মিথ্যা নয়, আরাধনা হোক সত্যের

ভিসানীতি মিডিয়ার ওপর প্রয়োগ হবে মর্মে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রব উঠেছে, এটা বাক স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ। সাংবাদিকরা এই ঘোষণায় গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার ইঙ্গিত খুঁজছেন। মিডিয়ার লোকজনের এত ভয় পাওয়ার কারণ বোঝা গেল না, ইচ্ছাকৃতভাবে সত্যকে মিথ্যা বা মিথ্যাকে সত্যের প্রলেপ দিয়ে পরিবেশন করলেও তাদের কিছু বলা যাবে না কেন? ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের কথা বলে আমেরিকা সারা বিশ্বে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অকৃত্রিম বন্ধু রাষ্ট্র ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার পার্লামেন্টে বললেন, ৪৫ মিনিটের মধ্যে ইরাক লন্ডনে গণবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাতে পারে। তখন পশ্চিমা ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ সংবাদপত্রগুলো ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে থাকে। মিডিয়ার মিথ্যা অপপ্রচারে মুসলিম দেশগুলোও পশ্চিমা শক্তির পক্ষে অবস্থান নিল, ইরাক ধ্বংস হলো, সাদ্দাম হোসেনকে মরতে হলো। এমন ঘটনা অসংখ্য; তারপরও মিথ্যে বলার জন্য মিডিয়ার শাস্তি হবে না? ভিসানীতির আওতা মুক্ত থাকবে? কেন?

অধিকাংশ মিডিয়া নিরপেক্ষ নীতি পরিহার করেছে। বাক স্বাধীনতার প্রবক্তা আমেরিকার মিডিয়া দুই ভাগে বিভক্ত- কিছু ট্রাম্প এবং রিপাবলিকান পার্টিকে সমর্থন করে, অন্যদিকে কিছু জো বাইডেন ও ডেমোক্র্যাট দলকে সমর্থন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভক্ত মিডিয়াগুলো তাদের সমর্থিত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কিছু বলে না, সত্যকে আড়াল করে মিথ্যা প্রচার করতে দ্বিধা করে না। ট্রাম্প তার বিপক্ষের মিডিয়াকে উপহাস করে ‘ফেইক নিউজ অ্যাওয়ার্ড’ পদকে ভূষিত করেছিলেন। 

বাংলাদেশের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যক্তিমালিকানাধীন হলেও রাজনৈতিক দল ও আদর্শের সমর্থনে দুই ভাগে বিভক্ত; এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পত্রিকা মালিকের নিজস্ব ধ্যানধারণা, অভিমত। মিডিয়ার কর্মীরা মালিক ও সম্পাদকের ধ্যানধারণায় প্রভাবিত এবং তাদের নির্দেশনা মোতাবেক খবর টুয়িস্ট হয়ে থাকে। এছাড়াও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মতো সাংবাদিক সমাজও দুই ভাগে বিভক্ত- আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী। বাংলাদেশে বিভাজিত মানুষের পেশাগত নিরপেক্ষতার হদিস পাওয়া যায় না। এই জটিল সমীকরণে নির্বাচনের সত্য তথ্যের নিশ্চয়তা পাওয়া সহজ নয়। কোনপক্ষের তথ্য আমেরিকা তাদের ভিসানীতির জন্য সত্য হিসেবে গ্রহণ করবে? হাজার হাজার ভোট কেন্দ্রে হাজার হাজার পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া আমেরিকার পক্ষে সম্ভব হবে না বিধায় আমেরিকাকে বাংলাদেশের মিডিয়ার ওপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মিথ্যা ও গুজবে ভর্তি। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে মিডিয়ার যে সকল কর্মী থাকবেন তাদের সকলের নিরপেক্ষ অবস্থানের নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। ২০১৩ সালে রাজধানীর শাপলা চত্বরে পুলিশের গুলিতে হেফাজতে ইসলামের ৬১ জন সদস্যের মৃত্যু নিয়ে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর তথ্য যে সঠিক নয় তা সম্প্রতি আদালতে প্রমাণ হয়েছে। তাই ভুল সংবাদের ভিত্তিতে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে নিরপরাধীকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। 

‘অধিকার’ সংগঠনটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ফেডারেশনের সদস্য। ‘অধিকার’ ২০১৩ সনে মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের অবস্থানের ওপর পুলিশের গৃহীত ব্যবস্থাদির বিষয়ে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। রিপোর্টে ৬১ জন মারা যাওয়ার উল্লেখ      থাকলেও তাদের নাম, ঠিকানার উল্লেখ ছিল না। পুলিশ মৃত্যুর এই সংখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করে রিপার্টে উল্লেখিত মৃতদের নাম ও ঠিকানা প্রকাশ করতে অনুরোধ করে; কিন্ত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের নিরাপত্তাজনিত কারণ উল্লেখ করে ‘অধিকার’ পুলিশের অনুরোধ উপেক্ষা করে।

সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ও ৬১ জনের নাম-ঠিকানাসহ বিস্তারিত জানতে চেয়ে অধিকারকে চিঠি দেয়, কিন্তু তারা তথ্য দিতে অস্বীকার করে। মৃতের এই তালিকা তারা দেশি-বিদেশি পাঁচটি সংগঠনকেও সরবরাহ করে। এই অবস্থায় ‘অধিকার’ সংগঠনটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে মিথ্যা তথ্য এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টির অভিযোগে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খান এবং পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানকে ২ বছরের কারাদ- দিয়েছে আদালত। ‘অধিকার’ আরেকটি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে, শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ উচ্ছেদের সঙ্গে সম্পর্কহীন অন্য সময়ের বিভিন্ন নাশকতার পুরনো কিছু ছবি প্রতিবেদনে সন্নিবেশ করেছে। মামলা করার পর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অসংখ্য মানবাধিকার সংগঠন নিঃশর্তভাবে ‘অধিকার’-এর বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছিল। 

একই সুরে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মামলাও স্থগিত রাখার দাবি করেছিলেন ১৮৩ বিশিষ্ট ব্যক্তি। এই সকল মানবাধিকার সংগঠন ও বিশিষ্ট ব্যক্তি বাক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রকে গৌণ ও গুরুত্বহীন করে তুলেছেন।

মৃতের সংখ্যা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর প্রতিবেদন সঠিক- এই কথা কিন্তু কোনো মানবাধিকার সংগঠন সুনির্দিষ্টভাবে বলছে না। তারা বাক স্বাধীনতার নামে মিথ্যাকে সমর্থন করছে। মৃতের সংখ্যা নিয়ে সরকার বলছে ১১, হেফাজতে ইসলাম বলছে ৭৩, বিএনপি আর জামায়াতে ইসলামী বলছে হাজার হাজার। কিন্তু সরকার ছাড়া আর কেউ নিহত ব্যক্তির নাম-ঠিকানা প্রকাশ করছে না। ‘অধিকার’-এর আদিলুর রহমান খান এবং এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের কারাদ- হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট।

বাংলাদেশে গুম হওয়া নিয়েও মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার; কিন্তু সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার জন্য গুমের কারণ ও সঠিক পরিসংখ্যান নিরূপণ করা প্রয়োজন। গুম হওয়া সবাই বিএনপির নেতাকর্মী- এমন বলা হলে জঙ্গি কর্মকা-ে জড়িত হয়ে যারা স্বেচ্ছায় গা ঢাকা দিচ্ছে তারাও বিএনপির কর্মী হয়ে যায়। গুরুতর অপরাধ করেও অনেকে আত্মগোপনে চলে যায়। প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্যও কেউ কেউ গা ঢাকা দেয়। জাতিসংঘ গুম হওয়া ব্যক্তির যে তালিকা তৈরি করেছে তাদের মধ্যে ২ জন ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের নেতা। জাতিসংঘকে যারা ভুল তথ্য সংবলিত তালিকা দিয়েছে তাদেরও শাস্তি হওয়া উচিত। 

মানুষের অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রচার ও সুরক্ষায় মানবাধিকারকর্মী এবং সুশীল সমাজ সংগঠনগুলোর কার্যক্রমকে যুক্তরাষ্ট্র নাকি দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। তাহলে তারা অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে শাস্তি দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে কেন? আফগানিস্তান এবং ইরাকে মার্কিন সেনার নানা অপকর্ম সংবলিত সকল নথি প্রকাশ করে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ কোনো পাপ করেননি; অ্যাসাঞ্জ যা করেছেন, অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকরা হরহামেশা তাই করে থাকেন। কিন্তু আমেরিকা তাকে ১৭৫ বছর কারাভোগের শাস্তি দিতে চায়। যে পশ্চিমা দুনিয়া আমাদের দেশের ‘অধিকার’ সংগঠনের মিথ্যা তথ্য পরিবেশনকে বাক স্বাধীনতার মোড়কে জায়েজ করতে উঠেপড়ে লেগেছে, সেই তারাই সত্য প্রকাশে বাধা দিচ্ছে, আর বলছে, ‘অপরাধ প্রমাণিত হলে বাক-স্বাধীনতার নামে অ্যাসাঞ্জ সুরক্ষা পাবে না।’ 

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী স্বাধীনভাবে কোনো বাধা ব্যতীত মত প্রকাশ করা, বিশ্বের যে কোনো মাধ্যম থেকে যে কোনো তথ্য সংগ্রহ করা এবং সেই তথ্য মৌখিক, লিখিত, চিত্রকলা অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে জ্ঞাপন করার অধিকারই বাক স্বাধীনতা। তবে বাক স্বাধীনতার অবাধ প্রয়োগে কারও মর্যাদাহানি হলে, সম্মানে আঘাত লাগলে, কুৎসা রটানো, গুজব ছড়ানো, অশ্লীল ও আক্রমণাত্মক শব্দ দ্বারা কাউকে আক্রমণ করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হয় না, এজন্যই বাক স্বাধীনতা আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ। 

মিথ্যা এবং গুজব প্রতিষ্ঠার জন্য নিজ স্বার্থে অনেকে একজোট হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সত্যকে চাপা দেওয়ার জন্য পতিতালয়ের অমার্জিত, অশ্লীল ভাষার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তাই গুজব আর মিথ্যা কথন রোধ করা জরুরি। 

বাক স্বাধীনতা আর মানবতার নামে মিথ্যার জয়গান করা সমর্থনযোগ্য নয়। তবে দেখা যায়, যে ব্যক্তি ডিজিটাল আইনের বিরুদ্ধে সেই ব্যক্তি আবার ব্লাসফেমি আইনের পক্ষে। এই বিরোধী দল যখন ক্ষমতায় যায় তখন আবার তাদের চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে। তবে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে মুক্ত মানুষের সত্য প্রকাশের অধিকার থাকা সমীচীন। তবে কোনো স্বাধীনতাই শর্তহীন হওয়া সমীচীন নয়, কারণ মিথ্যাকে সমর্থন করা বা উসকে দেওয়া বাক স্বাধীনতা নয়। 

মিডিয়ার ভয়ে এমনিতেই সবাই তটস্থ থাকে; কারণ মিডিয়া ইচ্ছে করলে নয়কে ছয়, ছয়কে নয় করতে পারে। অন্যের নয়-ছয় করা থেকে বাঁচার জন্য সাম্প্রতিককালে অগাধ সম্পদের মালিকগণ নিজেদের মালিকানায় মিডিয়া রেখে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর গোপন নথি ফাঁস করে সত্য প্রকাশের জন্য স্নোডেন, ম্যানিং ও অ্যাসাঞ্জকে শাস্তি দেওয়ার জন্য পশ্চিমা দেশের শাসকেরা একজোট হলেও গ্রিন পার্টির সদস্যদের উদ্যোগে জার্মানির বার্লিনে তাদের তিন জনের প্রতিমূর্তি উন্মোচিত হয়েছে, তিন জনই নতুন প্রজন্মের কাছে নায়কের মর্যাদা পেয়েছেন। এই তিনটি প্রতিমূর্তির পাশে একটি খালি চেয়ার রাখা হয়েছে যাতে দাঁড়িয়ে যে কেউ সত্য বক্তব্য রাখতে পারেন। তাই নতুন প্রজন্মকে সত্যের আরাধনায় ব্রতী হতে হবে।

লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //