তথ্য অধিকার চর্চায় ৪টি ‘ক’

২০০৯ সালে বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইনটি পাস হওয়ার পর থেকেই দেশের আগ্রহী নাগরিকরা যার যার প্রয়োজন অনুযায়ী তথ্যের জন্য আবেদন করছেন, উত্তর পাচ্ছেন, উত্তর পেয়ে কাঙ্ক্ষিত সমস্যা মোকাবিলা বা চাহিদা পূরণে উদ্যোগ নিচ্ছেন। তথ্য পেয়ে অনেকে উপকৃত হচ্ছেন ব্যক্তিগতভাবে, আবার কোনো কোনো তথ্য সামাজিকভাবে, এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবেও উপকারে আসছে। আবেদন করে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না বরং সঙ্কট তৈরি হচ্ছে, সংখ্যায় কম হলেও সে বিষয়টিও যুগপৎ চলমান। তথ্যের আদান-প্রদান থেকে যে সংস্কৃতি চালু হতে পারে, তা নিশ্চয়ই সার্বিক অর্থে দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে; সরকার ও সরকারের সেবা প্রদানকারী দপ্তরসমূহের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব হ্রাস পাবে এবং পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূরীভূত হবে। অর্থাৎ তথ্যের অবাধ প্রবাহ গোটা দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ বদলে দিতে পারে, তথ্যের ক্ষমতা এতই। 

অবশ্য তথ্যকে যদি সত্যি সত্যিই আমরা ক্ষমতাবান বা শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তাহলে তথ্য অধিকারের চর্চায় আমাদের আরও মনোযোগী হতে হবে। তথ্যপ্রাপ্তির গোটা প্রক্রিয়ায় যে তিনটি পক্ষ রয়েছে- ১. আবেদনকারী বা তথ্যপ্রার্থী, ২. তথ্য সরবরাহকারী এবং ৩. মীমাংসাকারী কর্তৃপক্ষ বা তথ্য কমিশন, তাদের প্রত্যেককেই, বিশেষত প্রথম পক্ষকে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে। তথ্য অধিকার আইনের মূল কপিটি যত্নসহকারে পাঠ করতে হবে, যেখানে আইনটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে মুখবন্ধ অংশে এ বিষয়ে খুবই কার্যকরী কথার উল্লেখ রয়েছে। 

আমি মনে করি, তথ্য অধিকার আইনের ব্যবহারে সংশ্লিষ্ট সকলকে ৪টি ‘ক’ সম্পর্কে সচেতন হওযা প্রয়োজন। ‘ক’ গুলো হচ্ছে : কী, কেন, কোথায় ও কীভাবে। একটু আলোচনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে। 

কী তথ্য
যে তথ্যটি চাওয়া হবে, তাকে সুনির্দিষ্ট করতে হবে, যাতে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা যে কেউ এটি পড়ে নির্দ্বিধায় বুঝতে পারেন। যেমন- তথ্য আবেদনে লেখা হলো : আমতৈল ইউনিয়নে যারা ভাতা পায়, তাদের সংখ্যা জানতে চাই। এটি পড়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তো দূরের কথা, কোনো বিশেষজ্ঞের পক্ষেও এর মর্মার্থ বুঝে ওঠা দুরূহ। সরকারের প্রায় অর্ধশত প্রকারের ভাতার ব্যবস্থার মধ্যে কোনটির জন্য তথ্য চাওয়া হয়েছে, কোন সময়ের জন্য চাওয়া হয়েছে, তালিকা না চেয়ে সংখ্যা চাওয়া হলো কেন ইত্যাকার নানাবিধ বিভ্রান্তি থেকে যায়। চাহিত তথ্যটি হতে পারে এরকম: “মৌলভীবাজার জেলার সদর উৃপজেলার ৯নং আমতৈল ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা প্রদানের জন্য যাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ ঠিকানাসহ সে তালিকাটি পেতে চাই।” আবেদনপত্রের অন্য কলামগুলোও নির্ভুলভাবে উপস্থাপন করতে হবে। 

কেন তথ্য
তথ্যটি কোন বিশেষ প্রয়োজনে চাওয়া হচ্ছে, অর্থাৎ, তথ্যটি ব্যক্তি, এলাকা বা সমাজের কী কাজে লাগবে সে সম্পর্কে তথ্যপ্রার্থীর সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। চাহিত তথ্য যদি কোনো কাজেই না আসে তাহলে শুধু শুধু একজন কর্মকর্তাকে বিরক্ত না করাই শ্রেয়। তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অবশ্যই একজন তথ্যপ্রার্থীকে ‘তথ্যটি কেন চাওয়া হলো, তথ্যটি চাওয়ার জন্য কে আপনাকে বলেছে, তথ্যটি পেয়ে কী করবেন,’ এমনতর কোনো প্রশ্ন করতে পারেন না। তথ্যপ্রার্থীর সঙ্গে তথ্যদাতার সম্পর্ক হবে কাগজ-কলমের। তথ্য আবেদন পেয়ে একজন কর্মকর্তার মনে যেন এ প্রেরণা আসে যে, তিনি তথ্যটি প্রদান করাকে নিজের কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করবেন। কারণ জনগণকে সেবা প্রদানের অঙ্গীকার নিয়েই তিনি কর্মচারী বা কর্মকর্তা পদে আসীন হয়েছেন। 

কোথায় তথ্য
তথ্য অধিকার আইনের আওতা বিশাল; রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও ক্ষেত্রবিশেষে গোপনীয়তা সংক্রান্ত অল্প কতিপয় দপ্তর ব্যতীত প্রায় সকল সরকারি দপ্তর এই আইনের অধীনে তথ্য প্রদানে বাধ্য। এমন কিছু তথ্য রয়েছে, যেগুলো অনেক সময় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, কারণ দপ্তরগুলোর বেশ কিছু কার্যক্রম অনেকটা বাছাকাছি। যেমন- বন ও পরিবেশ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, পাট ও বস্ত্র, শিল্প ও বাণিজ্য, মৎস্য ও প্রাণী, খাদ্য ও কৃষি প্রভৃতি। 

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পরিবেশ সুরক্ষায় বৃক্ষ রোপণের কর্মসূচি নিয়ে কোনো তথ্য জানতে হলে প্রকৃতপক্ষে কোন দপ্তরে (বন নাকি পরিবেশ) আবেদন করতে হবে, তা জেনে নিতে হবে, যা নির্ভর করে চাহিত তথ্যের প্রকৃতির ওপর। ঢাকা মহানগরীর কোনো তথ্য জানতে হলে তা সিটি কর্পোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নাকি অন্য কেনো দপ্তরে আবেদন করতে হবে, তা তথ্যপ্রার্থীকে প্রায়শই ধাঁধায় ফেলে দেয়। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে আবার উত্তর- দক্ষিণ ভাগাভাগির বিষয় রয়েছে। 

অপর বিষয়টি হলো, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জন করা। যেমন- ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হচ্ছেন সচিব; সেস্থলে চেয়ারম্যান, মেম্বার বা অন্য কারও বরাবরে তথ্য আবেদন পাঠালে তা হবে একটি নিষ্ফল কাজ। 

কীভাবে তথ্য
প্রাথমিকভাবে আবেদনের প্রস্তুতি ও জমাদান থেকে শুরু করে তথ্যপ্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তি পর্যন্ত বেশ কিছু ধাপ রয়েছে। বলতে গেলে, তথ্য আবেদনের গোটা প্রক্রিয়াই এতে চলে আসে। তথ্য অধিকারের চর্চায় যে কোনো নাগরিকের এগুলো জানা থাকতে হবে। তথ্য অধিকার আইনের ধারাসমূহে এগুলো সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। 

আমার একটি অনুমান ও প্রস্তাবনা এখানে যোগ করতে চাই, যাতে করে তথ্য অধিকার আইনের চর্চায় পরিদৃষ্ট সমস্যা বা চ্যালেঞ্জগুলো কমে আসতে পারে। আমাদের দেশে তথ্য অধিকারের চর্চায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন নানা নামে-উপনামে পরিচিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজন। আর আবেদনের খাতসমূহের প্রধান অংশ জুড়ে রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ কতিপয় স্থানীয় জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় তথা রাস্তাঘাট, কৃষি, বিদ্যুৎ, নিরাপদ পানি, উপাসনালয়, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাকেন্দ্র (মেরামত বা নির্মাণ) প্রভৃতি। এই শ্রেণির আবেদনকারীদের একটি বড় অংশ কোনো না কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার মাধ্যমে অনুপ্রাণিত বা উদ্বুদ্ধ হয়ে তথ্য আবেদন করে থাকেন। তথ্য পেলে ভালো, না পেলেও ক্ষতি নেই- এমন একটি ভাব তাদের বেশির ভাগের মধ্যে দেখা যায়। এক্ষেত্রে আমার প্রস্তাবনা হচ্ছে, দেশের পেশাজীবী লোকজনের এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। সাংবাদিক, আইনজীবী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, ছাত্র- এসব পরিচয়ধারী লোকজন যখন তথ্য অধিকারের চর্চায় এগিয়ে আসবেন, তখনই তথ্যের দুয়ার অধিকতর অর্গলমুক্ত হবে; ছোট-বড় প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত হবে; আর চিহ্নিত হলে তা দূর করার প্রয়াসও তৈরি হবে। আমরা যারা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে দিয়ে তথ্য আবেদন করাই বা তথ্য আবেদনের জন্য উৎসাহিত করি, তাদের নিজেদের অনেকেই তথ্য আবেদন খুব একটা করি না। তথ্য অধিকার আইনের মতো একটি জনবান্ধব আইনকে সফল করে তুলতে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ভাবার দাবি রাখে।

লেখক: গবেষক, মানবাধিকারকর্মী

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //