লাগাতার আন্দোলন কি ‘আপসে’ চাপা পড়বে

সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন এখন আর ঢাকার বাইরে রোডমার্চ নয়, বরং সব কর্মসূচি হবে ঢাকাকেন্দ্রিক। এমনকি পুলিশ যদি অনুমতি না দেয়, তারপরও তারা কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। এরকম ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে যে, এই মাসে তারা ঢাকা ঘেরাওয়ের মতো বড় কর্মসূচি দিতে পারে।

পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কিছুটা রসিকতার ছলেই বলেছেন, ‘তলে তলে আপস’ হয়ে গেছে। তার এই বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রল তো বটেই, গণমাধ্যমেও নানামাত্রিক বিচার বিশ্লেষণ চলছে। বিশেষ করে এই মুহূর্তে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে, সেখানেও নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত খোঁজা হচ্ছে। যদিও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র সফরকালেই সে দেশের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, তারা বাংলাদেশের ওপর ভিসানীতির প্রয়োগ শুরু করেছে। অতএব ‘তলে তলে আপস’ বা সমঝোতা বলতে মি. কাদের কী বুঝিয়েছেন এবং কাদের সঙ্গে আপসের কথা বলেছেন কিংবা সেই আপসের অর্থ কী, তা পরিষ্কার নয়। অবশ্য পরে তিনি এর একটি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, ‘আপস’ শব্দে তিনি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কোন্নয়ন বুঝিয়েছেন। আর ‘তলে তলে’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন ‘পাবলিক খায়’ বলে। ওবায়দুল কাদের বলেন, তলে তলে আপস মানে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন বা আমাদের সম্পর্ক ভালো আছে, সেটা বোঝাতে চেয়েছি। (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৫ অক্টোবর ২০২৩)।

প্রসঙ্গত গত ৩ অক্টোবর ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত আমিনবাজারের শান্তি সমাবেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার হুমকি-ধমকি শেষ। এজন্য মির্জা ফখরুলের গলার সুর নরম হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সবার সঙ্গে ভারসাম্য করে ফেলেছেন। আর কোনো চিন্তা নেই। অক্টোবরে, নভেম্বরে, ডিসেম্বরে কিছুই হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘দিল্লি আছে, আমেরিকারও দিল্লিকে দরকার। আমরা আছি, দিল্লিও আছে। শত্রুতা কারও সঙ্গে নেই। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। শেখ হাসিনা এমন ভারসাম্য সবার সঙ্গে করে ফেলেছেন। নির্বাচন হবে যথাসময়ে।’

বস্তুত সরকার ও ক্ষমতাসীন দলকে যদি সত্যি সত্যি ‘তলে তলে আপস’ করতে হয়, সেই আপস করতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই। কেননা আগামী নির্বাচনে বিএনপি বা বিরোধী জোটের আন্দোলনের চেয়েও সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ মার্কিন প্রশাসনের পদক্ষেপ। বিএনপিও এখন তাদের দাবি আদায়ে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের দিকেই তাকিয়ে আছে বলে অনেকে মনে করছেন এবং তা মনে করার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। অতএব সরকারের সঙ্গে যদি সত্যিই তলে তলে যুক্তরাষ্ট্রের আপস বা সমঝোতা হয়ে যায়, তাহলে বিএনপির লাগাতার আন্দোলনের ফল কী হবে? তলে তলে আপস কি ওই আন্দোলনে পানি ঢেলে দেবে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, যদি সত্যিই তলে তলে আপস হয়, সেটি কী এবং আপস মানেই সেখানে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’। কীসের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের ব্যাপারে নমনীয় কিংবা ‘নিউট্রাল’ হবে? নাকি এই আপস কিংবা সমঝোতার কথা প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার জন্য নিছকই রাজনৈতিক বুলি? 

প্রায় ১৭ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও ১৯৭৫ থেকে টানা ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে আর কোনো দল এভাবে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল না। ফলে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং অসংখ্য মামলায় জর্জরিত বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতারাও এবারের আন্দোলনকে বাঁচা-মরার লড়াই হিসেবে দেখছেন। অনেক দিন ধরেই তারা এক দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন। ৯ থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি। যদিও এই কর্মসূচি নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তুষ্টি আছে বলে শোনা যায়। দলের একটি অংশ এখনই চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার পক্ষে। তবে একটি অংশ তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত ঢাকা ঘেরাও বা এরকম বড় কর্মসূচি দেওয়ার পক্ষপাতী নয়। কেননা বড় ধরনের কর্মসূচি সংঘাতের জন্ম দিতে পারে; বিএনপির নেতাকর্মীরা গণহারে গ্রেপ্তার হতে পারেন এবং তাতে হিতে বিপরীত হবে বলেও তারা আশঙ্কা করছেন। তাছাড়া তফসিলের আগে বড় ধরনের আন্দোলন করলে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি না, সেটি নিয়েও তাদের মধ্যে সংশয় আছে। এসব কারণে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি কী হবে, সেটি নিয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও মতবিরোধ আছে বলে শোনা যায়। 

তবে যে প্রশ্নটি এখন রাজনৈতিক মহলে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে তা হলো, বিএনপি কি আমেরিকার স্যাংশন বা বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধের মতো পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করছে? অর্থাৎ বিদেশিদের চাপের ওপর নির্ভর করে তারা সরকারের পতন ঘটাতে বা ক্ষমতায় আসতে চায়? আওয়ামী লীগের মতো একটি শক্তিশালী দল, টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকায় প্রশাসনসহ সর্বত্র যাদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বেশ শক্ত এবং বিরাট সুবিধাবাদী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে; যারা নিজেদের স্বার্থেই পুনরায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চায়, তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করার মতো সাংগঠনিক শক্তি এবং জনভিত্তি কি বিএনপির আছে? যদি না থাকে তাহলে কি বিদেশি শক্তিই তাদের ভরসা? 

এই প্রশ্নটা বিএনপির সিনিয়র নেতাদের কানেও যে পৌঁছেছে সেটি বোঝা যাচ্ছে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীরের বক্তব্যেও। তিনি দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে প্রশ্ন রেখে বলেছেন, ‘এখন আমরা যে দুঃশাসনের মধ্যে পড়েছি, এখন যারা আমাদের বুকের ওপর চেপে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছে, মারছে, খুন করছে, হত্যা করছে, লুণ্ঠন করছে, এটাকে সরানোর দায়িত্ব কার? এই স্যাংশনের ওপর নির্ভর করে থাকলে হবে, ভিসানীতির ওপর নির্ভর করে থাকলে হবে? অন্য কেউ করে দিয়ে যাবে? যা করার আমাদেরই করতে হবে।’(ডেইলি স্টার অনলাইন, ৭ অক্টোবর ২০২৩)।

মির্জা ফখরুল যে প্রশ্ন তার দলের নেতাকর্মীদের কাছে রেখেছেন, সেরকম প্রশ্ন জনমনেও আছে যে, বিদেশিরা, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই কি একটা দেশের সরকার ফেলে দিতে পারে? এই প্রশ্নটি উঠেছিল গত ১০ এপ্রিল জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত বিশেষ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছিলেন যে, ‘আমেরিকা চাইলে যে কোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে-পাল্টাতে পারে’ এবং এরপরও তিনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকার, সংবাদ সম্মেলন ও বক্তব্যেও বলার চেষ্টা করেছেন যে, আমেরিকা চায় না তিনি ক্ষমতায় থাকুন। তাতে এই প্রশ্নটি জনমনে তৈরি হয়েছে, আমেরিকা যদি না চায় তাহলে কি বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না? বিএনপি ক্ষমতায় চলে আসবে? যদি তাই হয়, তাহলে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের কী ক্ষমতা? দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা রাখার কী দরকার? আমেরিকাই যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় কে থাকবে না থাকবে, তাহলে সংবিধান কেন জনগণকে ‘সকল ক্ষমতার মালিক’ বলে ঘোষণা দিয়েছে? 

এই ইস্যুতে আরও যে প্রশ্নটি জনপরিসরে আছে সেটি হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে বিদেশি শক্তি কেন লাগবে? কেন তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায় বা গলাতে পারছে? সেই সুযোগটা তাদের কে করে দিচ্ছে? একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের ৫২ বছর পরও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে ব্যর্থ হচ্ছে কেন? কেন তাদেরকে বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে বা বিদেশিদের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি করতে হচ্ছে? যে দলের জনভিত্তি রয়েছে, সেই দলকে কেন রাজনৈতিক আন্দোলন করতে গিয়ে বিদেশি সহায়তা নিতে হয়? তার মানে তাদের জনভিত্তি দুর্বল? আর সরকারও যদি বলে আমেরিকা চাইলে যে কোনো দেশের সরকার ফেলে দিতে পারে, তাতেও কি এটা মনে হয় না যে, সরকারের আত্মবিশ্বাসেও ঘাটতি রয়েছে?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //