নির্বাচন নিয়ে কি অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের চাপ বর্তমান কমিশনের ওপর পড়েছে। তবে আমরা চ্যালেঞ্জ নিতে চাই, আমাদের অধীনে আগামীতে যে নির্বাচন হবে, সেটা অবাধ-নিরপেক্ষ-শান্তিপূর্ণ হবে।’

জাতীয় সংসদ নির্বাচন বরাবরই চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কেননা নির্বাচনটি কেমন হবে তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, কোন সরকারের অধীনে ভোট হবে?

মাঠের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও তার শরিকরা এখনো বিদ্যমান, অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়ে অনড়। যদি তা-ই হয় তাহলে কি তাদেরকে ছাড়াই নির্বাচন হবে? বিএনপি ও তার শরিকদের ছাড়া নির্বাচনটি যদি অংশগ্রহণমূলক না হয়, তাহলে সেটি গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না এবং তার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসা নীতির ভয় দেখিয়ে রেখেছে, সেটি আরও প্রবল হবে কি না? দেশের অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে? আর সরকার ও ক্ষমতাসীন দল যদি এসব পাত্তা না দেয়, তাহলেই বা কী হবে, এসব নিয়েও প্রশ্নের অন্ত নেই। বলা হচ্ছে চলতি মাসের মধ্যেই অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে অথবা মোটামুটি একটা আন্দাজ করা যাবে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কী হবে। আসলেই কি তা-ই? অক্টোবরেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে?

সিইসি বলছেন, তারা অবাধ-নিরপেক্ষ-শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু নির্বাচন যে শুধু অবাধ-নিরপেক্ষ-শান্তিপূর্ণ হওয়াটাই যথেষ্ট নয়, বরং অংশগ্রহণমূলক (অন্তত প্রধান দলগুলোর অংশগ্রহণ) এবং দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হতে হয়, সেটিও বিবেচনায় রাখা দরকার। বিদ্যমান দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ইসি কতটা নিরপেক্ষ থাকতে পারে, অতীতের নির্বাচনগুলোয় সে প্রশ্নের উত্তর আছে। যে কারণে আগামী নির্বাচনের মূল তর্কটা ঘুরপাক খাচ্ছে এই ইস্যুতেই।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, সরকারের পদত্যাগের এক দফার আন্দোলনে অক্টোবরেই একটা চূড়ান্ত দফারফায় পৌঁছতে চায় বিএনপি। সেই লক্ষ্য থেকে দলটি ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ, ঘেরাও ও অবরোধের মতো কর্মসূচি চিন্তায় রেখেছে। আর সরকার ও আওয়ামী লীগ যে কোনো মূল্যে যথাসময়ে নির্বাচন করার অবস্থানে থেকে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক শক্তি নিয়ে মাঠে থাকার পরিকল্পনা নিয়েছে। অর্থাৎ কোনো পক্ষ থেকেই ছাড় দেওয়ার কোনো ইঙ্গিত নেই; বরং অক্টোবর মাসেই রাজধানীর রাজপথ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চিন্তা থেকে কর্মসূচি সাজাচ্ছে বিএনপি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক চাপ থাকলেও আওয়ামী লীগ ঢাকার মাঠের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পাল্টা কৌশল ঠিক করার কথা বলছে। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি হুমকিতে অক্টোবরে রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে, এমন শঙ্কা দেখা দিয়েছে মানুষের মধ্যে। (প্রথম আলো, ১ অক্টোবর ২০২৩)।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করা হয়, যেখানে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না দেশটি। এর প্রায় চার মাস পর ২২ সেপ্টেম্বর ওই ভিসা নীতি কার্যকরের পদক্ষেপ নেওয়া শুরুর কথা জানায় যুক্তরাষ্ট্র। দৃশ্যত মনে হচ্ছে, বিএনপি তাদের চূড়ান্ত আন্দোলনে এই সুযোগটি কাজে লাগাতে চাইছে। অর্থাৎ তারা ভাবছে বা ধরেই নিচ্ছে যে, মার্কিন ভিসা নীতি সরকার ও সরকারি দলের বিপক্ষে যাবে। যদিও সরকারি দলের সিনিয়র নেতারা বলছেন যে, তারা এই ভিসা নীতির পরোয়া করেন না। এমনকি এই ইস্যুতে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে কেউ কেউ বাংলাদেশ থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ‘বহিষ্কার’ করারও দাবি জানিয়েছেন। তার মানে ভারতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেলফি ইস্যুতে সম্পর্কের বরফ কিছুটা গলেছে বলে মনে হলেও বাস্তবতা হলো, শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীনই ভিসা নীতি কার্যকরের কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি তাদের তরফে একটি সুস্পষ্ট সিগন্যাল যে, তারা আগামী নির্বাচনটি যেভাবে দেখতে চায় (তাদের ভাষায়), তার ব্যত্যয় হলে তারা আরও বড় ধরনের পদক্ষেপ নেবে।

এখন প্রশ্ন হলো, সেই পদক্ষেপ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য কতটা বিপজ্জনক হবে? বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর কী ধরনের অভিঘাত তৈরি করবে? পক্ষান্তরে বাংলাদেশ সরকার যদি যুক্তরাষ্ট্রের ওইসব পদক্ষেপ পাত্তা না দেয়, পরোয়া না করে, তাতেই বা কী হবে? এখন পৃথিবীর ক্ষমতা এককভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেই। এখানে ক্ষমতার মেরুকরণ ও রসায়ন বদলে গেছে। বিশেষত এই ভূখণ্ডে চীন, ভারত এমনকি রাশিয়াও বড় ‘ফ্যাক্টর’। অতএব ‘ক’য়ের সঙ্গে ‘খ’য়ের বন্ধুত্ব না হলেও তার বিকল্প ‘গ’ ও ‘ঘ’ আছে। আবার কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি চিরকাল একই ধারায় প্রবাহিত হয় না। মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। ফলে সঠিক সময়ে অনুষ্ঠিত হলেও আগামী জাতীয় নির্বাচনের যেহেতু এখনো তিন মাসের মতো বাকি, অতএব এর মধ্যে আরও কত কী ঘটবে কিংবা ভেতরে ভেতরে কী কী ঘটছে, তা এখনই বলা মুশকিল। তবে সরকার যে কোনো বৈশ্বিক চাপ পাত্তা না দিয়ে যে কোনো মূল্যে জানুয়ারিতে নির্বাচন করে ফেলার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তারা যে ‘হার্ডলাইনে’ আছে, সেটি সাম্প্রতিক নানা ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা এবং ঢাকা-১ আসনের সংসদ সদস্য সালমান এফ রহমান একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হবে। পৃথিবীর এমন কোনো শক্তি নেই যে তা ঠেকাতে পারে। বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি আসবে না সেটা তাদের ব্যাপার। দেশে নির্বাচন সময়মতো হয়ে যাবে। (আজকের পত্রিকা, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩)। এরপর দুদিন পর পয়লা অক্টোবর বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইয়োমা কিমিনোরির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী সরকার দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ সংবিধান অনুযায়ী মানে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে এবং বর্তমান সরকারের অধীনেই । 

আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি, টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকায় প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রে তাদের শক্ত ভিত্তি তৈরি হয়েছে। যারা এই দীর্ঘমেয়াদে নানাভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত, তারা সেই সুবিধা অব্যাহত রাখা তথা সরকার পরিবর্তন হলে বিপদের শঙ্কা মাথায় রেখে কোনোভাবেই চাইবেন না সরকারের পরিবর্তন হোক। উপরন্তু ব্যবসায়ীদের তরফেও এই প্রত্যাশার কথা জানানো হয়েছে। তাছাড়া দেশের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন; নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তুষ্টি যতই থাকুক না কেন, গত ১৫ বছরে দেশে যে দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে সেটিও অস্বীকার করার উপায় নেই। আওয়ামী লীগ একটি বিরাট দল। তার নিজেরই ভোট ব্যাংক আছে। তার সঙ্গে যুক্ত হবে গত তিন মেয়াদে সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী। সুতরাং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই যে আওয়ামী লীগ লজ্জাজনকভাবে হেরে যাবে, অঙ্কটা এত সরল নয়। কিন্তু তারপরও সরকার নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে চায় না। কারণ এটি তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। উপরন্তু যে পদ্ধতিতে তারা সংবিধান সংশোধন করে বাতিল করেছে, বিরোধীদের আন্দোলন ও চাপের মুখে সেই বিধান ফিরিয়ে আনা মানে ভোটের আগেই বিরোধীদের কাছে আত্মসমর্পণ। বলা হয়, আন্দোলনের মাঠ যার দখলে থাকে, আন্দোলনে যে জয়ী হয়, ভোটের ফলও তার ঘরে যায়। সুতরাং বিএনপি ও তার শরিকদের প্রধান দাবিই হলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। আর সরকার বা ক্ষমতাসীন দল যদি এই দাবিটিই মেনে নেয়, তাহলে ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের বিজয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসবে। অতএব তারা যে কোনোভাবেই এই দাবি মেনে নেবে না, সেটি স্পষ্ট।

এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি বিদ্যমান ব্যবস্থায় অর্থাৎ আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যাবে নাকি প্রতিহত করার চেষ্টা করবে? নির্বাচন প্রতিহত করার মতো সাংগঠনিক শক্তি কি তাদের আছে? থাকলেও তারা সেই শক্তি কি দেখাতে পারবে যেখানে পুরো প্রশাসনযন্ত্র সরকারের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে? তাহলে কি শেষমেশ সরকারি দল, সরকারি বাহিনী এবং বিরোধী পক্ষ মুখোমুখি দাঁড়াবে? বড় ধরনের সংঘাতের দিকে দেশ এগোবে? সেই পরিস্থিতি তৈরি হলে কি সরকার ও বিরোধী কোনো পক্ষেরই লাভ হবে? আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মূল সংশয় এখানেই। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনরা যে কোনো মূল্যে জানুয়ারিতে নির্বাচন করতে চায়, আর তাদের বিরোধী পক্ষ চায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোট।

তবে রাজনীতির মাঠে এরকম গুঞ্জনও আছে যে, বিএনপি আসলে জানুয়ারিতে নির্দলীয় সরকারের অধীনেও নির্বাচন চায় না। কেননা তারা মনে করছে, দেশের যে অর্থনৈতিক অবস্থা, তাতে এই মুহূর্তে তারা যদি সরকার গঠনের সুযোগও পায়, তাহলে সেই পরিস্থিতি তারা মোকাবিলা করতে পারবে না। সেজন্য তারা হয়তো চায় এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হোক যাতে আগামী জানুয়ারিতে নির্বাচন না হয় এবং আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় না থাকে। এটি মনে করারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার ব্যাপারটা ‘আমেরিকার গ্রিন সিগন্যালের’ ওপরই নির্ভর করবে। তবে এসবই রাজনৈতিক গুঞ্জন। বস্তুত কী হবে তার অনেক কিছুই নির্ভর করছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের ওপর। যতদূর জানা যাচ্ছে, তার অবস্থা খুব ভালো নয়। অতএব আগামী দিনের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি অনেক কিছুর ওপরই নির্ভর করবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //