গত রবিবার (১৫ অক্টোবর) ঢাকা মহানগরে ‘১ মিনিট শব্দহীন’ কর্মসূচি পালন করেছে সরকার। সকাল ১০টা থেকে ১০টা ১ মিনিট পর্যন্ত রাজধানীর ১১টি নির্দিষ্ট এলাকায় কর্মসূচিটি পালন করলেও এক মিনিটও শব্দদূষণ বন্ধ করা যায়নি।
শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মানুষকে মুক্ত রাখতে সচেতনতার অংশ হিসেবে এ কর্মসূচি পালিত হলেও এটি ছিল আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব একটি কর্মসূচি।
শব্দ দূষণকে সাধারণত উচ্চ শব্দের মাত্রার নিয়মিত প্রভাব হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যা মানুষ বা অন্যান্য জীবন্ত প্রাণীর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৭০ ডেসিবলের কম শব্দের মাত্রা জীবন্ত প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর নয়, তা নির্বিশেষে প্রভাব যত দীর্ঘ বা সামঞ্জস্যপূর্ণ হোক না কেন। ৮৫ ডেসিবলের বেশি স্থির শব্দে 8 ঘণ্টার বেশি প্রভাব বিপজ্জনক হতে পারে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান Panara Air বলছে, “Noise and sound are two related but distinct concepts in acoustics and communication. Sound refers to any audible vibration of air particles that propagate through a medium, such as air, water, or solids. It is a physical phenomenon that can be perceived by the human ear and has characteristics such as frequency, amplitude, and waveform.
On the other hand, noise refers to any unwanted or disturbing sound that causes physical discomfort. It is a type of sound that is considered undesirable or irrelevant in a particular context or situation. Noise can be characterized by its randomness, irregularity, or unpredictability, and it can arise from various sources, such as machinery, traffic, crowds, or environmental factors.
Thus, the main difference between noise and sound is that sound is a physical phenomenon that can be intentional or desired, while noise is a subjective perception of sound that is unwanted or distracting. Additionally, while sound can have positive effects on human emotions and behavior, noise can cause stress, annoyance, or even health problems in certain cases.”
শব্দদূষণ জনস্বাস্থ্যের তথা মানব দেহের উপর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ক্রমাগত উচ্চ শব্দের সংস্পর্শে নিম্নলিখিত ক্ষতিকারক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে:
শ্রবণ সমস্যা: শ্রবণশক্তি হ্রাস, টিনিটাস এবং কানের পর্দার ক্ষতি করে। শব্দের প্রতি সংবেদনশীলতা হ্রাস করে যা বধিরতা সৃষ্টি করে।
শারীরিক সমস্যা: তীব্র মাথাব্যথা, রক্তচাপ ও পালস রেট বেড়ে যায়; শ্বাসকষ্ট, গ্যাস্ট্রাইটিস, কোলাইটিস এবং হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা তৈরি করে।
কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা: স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে উচ্চ রক্তচাপ, কার্ডিওভাসকুলার রোগ, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পায়।
মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা: ক্রমাগত মানসিক চাপ, ক্লান্তি, বিষণ্নতা, উদ্বেগ, আক্রমনাত্মক আচরণ এবং হিস্টিরিয়া হতে পারে। অত্যধিক উচ্চ মাত্রার শব্দ ঘুমের ধরনকে ব্যাহত করে।
যোগাযোগে সমস্যা: উচ্চ ডেসিবেল শব্দ মানুষের মধ্যে অবাধ যোগাযোগকে প্রভাবিত করে, যার ফলে ভুল বোঝাবুঝি হয়।
জ্ঞানীয় সমস্যা এবং আচরণগত পরিবর্তন: শব্দ দূষণ মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া কমিয়ে দেয় ফলশ্রুতিতে স্মৃতিশক্তি এবং মনোযোগের ঘাটতি তৈরি হয়। যার কারণে কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা কমে যাওয়া এবং শিশুদের শেখার প্রক্রিয়াতে ব্যাঘাত ঘটার মতো ঘটনা তৈরি করে।
বন্যপ্রাণীর উপর প্রভাব: বাসস্থানের গুণমান হ্রাস করে, চাপের মাত্রা বাড়ায়, পরিযায়ী পাখিদের প্রভাবিত করে, সংখ্যা হ্রাসের দিকে পরিচালিত করে এবং সামুদ্রিক প্রাণীদের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে যারা ইকোলোকেশনের উপর নির্ভর করে।
বর্তমানে শব্দদূষণের নেতিবাচক প্রভাবে শুধুমাত্র ইউরোপে বছরে প্রতিদিন ৪৮ হাজার নতুন ইস্কেমিক হৃদরোগ এবং তার প্রভাবে ১২ হাজার অকাল মৃত্যু ঘটছে। এছাড়াও ২২ মিলিয়ন লোক দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ বিরক্তিতে ভোগে এবং ৬.৫ মিলিয়ন লোক দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ ঘুমের ব্যাঘাতে ভোগে।
‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ইউএনইপি। এতে বিশ্বের ৬১ শহরের শব্দ দূষণের মাত্রা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যার মধ্যে ঢাকার অবস্থান প্রথম এবং রাজশাহীর অবস্থান চতুর্থ। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ঢাকায় শব্দের সর্বোচ্চ তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল এবং রাজশাহীতে এর মাত্রা ১০৩ ডেসিবল পাওয়া গেছে।
বিপরীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৯৯ সালের গাইডলাইন বলছে, আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। ২০১৮ সালের সবশেষ হালনাগাদ গাইডলাইনে আবাসিক এলাকায় এই মাত্রা সর্বোচ্চ ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত এই মাত্রা বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, ঢাকা ও রাজশাহীতে শব্দের তীব্রতা এই নির্ধারিত মাত্রার দ্বিগুণেরও বেশি।
নানাবিধ কারণে শব্দদূষণ ঘটে। গাড়ি ও এর হর্ণ শহর এলাকায় শব্দদূষণের প্রধান কারণ। প্রায় সময় গাড়ি চালকরা অনর্থক হর্ণ বাজান।
দুঃখজনকভাবে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায় সরকারি যানবাহনগুলোর ভেতরে এবং ভিআইপি গাড়িবহরগুলোতে। ইদানিং এমনকি ব্যক্তিগত গাড়িতেও উচ্চস্বরে ইমার্জেন্সি সাইরেন বাজিয়ে চলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
শহরের অনেক স্থানে ১০ মিনিটের ভেতরে ১০০০ বার পর্যন্ত হর্ণ বাজানো হয়। তাছাড়া বিয়ে, অনুষ্ঠান, উৎসব, ওয়াজ মাহফিল, বিভিন্ন পার্টি, কনসার্ট, ইমারত নির্মাণ, আবাসিক এলাকায় ফ্যাক্টরি ইত্যাদি নানান কারণে শব্দদূষণ ঘটে।
শব্দদুষণ রোধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে ‘শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬’ একমাত্র লিগ্যাল ইন্সট্রুমেন্ট এই বিধিমালা অনুযায়ী, প্রথমবার শব্দদূষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছর জেল অথবা ৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড, আর দ্বিতীয়বার করলে ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা ৬ মাসের জেল অথবা উভয় দণ্ড।
সারা বিশ্বের মধ্যে যে শহরটি শব্দদূষণে প্রথম সেই ঢাকা শহরে এই আইনের প্রয়োগহার ৩.৬%। এছাড়া আরও যে সকল আইন, বিধি, ধারা শব্দদূষণকে রোধ করতে পারে সেগুলো হলো- ‘আমদানী নীতি আদেশ ২০১৫-২০১৮, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯, মোটরযান আইন ১৯৮৮, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮, ইমারত নির্মান বিধিমালা ২০০৮ ইত্যাদি। কিন্তু কোন আইনেরই প্রয়োগ নাই!
শব্দদূষণকে এখন বলা হচ্ছে, শব্দ সন্ত্রাস! এই সন্ত্রাসের কবল থেকে মুক্তি পেতে হলে নাগরিকের জায়গা থেকে তার নাগরিক দায়িত্ব পালনে অনেক বেশি সচেষ্ট হতে হবে। অন্যদিকে সরকারকে জনসচেতনতা তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ এবং আইনের প্রয়োগকে নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
অচিরেই ‘শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬’কে সংশোধন করে হালনাগাদ করতে হবে। কারণ এই আইনের মধ্যে যথেষ্ঠ ফাঁকফোকর বিদ্যমান। নাহলে অচিরেই আমরা এক বধির দেশে পরিণত হবো।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh