পাঁচবারের এমপির ঢাকায় বাড়ি নেই কেন?

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘আমি পাঁচবারের এমপি হয়েও ঢাকায় বাড়ি করতে পারিনি। অথচ অনেকে একবার এমপি হয়েই টরেন্টোতে বাড়ি করেন।’ 

গত ১৬ সেপ্টেম্বর লালমনিরহাট রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাব মাঠে জেলা জাতীয় পার্টির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে চুন্নু বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট এবং সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি ঘটনার সমালোচনা করতে গিয়ে এই মন্তব্য করেন। 

চুন্নুর এই সংবাদটি যেদিন গণমাধ্যমে এল, কাকতালীয়ভাবে ওইদিনই বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য, গাইবান্ধার খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ লুৎফর রহমানের মেয়ের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল যে, তার বাবা বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন, গণপরিষদ ও সংবিধান প্রণয়ন কমিটি সদস্য এবং একাধিকবার এমপি হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা শহরে তার একটি বাড়ি তো দূরে থাক, ছোটখাট একটি ফ্ল্যাটও ছিল না। একজন প্রভাবশালী এমপি হয়েও তার সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। 

লুৎফুর রহমানের মেয়ে জেবুন্নাহার শিউলীর ভাষ্য : ‘আব্বা এমপি থাকা অবস্থায়ও আমাদের ঘরে মাসশেষে টানাটানি পড়ে যেত।’ তিনি এবং তার ভাই সাজ্জাদুর রহমান যখন ঢাকায় পড়াশোনা করতে যান, তখন এতটাই কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হন যে, তিনি বাবাকে বলেছিলেন, তোমার ছেলে-মেয়ে কিংবা তোমার নিজের জন্য ঢাকায় একটা থাকার ব্যবস্থা করার কথা কি তোমার মনে হয়নি? লুৎফুর রহমান জবাব দিয়েছিলেন, ‘না মনে হয়নি।’ 

পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে যখন ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি দেওয়া হয়, তখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অনেক নেতা গাইবান্ধায় এসে ডাকবাংলোর পাশাপাশি লুৎফুর রহমানের বাসায় থাকতেন। তখন কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই লুৎফুর রহমানের মতো একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের অতিসাধারণ বাড়িঘর দেখে বিস্মিত হতেন।

অথচ এখন একবার এমপি তো দূরে থাক, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কিংবা ক্ষমতাসীন দলের ছোটখাট পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েও অনেকে বিপুল সম্পদ গড়ে তুলছেন। দেশে তো বটেই, কানাডার মতো দেশেও বাড়ি-গাড়ি করছেন। বিদেশের ব্যাংকে টাকা রাখছেন। অথচ সেই দেশেই মুজিবুল হক চুন্নুর মতো একজন এমপি বললেন যে, পাঁচবার এমপি হয়েও ঢাকা শহরে তার একটি বাড়ি নেই। 

বস্তুত সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ একটি টাকা কামানোর মেশিনে পরিণত হয়েছে। যে এই মেশিন চালাতে পারে, তার টাকার কোনো অভাব নেই; কিন্তু যে চালাতে পারে না বা চালাতে চায় না, তাকে সাধারণ জীবনযাপন করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ এবং একাধিকবারের এমপি হলেও তাকে অতিসাধারণ মানুষের মতোই জীবনযাপন করতে হয়। 

২০২০ সালের মে মাসে বহুজাতিক আর্থিক পরামর্শদানকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স-এর গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্পদশালীর সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে গত দশকে বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতিকে পেছনে ফেলে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে দেশে ধনকুবেরের (৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারী) সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। গবেষণায় দেখা গেছে, গত এক দশকে ধনীর সংখ্যা বেড়েছে-এমন দেশগুলোর মধ্যে ছোট-বড় অর্থনীতির মিশ্রণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেশ রয়েছে এশিয়ায়। প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে ৬টিই এশিয়ার। এই তালিকার শীর্ষে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম। 

প্রশ্ন হলো-এই নব্য ধনীদের কত শতাংশ বৈধ উপায়ে ধনী হয়েছেন আর কত শতাংশ অবৈধ উপায়ে বা জনগণের ট্যাক্সের পয়সা লুটপাট করে? অন্তত দেশের সড়কপথে প্রতিদিন যে পরিমাণ চাঁদাবাজি হয়; অলিগলির ভেতরে যেসব ইজিবাইক ও অটোরিকশা চলে, সেসব বাহনের চালকদের কাছ থেকে; ফুটপাতে চা-সিগারেট বিক্রি করেন যে ক্ষুদ্র দোকানিরা, তাদের কাছ থেকে যে চাঁদা নেওয়া হয়; তার দৈনিক ও মাসিক অংকের পরিমাণ কত? অন্য আরও যেসব খাতে প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজি চলে, চাঁদা না দিয়ে যেসব ব্যবসা করা অসম্ভব, সেগুলো যোগ করলে প্রতিদিন দেশে কী পরিমাণ টাকা শুধু চাঁদা হিসেবে আদায় করা হয়; এই টাকা কার কার পকেটে যায়, কোন কোন খাতে ব্যয় হয়, সেটি বের করা গেলে নিশ্চয়ই গা শিউরে ওঠার মতো অংক বেরিয়ে আসবে। অথচ এসব চাঁদাবাজি বন্ধ করা গেলে নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালে রাখা এবং জীবনযাপন আরেকটু সহজ করা যেত।

ঢাকা শহরে যেসব বিলাসবহুল আবাসিক ভবন গড়ে উঠেছে এবং উঠছে; যেসব ভবনের একেকটি ফ্ল্যাটের দাম দুই থেকে দশ কোটি টাকা, সেসব ফ্ল্যাটের মালিক কারা? নিরপেক্ষ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, তাদের মধ্যে হয়তো বিরাট অংশই সরকারি চাকরিজীবী, বড় বড় ঠিকাদার, রাজনৈতিক নেতা-যারা দলীয় পরিচয় ভাঙিয়ে নানাভাবে চাঁদাবাজি করে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। 

এখন মন্ত্রী-এমপি তো দূরে থাক, অসংখ্য ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানও ঢাকা শহরে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের মালিক। এসব আলিশান বাড়ি ও ফ্ল্যাটের খুব সামান্য সংখ্যক মালিক হয়তো পাওয়া যাবে, যারা পারিবারিকভাবেই ধনি; বড় চাকরি করেন; ব্যবসায়ী কিংবা বিদেশে চাকরি ও ব্যবসার সুবাদে বৈধ পথেই অনেক টাকার মালিক হয়েছেন। 

প্রশ্ন হলো-বাংলাদেশ কীভাবে অবৈধ পথে টাকা উপার্জন করে রাতারাতি ধনী হওয়ার দেশে পরিণত হলো? বাংলাদেশ কেন একটি টাকা কামানোর মেশিনে পরিণত হলো, যে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল কথাই ছিল-সাম্য, অর্থনৈতিক সমতা; কিন্তু সেই অর্থনৈতিক সমতার দেয়ালটি ভেঙে কেন গত অর্ধ শতাব্দী ধরে এখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট হলো? কেন বাংলাদেশ এখন বড়লোকের দেশে পরিণত হলো এবং বাজারে গিয়ে স্বল্প আয়ের একজন মানুষকে অবৈধ পথে কোটি কোটি টাকা কামানো লোকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়? এখানে স্বল্প আয়ের মানুষকে যে প্রতিনিয়ত নিত্যপণ্য কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেটি স্পষ্টত স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চেতনা সাম্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অথচ রাষ্ট্রের কোনো বিকার নেই। বরং রাষ্ট্রের সব নীতি ও পরিকল্পনা ধনীবান্ধব, ব্যবসায়ীবান্ধব। 

উন্নয়ন প্রকল্পের নামে রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাবে; ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে থাকা লোকজন ধনী থেকে আরও ধনী হবে; মধ্যবিত্তরা নিম্নবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্তরা প্রান্তিক হয়ে যাবে, সেটি সুষম উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন হতে হয় সর্বজনীন। উন্নয়ন ১০ শতাংশ লোকের জন্য নয়; কিন্তু অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প এবং তার বরাদ্দের দিকে তাকালে এটি স্পষ্ট হবে যে, এসব প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য কিছু লোককে টাকা কামানোর পথ করে দেওয়া। যে কারণে বিদ্যুৎ খাত প্রসঙ্গে মুজিবুল হক চুন্নু প্রশ্ন তুলেছেন : ‘এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ কী করলেন?’ 

শুধু বিদ্যুৎ খাত নয়, নদী খননের নামে শত শত কোটি টাকা জলে ঢালা; নদীকে খাল ও খালকে ড্রেন বানানো; আঠরোশ কোটি টাকার প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা করা; সরকারি কেনাকাটায় হরিলুট; একশ টাকার জিনিস কিনতে দশ হাজার টাকা; রাস্তা নেই কিন্তু সেতু বানিয়ে ফেলে রাখার মতো অসংখ্য সংবাদ প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। কিন্তু তাতে কারও কোনো বিকার নেই। সবাই যেন দ্রুত সময়ে ধনী হওয়ার পেছনে ছুটছে। রাষ্ট্রও সেই সুযোগ করে দিচ্ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো-সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জনগণকেও এ ব্যাপারে বোঝানো হয়েছে যে, দুর্নীতি না হলে উন্নয়ন হবে না। ফলে এই দুষ্টুচক্র ভাঙা বেশ কঠিন। ফলে অর্থনৈতিকভাবে সৎ থেকে যারা সম্মানজনক জীবনযাপন করতে চান, তাদের জন্য এই সময়ের বাংলাদেশে বসবাস করা আরও বেশি কঠিন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //