ভিসানীতির প্রয়োগ শুরু

বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আমেরিকা তাদের চার মাস আগে ঘোষিত ভিসানীতির প্রয়োগ শুরু করেছে। ভিসানীতির আওতাভুক্তরা হলেন-আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা বাহিনী, ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য।

শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য অতীতে যারা দায়ী ছিল এবং ভবিষ্যতে দায়ী হবেন তাদের ক্ষেত্রেও এই ভিসানীতির প্রয়োগ হতে পারে। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার অর্থ হচ্ছে, ভোট কারচুপির সঙ্গে জড়িত থাকা, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়া এবং মতপ্রকাশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা। জো বাইডেনের আগে যারা প্রেসিডেন্ট ছিলেন তারা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এত মাথা ঘামাননি, ঘামালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাঁ-না ভোট থেকে শুরু করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এত অপকর্ম হতো না। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে কয়েকটি আসালে বিরোধী প্রার্থীকে ভয় দেখিয়ে উইথড্র করতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছিল; সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ১১টি আসালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। 

১৯৭৭ সালে অনুষ্ঠিত হাঁ-না ভোটে জিয়াউর রহমান একাই প্রার্থী ছিলেন, ভোট গ্রহণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসাররা হাঁ ভোটের বাক্স ভরে দিয়েছিল। ভোটকেন্দ্রে ভোটার না গেলেও ৮৮.১% ভোট কাস্ট হয়েছিল এবং ভোট গণনায় দেখা গেল ৯৮.৯% হাঁ এবং ১.১% না-ভোট। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের রিপোর্ট অনুযায়ী, নির্বাচনে কোথাও কোথাও ১১০-১২০ শতাংশ ভোট পড়েছিল। পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিত ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে বিএনপি তাদের কয়েকজন প্রার্থীকে ইচ্ছাকৃতভাবে পরাজিত করে বিরোধী দলকে জিতিয়ে দিয়েছিল। একই নীতি ২০১৮ সালের নির্বাচনে নেওয়া হলে আজ ভিসানীতির প্রয়োগ হতো না। জিয়াউর রহমানের ভোটনীতি অনুসরণ করে রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের গরজ বোধ করেননি; তার আমলেও ভোটারগণ ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি, ভোট প্রদান শুরু হওয়ার এক বা দুই ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় সব ভোট কাস্ট হয়ে যেত। 

জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এরশাদ সাহেবও ১৯৮৫ সালে গণভোট করেন, সেই নির্বাচনে তিনি ৯৪.৫ শতাংশ ভোট পান। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি, ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টি ভোট কারচুপির মাধ্যমে বিজয়ী হয়। ১৯৮৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল বর্জন করায় একতরফা নির্বাচনে জাতীয় পার্টি জয় লাভ করে। ১৯৯১ সালে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ তোলে। ক্ষমতায় এসে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করতে অস্বীকার করে। খালেদা জিয়া বললেন, পাগল আর শিশু ছাড়া আর কেউ নিরপেক্ষ নয়।

১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে রাজনৈতিক দলগুলো সেই নির্বাচন বর্জন করে; ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, কিন্তু আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়ায় বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়। একই বছর জুন মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় এবং বিএনপি স্থূল কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করে। মেয়াদান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হস্তান্তর করলে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়। শুধু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানোসহ বিএনপির প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ ওঠে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর নিজেদের পছন্দমতো প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার অভিপ্রায়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

কে এম হাসান হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের ভায়রা ভাই। তীব্র রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে কে এম হাসান প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করলেও বিএনপির দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে নেন। এভাবে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দলীয় সরকারে পরিণত করে। বিরোধী দলের তীব্র আন্দোলনের মুখে সেনাবাহিনীর সমর্থনে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। তাদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। 

ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধেও বিএনপির অভিযোগ রয়েছে; অর্থাৎ সকল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধেই পরাজিত দলের অভিযোগ ছিল। শুধু পরাজিত বিরোধী দল নয়, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলও কখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে পছন্দ করেনি। অন্যদিকে সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ২০১১ সালে অবৈধ ঘোষণা করে বাতিল করেছে। ফলে পরবর্তী দুটি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। 

২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বিএনপি বর্জন করায় আওয়ামী লীগের অধিকাংশ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির অধিকাংশ প্রার্থীকে নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া এবং দিনের ভোট রাতে হয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনই অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি এবং এর জন্য আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি দায়ী। 

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে বিএনপির নেতাদের আলোচনা, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ শুনলে মনে হয়, আমেরিকা বিএনপির সঙ্গে যুক্তি করে আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সরকারকে শায়েস্তা করতে এই নীতি ঘোষণা করেছে। আবার আওয়ামী লীগের নেতাদের কথা শুনলে মনে হয়, বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বানচাল করার ক্ষেত্রে বিএনপির আন্দোলন ও সংগ্রামের বিরুদ্ধে এই ভিসানীতি। ভিসানীতির ভয়ে বিএনপি নিশ্চয়ই দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে ঘরে বসে থাকবে না। 

বিএনপির আন্দোলনের ছক হচ্ছে রাজপথে অবস্থান নেওয়া, নির্বাচন কমিশন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয় ঘেরাও করা, ঢাকা শহর অবরোধ করা। বিএনপি যদি তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক অগ্রসর হয় তাহলে রাজনৈতিক মাঠ হিংসাত্মক হয়ে উঠবে। আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান সরকার তখন নিশ্চয়ই ভিসা নিষেধাজ্ঞার ভয়ে অ্যাকশন নেওয়া থেকে বিরত থাকবে না। তবে প্রাথমিক অবস্থায় উভয় পক্ষ কিছুটা সংযত আচরণ করতে পারে, কিন্তু নির্বাচনের চূড়ান্ত মুহূর্তে ভিসানীতির কথা কারও মনে থাকবে বলে মনে হয় না। 

প্রকৃতপক্ষে ভিসা নিষেধাজ্ঞার ভয়ে কোনো রাজনৈতিক দলই আতঙ্কিত নয়, কারণ আমেরিকায় যাওয়ার চেয়ে দেশে ক্ষমতা ভোগ করা তাদের কাছে অনেক বেশি লোভনীয়। ভিসানীতির গোপনীয় উদ্দেশ্যও থাকতে পারে; কারণ নিজ স্বার্থে শত্রুকে মিত্র করতে আমেরিকার এক সেকেন্ডও লাগে না। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী যে নরেন্দ্র মোদিকে আমেরিকা ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, সেই মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমেরিকার মাটিতে লাল গালিচার সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দুর্নীতিবাজ, ভয়ঙ্কর ও দুর্ধর্ষ ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করে তাকে ভিসা না দিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি তাদের স্টেট ডিপার্টমেন্টে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন; তারেক রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হলে ঠিকই নরেন্দ্র মোদির মতো আমেরিকা লাল গালিচার সংবর্ধনা দেবে। 

সৌদি আরব, জর্ডান প্রভৃতি দেশে তো নির্বাচনই নেই, অথচ ওই সকল দেশের ওপর আমেরিকার কোনো ভিসানীতি নেই। প্রকৃতপক্ষে ভিসানীতি হচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় আমেরিকার অবস্থান এবং নিরাপত্তা জোরদার করা। আমেরিকার এই গোপনীয় নীতিতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং ইউরোপ সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। এই চাপ তখনই রিলিজ হবে যখন বাংলাদেশ উক্ত দুটি ক্ষেত্রে আমেরিকার পক্ষে যাবে। দেশে অস্থির রাজনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, তাই যে কোনো চাপ বা সমঝোতায় নির্বাচনটা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হোক-এই প্রত্যাশা সবার।

লেখক- সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //