ে বেশিতে ব্যাপক পরিমাণে বিক্রি করতে পারছে। কোনো কোনো সূত্র বলছে, রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার ও সোনার রিজার্ভও এই যুদ্ধে বেশ সমৃদ্ধ হয়েছে। 

অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপের অনেক স্লাভিক জাতিগোষ্ঠীর কাছে ভ্লাদিমির পুতিন সাক্ষাৎ এক অবতার। যারা মনে করেন, পশ্চিমা আধিপত্যবাদের কারণে পূর্ব ইউরোপের যে স্লাভিক ঐতিহ্য এবং অর্থোডক্স খ্রিষ্টধর্মের যে সম্ভ্রমহানি হচ্ছে, তার বিমোচনে পুতিন এক মহান অগ্রনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ফলে পুতিনের জন্য এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ও ইউক্রেনকে বাগে আনা এক মনস্তাত্ত্বিক চাপও বটে।

আমেরিকা ও ন্যাটো এবং রাশিয়ার সামরিক বাজেট ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা পুরো দুনিয়ার মোট সামরিক বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি। রাশিয়া পুরনো অস্ত্রশস্ত্রগুলো ব্যবহার করছে সেগুলোর পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে নতুন অস্ত্রের সরবরাহ বাড়াতে। এছাড়া নতুন অস্ত্রের ফিল্ডটেস্টের জন্যও যুদ্ধ প্রয়োজনীয়। একই কথা আমেরিকা ও তার ন্যাটো জোটের জন্যও প্রযোজ্য। এই যুদ্ধে আমেরিকা ব্যাপক অস্ত্র বিক্রি করছে ইউক্রেন সরকারের কাছে। এছাড়া রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিবেশী এবং রাশিয়ার ভয়ে ভীত রাষ্ট্রগুলোও ব্যাপক অস্ত্র ক্রয় করছে আমেরিকার কাছ থেকে। ফলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই যুদ্ধ সহজে শেষ হওয়ার নয়। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে যায়, ধারের ওপর ভর করে ইউক্রেন কত দিন যুদ্ধ চালাবে?

রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বে গম, বার্লিসহ সব ধরনের খাদ্যশস্যের প্রধান জোগানদার। এই যুদ্ধের কারণে এসবের দাম রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে যাওয়াতে খুশি নয় ইইউভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে সমগ্র বিশ্বও। ইউরোপে গ্যাস বিল বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ, আর বিদ্যুৎ বিল বেড়েছে ৭০ শতাংশ। এই বাস্তবতায় আমেরিকা ও ন্যাটো জোটের মনে হবে, ইউক্রেনের জন্য আরও অধিক সামরিক ব্যয় বরাদ্দ হবে বোকামির নামান্তর, নতুন অস্ত্রের জন্য যথেষ্ট ফিল্ড টেস্টও হয়েছে, বরং বিধ্বস্ত ইউক্রেনকে পুনর্গঠন না করতে পারলে সে পশ্চিমের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দেনা শোধ করতে পারবে না। ইতোমধ্যে ৮ মিলিয়নের বেশি শরণার্থী ইউক্রেন থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়েছে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এই সংখ্যা আরও বাড়ুক, তা কেউ চায় না। অন্যদিকে রুশ গ্যাস ও তেলের সহজলভ্য বিকল্পও এখন পর্যন্ত সারাবিশ্বের জন্য নিশ্চিত হয়নি। ফলে দ্রুত যুদ্ধ শেষ হোক এটি দুনিয়ার বেশিরভাগ দেশেরই কাম্য।

অন্যদিকে বিধ্বস্ত ইউক্রেনকে পুনর্গঠন করতে গেলেও আমেরিকা ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর লাভ আছে। ঠিকাদারিগুলো তারা পাবে। সেই সঙ্গে পুনর্গঠন কাজে ব্যবহৃত হবে এমন সব পণ্যের ব্যাপক বাজার তারা বিস্তৃত করতে পারবে। তা না হলে ইতোমধ্যে আমেরিকা ও তার মিত্ররা ইউক্রেন যুদ্ধে যে ১০ বিলিয়নের অধিক ডলার ব্যয় করেছে, তা দেশটি কীভাবে পরিশোধ করবে? যুদ্ধের প্রথমদিকে অক্সফোর্ড ইকোনমিক্সের অ্যাডাম স্ল্যাটার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, এই যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক জিডিপি ০.২ শতাংশ কমবে। কিন্তু পশ্চিমা মাধ্যমগুলোই এখন বলছে যে, বৈশ্বিক জিডিপির হ্রাস আদতে ১ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া দীর্ঘসময়ে যুদ্ধ থেকে ফায়দা না তুলতে পারলে এবং তা তার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ালে, সে ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটাতে চাইবে। মার্কিন সূত্র থেকেই জানা যায়, রাশিয়ার কাছে ২০০০ ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ আছে। পুতিন বেশ কিছু ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র ইতোমধ্যে বেলারুশ সীমান্তে স্থাপন করেছে বলে অনেকের অভিমত। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো বলেছেন যে, তার দেশ কিংবা মিত্রদেশ আক্রান্ত অনুভব করলে, সেগুলো তারা ব্যবহার করতে দ্বিধা করবে না। আর সেগুলোর কোনো কোনোটি ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ব্যবহৃত বোমাদ্বয়ের প্রত্যেকটির চেয়ে তিনগুণ বেশি শক্তিশালী। ফলে ন্যাটো চাইবে না, রাশিয়ার পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাক। কারণ তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। 

কিন্তু ইউক্রেন পুনর্গঠনে আমেরিকা ও ইইউ একাই কাজ করবে- রাশিয়া তা হতে দেবে না, সে তাতে বাদ সাধবে। রাশিয়া তুলবে তার নিরাপত্তার প্রশ্ন। ফলে এই বাজার ধরতে হলে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সন্ধিতে আসতে হবে। পুনর্গঠন কাজ দুই পক্ষের যৌথ প্রচেষ্টাতেই হবে। দুই পক্ষই সেখান থেকে ফায়দা তুলতে চাইবে। আমার ধারণা আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৪-এর মাঝামাঝিতে এই যুদ্ধের একটি নিষ্পত্তি ঘটবে। এখন দেখা যাক, কী হয়।

লেখক: গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //