উৎকণ্ঠার অক্টোবর, আশঙ্কার নভেম্বর

অক্টোবর নিয়ে উৎকণ্ঠায় আর নভেম্বর নিয়ে আশঙ্কায় দেশের জনগণ। পায়ের নিচে মাটি থাকবে না আর, মাথায় ইউরেনিয়াম ঢেলে দেওয়ার হুমকি পাল্টা হুমকি, আলটিমেটাম পাল্টা আলটিমেটাম নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা বাড়ছে। এক পক্ষ বলছে ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া হবে না তো অন্য পক্ষ বলছে রাস্তায় নামতে দেওয়া হবে না। এ সব কিছুই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে।

এর মধ্যেই জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু ভোটের পরিবেশসহ নির্বাচন সম্পর্কে আস্থা তৈরির ক্ষেত্রে খুব যে অগ্রগতি নেই, তা বোঝা যায় নির্বাচন কমিশনের আগাম নিরাপত্তার প্রার্থনা দেখে। 

অন্যদিকে প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ভোট চাওয়ার কারণে ইসির অনুরোধে জামালপুরের জেলা প্রশাসককে সরিয়ে দেওয়া হলেও প্রশাসন ও পুলিশের নানা পর্যায়ের কর্মকর্তার বক্তব্য দেখে নির্বাচনের সময় তাদেরকে নিরপেক্ষ রাখা বা নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ কী নেওয়া হবে সে বিষয়ে প্রশ্ন ও সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধান বিতর্ক চলছে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে। এই বিতর্ক ও বিরোধের মধ্যে কীভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, সে সম্পর্কে ইসির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য নেই। তবে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, অতীতের মতো করেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং ইসির প্রতি আস্থার সংকট দূর করার প্রশ্নেও বিশেষ কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। বরং তাদের কিছু বক্তব্যে এবং পদক্ষেপে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে, এই প্রশ্নে আশঙ্কা কমছে না, আস্থাও তৈরি হচ্ছে না। 

জাতীয় নির্বাচন বলতে সংসদ সদস্যদের নির্বাচনকে বোঝানো হয়। সংবিধানের ১১৯(১) অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে গত পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। নির্বাচন সুষ্ঠু করার স্বার্থে কমিশন অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ক্ষমতা প্রয়োগে আগ্রহী হয়নি, যার ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারেনি।

আরপিওর ৯১-ই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যদি নির্বাচন কমিশনের নিকট প্রতীয়মান হয় যে কোনো প্রার্থী বা তার এজেন্ট আরপিও বা বিধিমালা বা আচরণ বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করেছেন বা লঙ্ঘনের চেষ্টা করছেন, তবে কমিশন কতিপয় শর্ত পালন সাপেক্ষে তার প্রার্থীপদ বাতিল করতে পারবেন। কিন্তু কমিশন এ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন, এমন কোনো উদাহরণ কি আছে?

গণপ্রতিনিধি আদেশে একজন প্রার্থীর ব্যয়সীমা ২৫ লাখ টাকা নির্ধারিত হলেও অধিকাংশ প্রার্থী অনেকগুণ বেশি টাকা নির্বাচনে খরচ করেন। নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ নিয়েছে সে দৃষ্টান্তও নেই। ফলে নির্বাচনে পেশিশক্তি ও কালো টাকার প্রভাব অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে চলেছে, যা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করে ফেলছে।

নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নির্বাচন পরিচালনা করে মূলত মাঠ প্রশাসন। আরপিও ১৯৭২-এ সংসদ সদস্যদের নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা না থাকলেও কমিশন কর্তৃক জেলা প্রশাসককে (ডিসি) রিটার্নিং অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে (ইউএনও) সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ প্রদান একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর রিটার্নিং অফিসার মাঠ পর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসার নিয়োগ দিয়ে থাকেন।

নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি, ওসিসহ পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ডিসি, ইউএনও, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি, ওসিদের নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ তাদের পদোন্নতি, বদলিসহ শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকায় ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে নির্বাচনে তাদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা সহজ।

স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১১টি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে চারটি যেমন- অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬-এর ১২ জুন, ২০০১-এর ১ অক্টোবর এবং ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে মাঠ প্রশাসন আপাত নিরপেক্ষতা দেখিয়েছিল। আর দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যেমন- আওয়ামী লীগের শাসনামলে ১৯৭৩-এর ৭ মার্চ, বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৭৯-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি, জাতীয় পার্টির শাসনামলে ১৯৮৬-এর ৭ মে ও ১৯৮৮-এর ৩ মে এবং বিএনপি শাসনামলে ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি, আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারি ও ২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মাঠ প্রশাসন নিরপেক্ষতা রক্ষা করেনি। প্রতিবারই ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারগুলোর পক্ষে কাজ করার অভিযোগ ও প্রমাণ আছে মাঠ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। ফলে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি এবং এসব নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কোনো দলীয় সরকার পরাজিত হয়নি।

তাই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- ক) সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, এমন একটি আইনি কাঠামো থাকা, খ) প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা না থাকা যাতে ভোটারদের সামনে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রার্থী থাকে। গ) সঠিকভাবে প্রার্থী বাছাই এবং ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের সামনে যথাযথ তথ্য থাকা। ঘ) প্রার্থী এবং ভোটারদের ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে স্বাধীনভাবে নির্বাচন করতে পারা ঙ) টাকার খেলা এবং পেশিশক্তির মাধ্যমে ভোটারদের প্রভাবিত করার অপচেষ্টা নিয়ন্ত্রণ। চ) ভোট প্রদান এবং ভোট গণনা সঠিকভাবে করা। ছ) দ্রুততার সাথে এবং সঠিকভাবে নির্বাচনী বিরোধ মীমাংসা করা। আর সবচেয়ে বড় কথা এমন ধরনের আস্থার পরিবেশ তৈরি করা যাতে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল, প্রার্থী এবং ভোটাররাও মনে করেন যে ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, কারসাজিমুক্ত বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে।

নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অর্থবহ করার লক্ষ্যে সাংবিধানিক সংস্কারের পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থেই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ক) ‘না-ভোটে’র পুনঃপ্রবর্তন করা খ) হলফনামার ছকে পরিবর্তন এনে এটিকে যুগোপযোগী করা এবং হলফনামায় মিথ্যা তথ্য প্রদান বা তথ্য গোপনকারীদের মনোনয়নপত্র বাতিলের সুস্পষ্ট বিধান করা। গ) হলফনামার তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের বিধান করা ঘ) প্রত্যেক প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব যাচাই-বাছাইয়ের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা ঙ) নির্বাচনী ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রার্থী ও ভোটারদের নিয়ে প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় প্রকাশ্য বিতর্ক, প্রশ্নোত্তরপর্ব, মতবিনিময় সভার আয়োজন এবং হলফনামার তথ্য ছাপিয়ে তা ভোটারদের মধ্যে বিলির বিধান করা চ) বিদেশে বা নির্বাচনী এলাকার বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশের নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা করা।

সরকারি হিসাবেই বলা হচ্ছে ১ কোটি ৪৯ লাখ মানুষ দেশের বাইরে আছে। যাদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী করে কিন্তু নির্বাচনে তাদের মতের প্রতিফলন ঘটানোর ব্যবস্থা নেই।

আবার বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠনের কথা থাকলেও বাস্তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের বিপরীতের দলই বিজয়ী হিসেবে দেশ শাসন করছে। যে নির্বাচনগুলো আপাত অর্থে গ্রহণযোগ্য ছিল সেখানেও দেখা যায়, ১৯৯১ সালে বিএনপি ৩০.৮১ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪৪ শতাংশ, ২০০১ সালে বিএনপি ৪০.৯৭ শতাংশ এবং ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ৪৮.৯০ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করেছিল। যদিও এসব নির্বাচনে নানা জোটের ভোটের সমীকরণ ছিল, তারপরও এটা তো পরিষ্কার যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষেই ছিল। ফলে উপেক্ষিত সংখ্যাগুরুর নির্বাচনী ব্যবস্থা পাল্টানোর সময় এসেছে। এমন ব্যবস্থা করা দরকার যাতে সকল ভোটারের ভোট গুরুত্ব পায়। সে ক্ষেত্রে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা বা আনুপাতিক ভোটের ভিত্তিতে সংসদ সদস্য নির্বাচন, অর্থাৎ যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, সে দল জাতীয় সংসদে তত শতাংশ সংখ্যক প্রতিনিধি পাঠাবে, এই পদ্ধতিটি বিবেচনার দাবি রাখে। পৃথিবীর ৮৭টি দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু আছে। নেপাল এবং শ্রীলংকায় এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। আমাদের মতো সংঘাতময় এবং আস্থাহীনতার নির্বাচনী দেশে এই পদ্ধতি গ্রহণ করা দরকার। কালো টাকা, পেশিশক্তি, সাম্প্রদায়িকতা ও আঞ্চলিকতার বিপরীতে কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে এই পদ্ধতি সহায়তা করবে। আর প্রতিনিধিত্ব থাকার সুযোগ তৈরি হলে সংসদে কিছুটা হলেও মানুষের মতামত উত্থাপিত হবে। 

ক্ষমতা পরিবর্তনের দুটি পথ, নির্বাচন আর অভ্যুত্থান। এ ক্ষেত্রে সংঘাতের আশঙ্কা এড়িয়ে ক্ষমতার পালাবদল করতে নির্বাচনকেই অনেকে গ্রহণযোগ্য পথ মনে করেন। যদিও এতে ব্যবস্থা বদলায় না। শুধু ক্ষমতার পালাবদল হয়ে থাকে। কিন্তু সেটাও আর স্বাভাবিকভাবে হচ্ছে না। ফলে গত পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা আর বর্তমানের মারমুখী পরিস্থিতিতে এটা স্পষ্ট যে, নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কার আনা অপরিহার্য। তা না হলে সরকার নির্বাচিত হোক আর অনির্বাচিত হোক জনগণ গণতন্ত্রের স্বাদ পাবে না। ক্ষমতা কেন্দ্রিক সংঘাতের আশঙ্কাও কমবে না। 

লেখক: সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাসদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //