নতুন ভোটাররা হতে পারে নিয়ামকশক্তি

আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ভোটার তালিকা হালনাগাদ হয়েছে। নতুন তালিকায় মোট ভোটারের সংখ্যা ১০ কোটি ৯৬ লাখ। এর মধ্যে ৭৯ লাখ ৮৩ হাজার নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, যারা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোট দিতে পারবেন।

যোগ হয়েছেন ৩৩৫ জন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার। এই বিপুল সংখ্যক নতুন ভোটার আর তরুণদের হাতেই এখন বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ। এদের দেশপ্রেম, রাজনীতি-সচেতনতাই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের সরকার কেমন হবে, সরকার কাঠামো কেমন হবে। তারা যদি রাজনীতি-সচেতন হন, তা হলে তারাই প্রস্তাব করবেন কেমন বাংলাদেশ তারা দেখতে চান। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এদেশের বেশিরভাগ তরুণের মধ্যে খুব বেশি রাজনীতি-সচেতনতা এখন আর দেখা যায় না। রাজনীতি মানেই যে কোনো নির্দিষ্ট দলের সমর্থন বা লেজুড়বৃত্তি করতে হবে- এমন নয়। রাজনীতি মূলত মানুষের রক্তের স্রোতের মধ্যে প্রবাহমান।

এরিস্টটলের মতে- ‘মানুষ রাজনৈতিক জীব’। অন্য সব জীবের সঙ্গে মানুষের পার্থক্যটাই এখানে। তবে বর্তমান নতুন ভোটারদের বড় অংশ বেড়ে উঠেছে একটি ভিন্নতর সময়ে, ভোগবাদী সংস্কৃতির সঙ্গে। তাদের বড় অংশ তেমন রাজনীতি সচেতনও নয়। বেশিরভাগই দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানে না। তা ছাড়া গত কয়েক বছরের যে রাজনৈতিক বাতাবরণ তাতে রাজনীতিকে ঘৃণা করার যথেষ্ট কারণ এদেশের তরুণদের থাকতে পারে। তারা বড়-ই হয়েছে প্রতিহিংসার রাজনীতি আর হানাহানি দেখে। আবার বড় করার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারসহ নানা পরিসরে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাকে রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ এবং মূর্খ করে রাখা হয়েছে।

অথচ প্রতিটি মানুষের রাজনীতি-সচেতন হওয়া জরুরি। একটা রাজনীতিবিমুখ তরুণ সমাজ কীভাবে তৈরি হয়! তারুণ্য সাহসের প্রতীক; সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো রকম লাভ-লোকসানের হিসাব না করে ঝাঁপিয়ে পড়ার নাম তারুণ্য; কিন্তু কীভাবে যেন দিন দিন এক আত্মমগ্ন, আত্মকেন্দ্রিক তরুণসমাজ গড়ে উঠেছে। ‘আই হেট পলিটিক্স’ প্রজন্ম কি বুঝতে পারে না যে, তাদের এই নির্লিপ্ততার জন্য পদে পদে সে হারছে! ভালোমানুষ হয়ে ঘাড়গুজে সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করে যেতে যেতে প্রাইভেট সেক্টরেও তার চাকরি হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিদেশি কর্মীরা। ব্যবসা করতে গেলে চাঁদাবাজি, সরকারি-বেসরকারি সেক্টরে ঘুষ, মাসোহারা প্রদান ছাড়াও পদে পদে ঘাড়ধাক্কা খেতে হচ্ছে। দেশ থেকে মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে।

তরুণ ভোটারদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি। কারণ এই তরুণ সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে আমাদের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। আগামী দিনের ক্ষমতার চাবি। এই তরুণদের নির্বাচিত নেতৃত্বের ওপর দেশের ভবিষ্যত নির্ভর করছে; কিন্তু একটি সঠিক নেতৃত্ব তখনই নির্বাচন করা সম্ভব হবে, যখন তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। তরুণরা যখন রাজনৈতিকভাবে আরও সচেতন হবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দলগুলো তাদেরকে নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে শুরু করবে। তরুণ সম্প্রদায়ের ভোট পাওয়ার আশায় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইশতেহারে তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য জনবান্ধব ও দেশবান্ধব কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে। ফলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক আমূল পরিবর্তন আসবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে তরুণদের কর্মসংস্থান, নিজের পায়ে দাঁড়াতে বিশেষ ব্যাংক লোন, বেকার ভাতাসহ নানা প্ল্যাটফরমে তরুণদের কাজে লাগানোর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার উল্লেখ থাকবে। বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন প্রয়োজন, তেমনি নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের স্বস্তির জন্য গঠনমূলক পদক্ষেপ নেয়াও একটি সরকারের দায়িত্ব; যাতে এই শ্রেণির জনগণের জীবনমান বজায় থাকে। পাশাপাশি যেসব অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে

মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দেবে; রাজনৈতিক দলগুলোর এমন ইচ্ছা আছে কিনা- এমন বিষয়ে তরুণ ভোটারদের সচেতন থাকতে হবে। মানবসম্পদের উন্নয়ন না হলে অবকাঠামোগুলো মূলত কোনো কাজেই আসবে না। কারণ অবকাঠামোর চালিকাশক্তি হচ্ছে- উন্নত মানবসম্পদ। আর এজন্য জনগণের উচিত তাদের অধিকার সমুন্নত রাখতে রাষ্ট্রকে জবাদিহিতার মধ্যে থাকতে বাধ্য করা আর এটি একটি অনন্ত চলমান প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়া চলমান থাকে রাজনীতি সচেতনতায়, অধিকার আদায়ের সংকল্পে। তাই রাজনীতি-সচেতন না হয়ে মানুষের উপায় থাকে না। 

রাজনৈতিক অসচেতনতার কুফল বর্ণনা করতে গিয়ে প্লেটো বলেছেন, ‘রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করার জন্য একটি দণ্ড হচ্ছে যে, আপনি আপনার চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি দ্বারা শাসিত হবেন’। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যে কোনোভাবে করা যায়। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পরোক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সামিল। একজন মেধাবী তরুণ যখন রাজনৈতিক অসচেতনতার কারণে রাজনীতিবিমুখ হয়ে যাচ্ছেন, তখন একজন কম যোগ্যতাসম্পন্ন তরুণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে চলে আসছেন। আর কম যোগ্যতাসম্পন্ন সেই নীতিনির্ধারক ব্যক্তি খুব স্বাভাবিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল নীতি প্রণয়ন করছেন। ফলে দুর্বল নীতির ভার সইতে হয় সমাজ এবং রাষ্ট্রকে।

আর একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোটাররাই নির্ধারণ করে তারা কেমন সরকার চায়। তাই নাগরিক হিসেবে একটি জনবান্ধব রাষ্ট্র চাইলে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, চিকিৎসাসহ সব মৌলিক অধিকারের যথাযথ প্রয়োগ; গণতান্ত্রিক অধিকার চাইলে সবার আগে তাকে তার ভোটাধিকার নিশ্চিত করাও জরুরি। নতুন ভোটারকে ভাবতে হবে যে-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের নির্দিষ্ট শর্তাবলীর মধ্যে থেকে রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সেখানেই নিহিত রয়েছে নাগরিকের প্রকৃত স্বাচ্ছন্দ্য। 

বাংলাদেশের তরুণদের রয়েছে গৌরবোজ্জল ইতিহাস। বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন, প্রতিটি অর্জনের পেছনে রয়েছে তরুণ সম্প্রদায়ের অবদান, তাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস। তাই সিদ্ধান্ত তরুণ সম্প্রদায়কে নিতে হবে তারা কেমন নেতৃত্ব চায়, আর ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির কোন স্তরে দেখতে চায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //