শিশু লালিত হোক অখণ্ড মানবিকতায়

গত বছর আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস উপলক্ষে আমার কন্যার মঙ্গল কামনা করে মুখপঞ্জিতে বাবা-মেয়ের ছবি সংযোজন করেছিলাম। অনেক মন্তব্যের মধ্যে সুহৃদ কল্যাণ বর্মণের মন্তব্যটির দিকে বারবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। তিনি লিখেছেন, ‘মামণির জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা, তবে কন্যাশিশু হিসেবে নয়, সে শুধুই সন্তান। সকল সন্তানের জন্যই শুভ কামনা।’ দৃষ্টিভঙ্গির এই যে বিষয়, একজন সাধারণ মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমার কাছে তা অজানা ছিল না বটে, কিন্তু মন্তব্যটি পাঠ করে যেন ভাবনার এক নতুন উপাদান পেয়ে গেলাম। সত্যিই তো, যখন সন্তানকে ছেলে বা মেয়ে হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, অবচেতনভাবেই একটি প্রভেদসূচক শ্রেণিচরিত্র অঙ্কিত হয়ে যায়। আর যদি মানসমূলে কোনো বৈষয়িক প্রপঞ্চের আবির্ভাব ঘটে, তাহলে তো কথাই নেই। 

নারীকে বলা হয় অচলা, অবলা, অবরোধবাসিনী; মোটা দাগে তার পেশাকে বলা হচ্ছে গৃহিণী। নারীর প্রজ্ঞা ও মেধাকে এভাবেই দেশ-দশের কাজে না লাগিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। নারী তো নারীই, গরিব তো গরিবই- কথা মিথ্যে নয়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে তখনই যখন মানুষের আসল পরিচয়কে পাশ কাটিয়ে কতিপয় কৃত্রিম বিষয়কে আসল করে তোলার চেষ্টা করা হয়। নারী, শিশু, গরিব, ক্ষুদ্র জাতি ইত্যাকার পরিচয়ের কারণে প্রায়শই কিছু কাজের জন্য তাদেরকে বাধ্য করা হয়, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। 

মানবাধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নানা আন্দোলন- সংগ্রামের মধ্যে নারী ও কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলন এই দুটি ইস্যু যুগ-কাল অতিক্রম করেছে। প্রতীচ্যের দেশে দেশে নানা সময়ে দমন-পীড়নের শিকার হয়ে কৃষ্ণাঙ্গরা ফুঁসে ওঠে; আন্দোলন প্রশমনে শাসকদের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কিছু অঙ্গীকার আসে, বাস্তবায়িত হোক বা না হোক। নারী আন্দোলনের ফলাফলও অনেকটা এরকমই। উভয় ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আইন প্রণয়নসহ সভা ও চুক্তিরও কমতি নেই। কিন্তু কাজের কাজ কতটুকুই বা হয়েছে? 

মানব সমাজের দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতির জন্য আসলে মানবতা প্রত্যয়টির যথাযথ মূল্যায়নের অনুপস্থিতিই মুখ্যত দায়ী। তাই যদি কেউ সমাজের উপকার করতে চান, তাহলে সর্বাগ্রে সমশ্রেণিভুক্ত সকলকে ঠিক নিজের মতোই মানুষ মনে করা, আদর্শিক বা দৃষ্টিভঙ্গিগত চেতনা কিংবা শারীরতাত্ত্বিক পরিচিতি যা-ই থাকুক। 

একটি ঘটনার উল্লেখ করলে বোধ হয় বিষয়টি একটু স্পষ্ট হতে পারে। মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে নিয়ে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থের (সম্পাদক সরদার ফজলুল করিম ও রংগলাল সেন, প্রকাশক বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৬) একটি আলোচনা প্রণয়ন করে তা পরিমার্জন বা সংশোধনের জন্য তার একমাত্র সন্তান ড. মেঘনা গুহঠাকুরতার শরণাপন্ন হই। 

লেখার ভূমিকাংশে ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার বুলেটবিদ্ধ হওয়া ও মৃত্যু প্রসঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীকে আমি ‘নরপিশাচ’ অভিধা দিয়েছিলাম। ড. মেঘনা তা মানলেন না; বললেন, ‘তুমি কোন অধিকারে একদল মানুষকে পিশাচ বলছ?’ আমি বললাম, ‘এরা তো পিশাচই।’ তিনি বললেন, ‘না- তারা অবশ্যই মানুষ, হতে পারে তারা মানবিক গুণাবলি অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে বা পিছিয়ে পড়ে আছে, তার বেশি কিছু নয়, মানুষ হিসেবে তাদেরকে স্বীকার করতেই হবে। তারপর নিষ্ঠুর, বর্বর, অসভ্য, নির্মম ইত্যাদি যা খুশি বলতে পার।’ বিষয়টি নিয়ে আমি অনেকক্ষণ ভেবেছি। 

আমরা পত্রিকা, বেতার বা দূরদর্শনে কোনো দুঃসংবাদ দেখলে বা শুনলে কাউকে কাউকে অবলীলায় নরপশু, অমানুষ, দানব বলে ফেলি। অথচ নিজের বাবার প্রত্যক্ষ ও প্রমাণিত খুনিকেও ড. মেঘনা মানুষের মর্যাদা থেকে সরিয়ে দেননি; যার বাবার কথাই ছিল, ‘আমি মানুষ, তাই কোনো মানুষই আমার অনাত্মীয় নয়।’

মানুষকে মানুষ হিসেবে আখ্যা দিয়ে তা মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারার আত্মবোধসঞ্জাত গুণটি অর্জন করা সত্যিই খুব সহজ কাজ নয়। মানবিক মূল্যবোধের এহেন গুণটি অর্জন করার বিষয়টি তাই অত্যন্ত জরুরি; নতুবা ‘মেয়েটির নাম সুভাষিণী রাখলেও সে বোবাই রয়ে যাবে।’  

বেশ কিছু সফলতা অর্জন সত্ত্বেও পরিবারে, কর্মস্থলে, রাস্তাঘাটে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীরা এখনো ততটা সুরক্ষিত নয়, যদিও এ লক্ষ্যে প্রণীত আইন বা বিধানমালা যথেষ্ট রয়েছে। একটি পরিসংখ্যানের আশ্রয় নিতে পারি অধ্যাপক জাফর ইকবালের লেখা থেকে: “আমাদের দেশে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য এত রকম চেষ্টা চালানো হয় কিন্তু আমরা কি জানি এই দেশের হাই স্কুলের ছাত্রীদের শতকরা ৮০ ভাগ ইভটিজিংয়ের শিকার হয়? আমাদের দেশের ছেলেরা যথেষ্ট সত্যবাদী, তাদের শতকরা ৯৭ জন স্বীকার করেছে তারা মেয়েদের ইভটিজিং করে এক ধরনের বিমলানন্দ পেয়ে থাকে! তারপরও স্কুল পর্যায়ে ছাত্র থেকে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি, সেজন্য মেয়েদের প্রশংসা করতেই হয়। কিন্তু মেয়ে যে ঝরে পড়ে না তা নয়, যারা ঝরে পড়ে তার ৭০ ভাগ থেকে বেশি মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় এই ইভটিজিংয়ের কারণে।” 

এই যে ইভটিজিং ও এর পরিণতির কথা আমরা জানলাম, এটি কি নিছক যৌনতা? মূলত এটি হচ্ছে নারীরা পুরোপুরি মানুষ নয়, বরং কাজে অকাজে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও আজেবাজে মন্তব্য করে ‘বিমলানন্দ’ লাভের পাত্র বা পাত্রী, এমন এক নেতিবাচক ও বিকৃত আত্মিক অনুভূতি- নারীকে মানবিক মর্যাদা প্রদানের সক্ষমতার অনুপস্থিতি।    

ইভটিজিংয়ের কথাটি তুলে ধরে অধ্যাপক জাফর ইকবাল যে তথ্য ও মন্তব্য বিবৃত করেছেন তা গভীরভাবে ভাবার মতো, “এখনো যদি এ রকম অবস্থা হয়ে থাকে, দুইশ বছর আগে কী অবস্থা ছিল আমরা সেটা কল্পনা করতে পারি! সেই সময়ে বিদ্যাসাগর এক বছরেরও কম সময়ে একটি নয়, দুটি নয়, ৩৫টি মেয়েদের স্কুল খুলে ফেলেছিলেন। তার কা- দেখে ইংরেজ সাহেবেরা যখন সেই সব স্কুলের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করল তখন তিনি নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে শিক্ষক কর্মকর্তাদের বেতন দিয়েছেন!” (মুহম্মদ জাফর ইকবাল, চার কোটি বাঙ্গালী, মানুষ একজন, দৈনিক যুগান্তর, ০২ অক্টোবর, ২০২০)। যে প্রতিকূল সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এহেন মানবতামুখিন বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের দুঃসাহস করেছিলেন, আজ সে পরিস্থিতি নেই; তবু এখনো মানুষে মানুষে বৈষম্য নিয়ে নিরন্তর আন্দোলন হচ্ছে, এ বিষয়টিও স্বাভাবিক মনে হয় না। 

বলতে দ্বিধা নেই, আজকের কন্যাশিশু অভিধাটি একটি বিশেষ প্রেক্ষাপট থেকে উদ্ভূত। এই প্রেক্ষাপটটি সামাজিক বৈষম্য; যা সমূলে উৎপাটিত করতে না পারলে মানুষ হিসেবে আমাদের অবস্থান ও অগ্রগতি প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাবে। মানুষকে স্বার্থভিত্তিক সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়- এমন নিয়ামকসমূহ, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিচয়কে খাটো করা হয়- এমন ভাষা বা পদসমূহ, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিচয়কে খাটো করা হয়- এমন অভাষিক ভাবভঙ্গি বা ইঙ্গিতসমূহ, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করা হয়- এমন সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রবণতা, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করা হয়- এমন আইনি ধারাসমূহ (যদি থাকে), পাঠ্যপুস্তকে মানবতাবোধ, অধিকার, ন্যায্যতা, অহিংসা প্রভৃতির উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির নমুনা- এসব মৌলিক জিজ্ঞাসার যথাযথ জবাব অনুসন্ধান করেই সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে হবে।

আমরা চাই, অখণ্ড মানবতার সূত্র অবলম্বন করে কন্যাশিশুসহ সকল শিশু মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠুক, গড়ে তুলুক অধিকতর বাসযোগ্য একটি যুুক্তিশীল সমাজব্যবস্থা, যেখানে মানুষের পরিচয় হবে শুধুই মানুষ, অন্য কিছু নয়। 

লেখক: গবেষক, মানবাধিকারকর্মী

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //