ছিনতাই হলো গরিবের ইলিশ

ইলিশ মাছ কেনা এখন মধ্যবিত্তের জন্য কষ্টকর আর গরিব মানুষের জন্য অসম্ভব হয়ে গেছে। এই কথাটি শত শতবার পত্র-পত্রিকায় লেখা হচ্ছে। কেন লেখা হচ্ছে? কারণ ইলিশ মাছ পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগেও গরিবের অবলম্বন ছিল। সে সময়কার গরিব মানুষ গরু-খাসির মাংস কিনতে পারত না। তাদের অবলম্বন ছিল ইলিশ আর চুনোপুঁটি। সেই সহজলভ্য সস্তা ইলিশ এখন ধনীদের বিলাস সামগ্রী। মধ্যবিত্তের ঐতিহ্য এখন বিলাস! কেন এমন হলো? অর্থনীতির সূত্রানুযায়ী পণ্যের উৎপাদন কমলে মূল্য বাড়ে। আবার পণ্যের অতি ব্যবহারেও মূল্য বাড়ে। অর্থাৎ চাহিদা অনুপাতে দাম বৃদ্ধি ঘটে। 

ইলিশের ক্ষেত্রে সেসব কিছু হয়নি। বরং পঁচিশ বছর আগের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে। তারপরও ইলিশের দাম নাগালের বাইরে। মতলববাজরা এর পেছনে ব্যাখ্যা হাজির করে- এক. ইলিশের ব্যবহারের বহুমুখিনতা বেড়েছে। দুই. ইলিশ কম আমদানি হচ্ছে। তিন. ভারত এবং ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানি হচ্ছে। এর সঙ্গে মিডিয়ার কেউ কেউ ব্যাখ্যা দেয়- চার.ইলিশের দাম আগেও বেশিই ছিল।

এই চারটি ব্যাখ্যাই স্রেফ গোঁজামিল। দাম বাড়ার মূল কারণকে আড়াল করার চেষ্টা।

বছরে তিন বার ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। বিশেষ করে অক্টোবর-নভেম্বরে। মা ইলিশ এবং জাটকা রক্ষার জন্য এই নিষেধাজ্ঞা থাকায় ইলিশের উৎপাদন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। একটি ইলিশ একবারে গড়ে দশ থেকে বারো লক্ষ ডিম ছাড়ে। সে অনুপাতে ইলিশের উৎপাদন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। এবার নম্বর ধরে খণ্ড করা যাক।

(এক) মোটেও ইলিশের বহুমুখিনতা বা ব্যবহার বাড়েনি। বরং ইলিশ বিশেষ কিছু মানুষ ছাড়া বাকিদের কেনার সামর্থ্য নেই। (দুই) ইলিশের আমদানিও এতটুকু কমেনি। বরং গত কয়েক বছরের তুলনায় উৎপাদন ৩০% বেড়েছে। (তিন) ভারতে কত টন ইলিশ যাচ্ছে? দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ৩ হাজার ৯৫০ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ ভারতে যাওয়ার পরও বাজারে ইলিশের সামান্যতম ঘাটতি নেই। সেটা প্রত্যেকটা বাজারে গেলেই বোঝা যাবে। (চার) ইলিশের দাম আগেও বেশি ছিল বলেছে যেসব মিডিয়া, তাদের ইতিহাস বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান নেই।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে ভারতের বাজারে কীভাবে সাড়ে ৩শ থেকে ৪শ টাকায় ইলিশ বিক্রি করছে? বাংলাদেশের বাজারে কেন বাচ্চা ইলিশ ৫শ থেকে ১২শ, আর মাঝারি বা বড় ইলিশ ১২শ থেকে ২ হাজার টাকা। কারণ- বাজার সিন্ডিকেটের চালবাজি। যে দেশে সামান্য ডিমের ব্যাপারিরা সরকারকে জিম্মি করে দাম বাড়িয়ে এক সপ্তাহেই কয়েক হাজার কোটি কামিয়ে নেয়, সে দেশে ইলিশের মতো একটা ঐতিহ্যবাহী মাছকে টার্গেট করবে জানা কথা। অনেক আগে থেকেই ইলিশকে দুষ্প্রাপ্য করে ফেলা হয়েছিল। এই সরকারের আমলে সিন্ডিকেট জামাই আদর পেয়ে মাথায় চড়ে বসেছে। তারা নানা পণ্যের কৃত্রিম সংকট ঘটিয়ে হাজার কোটি টাকা বাগিয়ে নিচ্ছে।

ইলিশ প্রসঙ্গে সরকারের কথা আসছে, কারণ গত এক বছর ধরে আগামী নির্বাচন নিয়ে এতটাই ব্যতিব্যস্ত যে তাদের এসব দিকে তাকানোর ফুরসত নেই। কে কোথায় সিন্ডিকেট করে কোনো পণ্য থেকে কত হাজার কোটি হাতিয়ে নিল অত সূক্ষ্ম বিষয়ে ভাবার টাইম নেই সরকারের। 

মাছের মধ্যে ইলিশই দীর্ঘদিন কোল্ডস্টোরেজে সংরক্ষণ করা যায়। বাজার সিন্ডিকেট মোকাম থেকে তিন-চারশ টাকা দরে ইলিশ কিনে কোল্ডস্টোরেজে জমা করে। তারপর সারা বছর অল্প অল্প করে বাজারে ছেড়ে চড়া দামে বিক্রি করে। কাঁচাবাজারে খুচরো ব্যাপারিরাও বরফ দিয়ে প্রায় সাত-আট দিন ইলিশ বিক্রয়যোগ্য রাখতে পারে। এখন বাম্পার উৎপাদন হলেও বাজার সয়লাব হয়ে স্বাভাবিক নিয়মে বাজারে ইলিশের জোগান অতিরিক্ত হতে দেয় না। তাহলে দাম কমবে কীভাবে? কমছে না। কমবেও না। আজকে যদি এক ছটাক ইলিশও রপ্তানি না হয় তার পরও বাজারে ইলিশের দাম কমবে না।

আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে কোল্ডস্টোরেজে শুধু আলু রাখা হতো। যখন থেকে ইলিশ রাখার কায়দা শিখেছে, তখন থেকেই ইলিশ বাজার সিন্ডিকেটের অস্ত্র হয়ে উঠেছে। ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও ভরা মৌসুমে বাজারে তো বটেই, রাস্তাঘাটে, অলিতে-গলিতে ইলিশ নিয়ে খুচরো ব্যবসায়ীরা বিক্রি করত। সে সময় জোগান বেড়ে গেলে দাম কমে যেত। সারা বছর না পারলেও ভরা মৌসুমে গরিব মানুষও ইলিশ কিনতে পারত।

বিশ্বে যত ইলিশ ধরা পড়ে তার ৭০ ভাগই বাংলাদেশে। বাকি ৩০ ভাগ ইলিশ উৎপাদন করে মিয়ানমার ও ভারত। এই হিসাবে ভারত কিংবা মিয়ানমারে ৩০% উৎপাদন হওয়ার পর দাম সাধারণের নাগালে থাকলেও ৭০% উৎপাদনের দেশ বাংলাদেশে থাকে না। এর পেছনে কে সেটা বুঝতে রকেট সায়েন্স লাগে না। 

আগেই বলা হয়েছে কেন সরকার বাজার সিন্ডিকেটকে চটায় না। তাই কেন বাঙালির পাত থেকে ইলিশ হাওয়া হয়ে গেছে তা নিয়ে হাপিত্যেশ করে লাভ নেই। যত দিন বাজার সিন্ডিকেটের ক্ষমতা থাকবে তত দিন ইলিশসহ অন্যান্য সকল পণ্যের দাম গরিব মানুষের নাগালের বাইরেই থাকবে। আড়তদারের দাদন, জালের সুতোর দাম বেশি, নৌকার তেলের চড়া দাম, বছরের তিন-সাড়ে তিন মাস মাছ ধরা নিষেধ, এসব ঠুঁটো যুক্তি। মূল কথা ওই বাজার সিন্ডিকেট, যাদের মাথার ওপর সরকারের প্রশ্রয়ের হাত। প্রতিকার হিসেবে তপ্ত ঘিলুর বিশেষজ্ঞরা এটা-ওটা নানান উপায় বয়ান করে, কিন্তু কেউই মূল জায়গা সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার কথা বলে না। অর্থাৎ সব একজোট।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //