সংবিধানের ভেতরে থেকেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব?

কোন সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে, সেটিই যখন রাজনীতির মাঠে প্রধান আলোচ্য বিষয়, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তরফে বারবারই বলা হচ্ছে, ‘সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’ 

প্রশ্ন হলো, কেন সংবিধানের বাইরে যাওয়ার প্রসঙ্গ আসছে এবং এর ভেতরে কী আছে যে ক্ষমতাসীন দল যার বাইরে যেতে পারবে না? আর এখন তারা যে বাইরে যেতে পারবে না বলছে, সেটির ভেতরে একসময় কী ছিল? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, সংবিধানের ভেতরে থেকে, অর্থাৎ সংবিধান সংশোধন না করেই কি একটি গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা সম্ভব? যদি সম্ভব হয় তার জন্য অন্তত প্রধান দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কি রাজনৈতিক ঐকমত্য স্থাপিত হবে? যদি না হয় তাহলে তার পরিণতি কী হবে? ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আরেকটি নির্বাচন? যদি সেরকম নির্বাচন করেও ফেলা যায়, এরপর দেশের পরিস্থিতি কী হবে, জনমনে এরকম অনেক প্রশ্ন আছে। 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু ‘নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার’। গণতান্ত্রিক দেশে সরকার মানেই একটা দলীয় সিস্টেম। অথচ আমরা বলছি ‘নির্দলীয় সরকার’। অতএব আপাতদৃষ্টি ও যুক্তিতে এটি একটি অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি, যে পদ্ধতিটি ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল গণতন্ত্রের স্বার্থে। অর্থাৎ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার হচ্ছে গণতন্ত্রের স্বার্থে একটি অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি, যে পদ্ধতির ব্যাপারে সকল দলের মধ্যে ঐক্য ছিল। কিন্তু ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই পদ্ধতিটি বাতিল করে দিলে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব এসে পড়ে ক্ষমতাসীন দলের ওপর। অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন বলা হলেও এবং নির্বাচন চলাকালে নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব বলা হলেও কার্যত বিদ্যমান ব্যবস্থায় মাঠ প্রশাসন যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকে, অতএব নির্বাচনের সময় মাঠ প্রশাসন পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকে না, থাকতে পারে না, সেটি অতীতে বিভিন্ন সময়ে প্রমাণ হয়েছে। 

আবার নির্বাচন কমিশনে যারা দায়িত্ব পালন করেন, তারাও দলীয় সরকারের অধীনে কতটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, সেটি নিয়েও যেহেতু জনমনে সংশয় রয়েছে, সেসব কারণেও নির্বাচনের সময় একটা নির্দলীয় সরকারের পক্ষে জনমত প্রবল। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল বারবারই বলছে যে, তারা সংবিধানের বাইরে যাবে না। অর্থাৎ এখন যারা সরকারে আছে, এখন যিনি প্রধানমন্ত্রী, তার অধীনেই নির্বাচন হবে। কিন্তু মাঠের রাজনীতিতে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি এবং শরিকদের প্রধান আপত্তি এই জায়গাটিতেই। দুপক্ষই ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’ অবস্থায়। যে কারণে সংবিধানের মধ্যে থেকেই এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় কি না যাতে একটি অবাধ-সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ-অংশগ্রহণমূলক এবং সর্বোপরি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে। যে আলোচনাটি ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও এসেছিল। 

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে রুলস অব বিজনেস সংশোধন করে কিংবা রুলস অব বিজনেসের মধ্যে থেকে রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা খর্ব করে একটি বিকল্প মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব উঠেছিল। সংবিধানের পাশাপাশি সরকারের কার্যপ্রণালি বিধি বা রুলস অব বিজনেসেও সরকার পরিচালনায় যেহেতু প্রধানমন্ত্রীকে একক ক্ষমতা দেওয়া আছে, তাই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর এই একক কর্তৃত্ব খর্ব করলে সমস্যা সমাধানের দরজা খুলে যাবে বলে তখন নাগরিক সমাজের কেউ কেউ মত দিয়েছিলেন। 

অর্থনীতিবিদ এবং প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ড. আকবর আলি খান বলেছিলেন, সংবিধান অনুযায়ী রুলস অব বিজনেস প্রণয়ন করা হয়েছে। সে অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সরকার পরিচালনা করেন। রুলস অব বিজনেসে সাতটি শিডিউল রয়েছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন বিষয়গুলো রয়েছে পাঁচ নম্বর শিডিউলে। এখানে বলা হয়েছে, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত কিছু বিষয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে থাকবে। এসব মন্ত্রণালয়ের কোন কোন কাজ প্রধানমন্ত্রী দেখভাল করবেন, তাও রুলস অব বিজনেসে উল্লেখ করা হয়েছে। এ মন্ত্রণালয়গুলো ছাড়াও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ এবং সব মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে রাখা হয়েছে। সুতরাং তিনি যদি স্বেচ্ছায় এরকম গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দেখভালের দায়িত্ব ছেড়ে দেন, তাহলে কারও কিছু বলার থাকবে না। আর এই সুযোগে এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নতুন কাউকে দেওয়া হলে তিনি রুলস অব বিজনেসে উল্লেখিত দায়িত্ব পালন করবেন। এতে জনপ্রশাসনে ভারসাম্য তৈরির একটা সুযোগ হবে। তবে রুলস অব বিজনেস সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করা হলে সেটি সংবিধানবিরোধী হবে কি না, সেটিও তখন আলোচনায় আসে। তার পরও রুলস অব বিজনেস পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব খর্ব করা গেলে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার দরজা খুলতে পারে বলে তখন মত দিয়েছিলেন আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকও। (কালের কণ্ঠ, ১১ ডিসেম্বর ২০১৩)।

সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য, সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক আবু সাইয়িদও মনে করেন, সংবিধান সংশোধন না করেই এবং রুলস অব বিজনেসের মধ্যে থেকেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। তার মতে, আমাদের সংসদ নেতা অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী যেমন আছেন, তেমনি সংসদ উপনেতাও আছেন। দুজনই নির্বাচিত। সংসদ নেতার অবর্তমানে সংসদ উপনেতার কার্যক্রম সুস্পষ্ট ভাষায় লিখিত আছে। প্রথমে সংসদ নেতা সংসদ উপনেতার নিকট প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার হস্তান্তর করবেন। ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী দেশের সৎ, বিবেকবান ও দক্ষ ব্যক্তিদের মধ্য থেকে সরকারি জোট ও বিরোধী জোটের সম্মতিতে প্রয়োজনীয় উপদেষ্টা নিয়োগ দেবেন। নির্বাচনকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা পরিষদে সভাপতিত্ব করবেন। শুধু রুটিন ওয়ার্ক করবেন। উপদেষ্টাগণ সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। (বাংলাদেশে প্রতিদিন, ১১ জুলাই ২০২৩)। 

এই পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে গেলে সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রয়োজন নেই এবং আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু যদি সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় তাহলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এখানে কিছুটা জটিলতা আছে। কেননা মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আগের সংসদ সদস্যরা বহাল থাকবেন। তাতে কিছুদিনের জন্য দেশের সংসদ সদস্যের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬০০ জনে। এটি একটি জটিলতা। আবার যদি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় তাহলে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত সরকারে কারা থাকবেন; রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী সংসদ উপনেতার নেতৃত্বেও যদি নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয় তাহলে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি আর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন কি না, সেই প্রশ্নটিও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেননা সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদ ভেঙে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিধিত্বের অবসান হয়। সংবিধানের মধ্যে থেকে এরও কি একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করা সম্ভব? হয়তো সম্ভব যদি রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকে।   

বর্তমান সংসদের মেয়াদ আছে আগামী ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। অতএব সংবিধান অনুযায়ী এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। না হলে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরির শঙ্কা থাকবে। তবে সংবিধানে এটিও বলা আছে যে, যদি সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় তাহলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। সে ক্ষেত্রে আগামী জানুয়ারির ২৯ তারিখের মধ্যে নির্বাচন হবে না। না হলেও সংবিধানের ব্যত্যয় হবে না। কারণ ১২৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মতে, কোনো দৈব-দুর্বিপাকের কারণে এই দফার নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হয়, তাহলে উক্ত মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

অতএব ২৯ জানুয়ারির আগে সংসদ ভেঙে দিলে তার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব। অর্থাৎ ২০২৪ এপ্রিল মাসের মধ্যে নির্বাচন করলেও সেটি সংবিধানের ব্যত্যয় হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকলে সেখানে সংবিধান বা আইন কোনো বাধা তৈরি করে না। কেননা আইন ও সংবিধান মানুষের জন্যই। যারা রাষ্ট্রপরিচালনা করেন, তারা যদি মনে করেন যে রাষ্ট্র ও এবং তার জনগণের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে নতুন কোনো ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে কিংবা আইন ও সংবিধানের মধ্যে থেকেই এমনকি কিছুটা ব্যত্যয় হলেও যদি দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়, সেটিই মঙ্গল। সেজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐকমত্য, যেটির অভাব এখন সবচেয়ে বেশি।

সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটির সুরাহা দরকার সেটি হলো, যে পরিস্থিতিতে বা যে কারণে প্রতি পাঁচ বছর পরপর, অর্থাৎ জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে রাষ্ট্রের রুটিন কাজ ও নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থাটি চালু করা হয়েছিল, সেই পরিস্থিতির উত্তরণ করা গেছে কি না? অর্থাৎ নির্দলীয় সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ-সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব বলে সকল রাজনৈতিক দল বিশ্বাস করে কি না? দ্বিতীয়ত, যদি সংবিধানে এরকম একটি অগণতান্ত্রিক বিধান পুনরায় যুক্ত করা সম্ভব না হয়, তাহলে কি ভবিষ্যৎ রাজনীতি ফের সংঘাতের দিকে যাবে? ১৯৯৬ সালে যেরকম পরিস্থিতিতে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধন আনা হয়েছিল, সেরকম পরিস্থিতি তৈরি হবে, নাকি এর বাইরে অন্য কোনো সমাধানও আছে, যেটি দেশের জন্য কল্যাণকর, সেই আলোচনাটি আরও আগেই শুরু করা উচিত ছিল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //