মার্কিন চাপে সহনশীল রাজনীতি?

আগামী ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে বিএনপির কর্মসূচির কারণে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়া হবে কি না, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে সেটি জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, গণমাধ্যমে এরকম একটি খবর প্রকাশ হলে সেটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানারকম প্রতিক্রিয়া হয়। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই প্রশ্নের মধ্যে এমন কয়েকটি ইঙ্গিত রয়েছে, যা একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ বিনির্মাণের পথে বিরাট অন্তরায়। 

তার এই প্রশ্নের অর্থ হলো-
১. এর আগে বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে সারা দেশ থেকে যাতে নেতাকর্মী ও সমর্থকরা আসতে না পারেন, সেজন্য রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। 
২. বাস মালিকরা বিভিন্ন অজুহাতে ধর্মঘট ডেকেছেন।
৩. নিরাপত্তার কথা বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রতিটি গাড়ি তল্লাশি চালিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হয়রানি করেছে, এমনকি অসংখ্য মানুষের মোবাইল ফোনের এসএমএস ও ফটো গ্যালারি চেক করেছে, এমন সংবাদও গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। 

এসব বাস্তবতা মাথায় নিয়েই হয়তো পিটার হাস আগামী ২৮ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় বিএনপির সমাবেশে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়া হবে কি না, এমন প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু এই প্রশ্নটি কি বাংলাদেশ সরকারের জন্য এবং ক্ষমতাসীন দলের জন্য মোটেও সম্মানজনক? একজন বিদেশিকে এই ধরনের প্রশ্ন করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন? এর জন্য দায়ী কে বা কারা? 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলকে স্পেস না দেওয়ার প্রবণতা বেশ পুরনো। যখনই যে দল ক্ষমতায় থেকেছে, তারা বিরোধী দলের কর্মসূচি ভণ্ডুল করা তো বটেই, পুরোপুরি প্রান্তিক করে দেওয়া, এমনকি নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টাও করেছে। যে কারণে বাংলাদেশে একটি সহনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ এখনো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ফলে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা বিদেশিদের চাপে কি সহনশীল রাজনীতির সূচনা হবে? কেননা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আসা-যাওয়া বন্ধ কেন করব? ঢাকায় তো সবারই প্রয়োজন, রোগীর ঢাকা আসা প্রয়োজন, বিদেশে যেতে হলে ঢাকায় আসা প্রয়োজন, সব কিছু তো ঢাকাকেন্দ্রিক। কাজেই আসা-যাওয়া বন্ধ করার কোনো প্রশ্নই আসে না।’ 

মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে, সমাবেশ উপলক্ষে বিএনপির নেতা-কর্মীরা আসবেন, তারা যাবেন, সেখানে সরকার কোনো বাধা দেবে না এবং এরকম কোনো চিন্তাও করছে না। তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু এটুকুই বলব, তারা যেন কোনো সহিংসতায় লিপ্ত না হয়, রাস্তাঘাট বন্ধ না করে, চলাচলের জায়গা যেন তারা সচল রাখে। এটুকুই আমাদের অনুরোধ, সেটা তাকেও (রাষ্ট্রদূত) জানিয়ে দিয়েছি।’

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ওই প্রশ্নের মধ্যে আরও দুয়েকটি ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র চায় ২৮ অক্টোবর বিএনপি সরকারের বাধা ছাড়া নির্বিঘ্নে একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করুক এবং সেটি সফল হোক। তাতে অনেকের মনে হতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্র কি তাহলে বিএনপির পক্ষে দূতিয়ালি করছে বা বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে চায়? এই অভিযোগ অবশ্য ক্ষমতাসীন দলের তরফে অসংখ্যবার করা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র চায় না আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক। 

তবে যুক্তরাষ্ট্র চাক বা না চাক, বাংলাদেশের মানুষ অন্তত একুটু চায় যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় যারাই থাকুক তারা নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করবে; নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করবে; বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ ঠিক রেখে কল-কারখানার উৎপাদন সচল রাখবে; প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে অর্থনীতির যাবতীয় কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে; দেশের টাকা যাতে পাচার না হয় এবং উন্নয়ন কাজের টাকা যাতে লুটপাট হয়ে না যায়, তার ব্যবস্থা করবে; সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয় মানুষ যাতে কোনো ধরনের হয়রানি ছাড়াই কাক্সিক্ষত সেবা পায়, সেটি নিশ্চিত করা এবং সর্বোপরি এমন একটি সহনশীল পরিবেশ বজায় রাখা যেখানে সরকারের গঠনমূলক তথা যুক্তিপূর্ণ সমালোচনাকে উৎসাহ দেওয়া হয়, এরকম একটি সহনশীল পরিবেশ গড়ে তুলবে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটছে, সেটি সকলের জানা। জানা বলেই বিদেশিরা এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে।

রাজনীতিবিদরা নিজেরা নিজেদের সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হয়েছেন, অসহনশীল আচরণ করেছেন বলেই এখন বিদেশিরা সহনশীলতার সবক দিচ্ছে। কিন্তু তারপরও কি রাজনীতি, বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্মসূচি সহনশীল হবে? 

দেখা যাক ২৮ তারিখের কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি কী বলছে? দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির ‘মহাসমাবেশ’ থেকে ‘সড়কে বসে পড়ার’ মতো কোনো কর্মসূচি আসছে না। বরং শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ হবে। এরপর যার যার মতো করে চলে যাবেন। সেদিন ‘বড়’ কোনো কর্মসূচিও আসছে না। তা ঘোষণা হবে পরে। তিনি বলেন, ‘২৮ তারিখ আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের নিশ্চয়তা দিচ্ছি।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশিদও বলেছেন, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে কোনো নাশকতার আশঙ্কা নেই। তবে পুলিশের চেকপোস্ট ও অভিযান অব্যাহত থাকবে। চেকপোস্ট বসানো পুলিশের রুটিন কাজ। পাশাপাশি আদালতের পরোয়ানাভুক্ত আসামি গ্রেপ্তারের কাজও নিয়মিত চলবে।

তার বক্তব্যে দুটি ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন ২৮ তারিখ ঢাকায় নাশকতার আশঙ্কা নেই এবং পুলিশের অভিযান অব্যাহত থাকবে। অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, বড় কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির আগে পুলিশের অভিযান বেড়ে যায় এবং তাতে মূলত বিরোধী দলের নেতাকর্মীদেরই গণহারে গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়। অনেক পুরনো এবং বিশ্বাসযোগ্য নয় এমন অভিযোগে দায়ের করা মামলায়ও তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়, যাতে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যাতে তারা কর্মসূচিতে আসতে ভয় পান। ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচি ঘোষণা করার পরও বিএনপির অনেক নেতাকে গ্রেপ্তারের খবর গণমাধ্যমে এসেছে।

এবার ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের বক্তব্যটিও ডিবি প্রধানের বক্তব্যের সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করা যাক। তিনি বলেছেন, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বিএনপির কর্মসূচির আড়ালে কেউ সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করলে কঠোর হাতে দমন করা হবে।

বিএনপি কিংবা সরকারবিরোধী অন্য যে কোনো দল ও সংগঠনের কর্মসূচিতে পুলিশের ভূমিকা কী ছিল, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন নেই। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোন এবং তাতে ইন্টারনেট সংযুক্ত। ফলে মূলধারার গণমাধ্যম অনেক খবর ও ছবি এড়িয়ে গেলেও সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে সেটি আর গোপন থাকে না। কোনো না কোনোভাবে মানুষ জেনে যায়। অতএব ২৮ তারিখ বিএনপির কর্মসূচিতেও পুলিশের ভূমিকা কী হবে সেটি কিছুটা আন্দাজ করা গেলেও এবার হয়তো সেখানে কিছুটা বাগড়া দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের চাপে হয়তো পুলিশ কিছুটা নমনীয় থাকবে। 

আবার এটিও ঠিক যে, বিএনপির সমাবেশ থেকে অতি উৎসাহী নেতাকর্মীরা যদি সত্যিই অতি বিপ্লবী কিছু করে বসেন বা সত্যিই যদি নাশকতা ঘটানো হয়, সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চয়ই নীরব হয়ে বসে থাকবে না। কিন্তু যে প্রশ্নটি জনমনে আছে তা হলো, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি আদৌ দলনিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকতে পারছে? যদি না পারে তাহলে সেটি দেশের জন্য একটি বিরাট অশনি সংকেত। 

মোদ্দা কথা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের চাপে কিংবা যে কারণেই হোক, ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে দেশ বড় কোনো সংকটে পড়বে না, এটিই নাগরিকদের প্রত্যাশা। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণে বিএনপির নিজের যেমন দায় আছে, তেমনি ক্ষমতাসীন দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও দায় আছে। প্রত্যেকে দায়িত্বপূর্ণ ও সহনশীল আচরণ করলেই কেবল দেশকে বাঁচানো সম্ভব। 

রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে আচরণই করুক না কেন, জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় বেতন নেওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দলনিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকতে হয়। তারাও যদি দলীয় কর্মীর মতো কথা বলেন, আচরণ করেন, সেটি দেশের ভেতরে তো বটেই, দেশের বাইরেও ভুল বার্তা পৌঁছে দেয়। আর এসব কারণেই একজন বিদেশি কূটনীতিক খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এই প্রশ্ন করার সাহস পান যে, ‘বিএনপির কর্মসূচির কারণে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়া হবে কি না।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //