হামাস কেন ঝুঁকি নিল

আল আকসা মসজিদে হামলা এবং অবৈধ বসতি স্থাপনের জবাব দিতে গিয়ে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভেতরে বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে প্রায় ৫ হাজার রকেট ছুড়েছে। অনবচ্ছিন্নভাবে অসংখ্য রকেট ছোড়ার কারণ ছিল ইসরায়েলকে বিভ্রান্ত করা; বিভ্রান্তের সুযোগ নিয়ে হামাসের যোদ্ধারা সুরক্ষিত সীমান্ত বেড়া ডিঙিয়ে গাজা উপত্যকার কাছাকাছি ইসরায়েলি বসতিগুলোতে ঢুকে অতর্কিত হামলা চালায়।

ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, হামাসের যোদ্ধারা ইসরায়েলের উন্মুক্ত স্থানে একটি সঙ্গীত উৎসবে অংশ নেওয়া শত শত মানুষের ওপর হামলা চালাচ্ছে, কিছু লোককে জোরপূর্বক গাড়িতে তুলছে। ইসরায়েলের উদ্ধারকর্মীরা এই স্থান থেকে ২৬০ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে। ইসরায়েলের অভিযোগ হচ্ছে, হামাসেরা অনেক ইসরায়েলিকে জবাইও করেছে। ইসরায়েলের নিরীহ বেসামরিক লোকদের উপর হামাসের আক্রমণ ও তাদের জিম্মি করাকে পশ্চিমা বিশ্ব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলে গণ্য করছে। কিন্তু এই ভূখণ্ডের নারী-শিশুসহ নিরপরাধ মানুষ হত্যার খবর নতুন নয়, ইসরায়েলি সেনার গুলিতে ফিলিস্তিনিদের খুন হওয়ার সংবাদ শুনতে শুনতে আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। অবরুদ্ধ গাজার বাসিন্দা হামাসের এক হাজার যোদ্ধা কীভাবে ইসরায়েলের সার্বক্ষণিক নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে এই আক্রমণ চালাল তা বিশ্ববাসীর নিকট অবিশ্বাস্য।

দ্বিতীয়ত গাজার এক চিলতে ভূখণ্ডের মধ্যে হামাসেরা ইসরায়েল এবং মিশর দ্বারা অবরুদ্ধ, দুটি দেশই তাদের চলাফেরায় নজরদারি করে থাকে। এই অবস্থায় এমন অতর্কিত আক্রমণে ইসরায়েলও হতভম্ব, হতভম্ব বলেই তাদের প্রতিঘাত শুরু করতে একটু বিলম্ব হয়েছে। অন্যান্যবারের মতো শুধু বিমান হামলা করে ইসরায়েল থামবে বলে মনে হয় না, ভেতরে ঢুকতে পারে। গাজার উত্তর থেকে দক্ষিণে সরে যাওয়ার ইসরায়েলের নির্দেশ গাজাবাসী মানেনি, গাজার ফিলিস্তিনিরা অবধারিত মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছে। ইসরায়েলি সেনারা এখনো গাজায় ঢোকেনি; বিমান ও ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালিয়ে সব ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাদের নির্বিচার আক্রমণে হাসপাতালও রক্ষা পাচ্ছে না, হাসপাতালের ওপর ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ৫০০ ফিলিস্তিনি মারা গেছে, শত শত লোক দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে আছে। কবর দেওয়ার জায়গা নেই, বোমার আঘাতে কবরস্থানও ধ্বংস হয়ে গেছে। 

সীমান্তে তিন লক্ষ সৈন্য সমাবেশ করেও ইসরায়েলের স্থলযুদ্ধে না জড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। হামাসের শক্তি খর্ব না করে গাজায় ঢুকলে হামাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ অনিবার্য, ইসরায়েলের সেনারা ভয়ঙ্কর প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে, কারণ গাজার সর্বত্র হামাসের সুড়ঙ্গ প্রতিরক্ষা ব্যূহ রয়েছে। তাই ইসরায়েল প্রথমে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে হামাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ভেতরে না ঢোকার আরেকটি কারণ হচ্ছে তাদের বন্দিদের অবস্থান নির্ভুলভাবে শনাক্ত করতে না পারা। আরও একটি কারণ আছে এবং তা হচ্ছে ইসরায়েলি সেনার স্থল অভিযানের পক্ষে আমেরিকার সবুজ সঙ্কেত নেই; কারণ আমেরিকা চায় না, ইসরায়েল গাজা দখল করুক। ইসরায়েল গাজা দখল করলে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর উপর আমেরিকার প্রভাব মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে।

তাই বলে ইসরায়েল এখনই থামবে না, গাজায় হামাসের ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গগুলো ধ্বংস করাসহ তাদের পুনরায় আঘাত করার সক্ষমতা চূর্ণ করে দেবে। ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন জরুরি সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হামাসকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, ‘প্রতিটি হামাস সদস্য এখন একজন মৃত মানুষ।’ 

গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনিরা বিদ্যুৎ,পানি এবং জ্বালানির জন্য ইসরায়েলের ওপর নির্ভরশীল, ইসরায়েল সব বন্ধ করে দিয়েছে। আমেরিকা পূর্বের মতো এবারও ইসরায়েলের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, হামাস যাতে অন্য কোনো দেশ থেকে সহায়তা না পায় তা নিশ্চিত করতে ভূমধ্যসাগরে আমেরিকা এবং ব্রিটেনের যুদ্ধজাহাজ ও জঙ্গি বিমান টহল দিচ্ছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ইসরায়েলে গিয়ে তাদের সাহস জোগাচ্ছেন, পাশে থাকার নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসলিম দেশগুলোতে গিয়ে তাদের শান্ত রাখার চেষ্টা করেছেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিসহ ইউরোপের সকল নেতা ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে, ইসরায়েলকে সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস দিচ্ছেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে হামাসের কর্মকাণ্ডের নিন্দা প্রস্তাবে রাশিয়া ভেটো দিয়েছে।

রাশিয়া এবং চীন নিরপেক্ষ ভূমিকা নিলেও উভয় দেশ স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ান হামাসের হামলার জবাবে ইসরায়েলের মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগকে গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করছেন, তিনি যুদ্ধ থামাতে মধ্যস্থতার প্রস্তাবও দিয়েছেন। তুরস্ক ইসরায়েলের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক সব সময় জিইয়ে রেখেছে, ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য কখনো বন্ধ ছিল না। ইসরায়েলের সঙ্গে জর্ডানেরও কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, ইসরায়েলের প্রতি তাদের নমনীয় মনোভাব সব সময় ছিল। পার্শ্ববর্তী দেশ সিরিয়ায় এখনো গৃহযুদ্ধ চলছে, তাই ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করার শক্তি সিরিয়ার নেই। দুদিন আগেও ইসরায়েল সিরিয়ার অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালিয়েছে, প্রয়োজন হলেই চালাবে। সিরিয়া প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে ইসরায়েলের সীমান্ত নেই, তাই হামাসের পক্ষে তাদের যুদ্ধ করার বাসনা শুধু বাসনাই।

সৌদি আরব যুদ্ধ থামাতে আমেরিকা ও ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। উত্তর কোরিয়া বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আমেরিকা এবং ইসরায়েলকে দায়ী করেছে। এতদিন পর্যন্ত ভারত ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরোধিতা এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন জানালেও এইবার প্রথম হামাসের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা করে ইসরায়েলের প্রতি সংহতি জানিয়েছে। অবশ্য ইসরায়েলের বিমান হামলা শুরু হলে ভারত তাদের অবস্থানের পরিবর্তন করেছে, পরে স্বাধীন সার্বভৌম ও টেকসই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়ার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে। 

বাংলাদেশ সব সময় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে; ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ইসরায়েলের স্বীকৃতি প্রদানের তীব্র বাসনাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। একই ধারায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গাজায় ইসরায়েলের বর্বর হামলার তীব্র নিন্দা করে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন এবং গাজায় ওষুধ পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। বিএনপি নীরব, কারণ তারা আমেরিকার মিত্র, তাই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার ও স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছে। শিয়া মুসলিমদের নিয়ে গঠিত লেবাননের হেজবুল্লাহ হামাসের পক্ষে ইসরায়েলে রকেট নিক্ষেপ করতে পারে, এরা ২০০৬ সালেও ৩৪ দিন যুদ্ধ করেছে ইসরায়েলের সঙ্গে। ইয়েমেনের হুতিরাও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার ঘোষণা দিয়েছে; কিন্তু তারা নিজেরাই গৃহযুদ্ধে লিপ্ত, সৌদি আরব হুতি সম্প্রদায়ের ওপর বহুবার বিমান হামলা চালিয়েছে। হুতিদের হাতেও পর্যাপ্ত অস্ত্র নেই। ইরান থেকে তাদের জন্য পাঠানো অস্ত্র আমেরিকা আটক করে নিজ দেশে নিয়ে গেছে, সেই অস্ত্র আমেরিকা এখন ইউক্রেনকে দিচ্ছে। লেবাননের হেজবুল্লাহ আর ইয়েমেনের হুতিরা তাদের নিজ নিজ দেশ থেকে কিছু রকেট ছুড়ে যুদ্ধের গতি বদলাতে পারবে না। হামাসকে সমর্থন করে ল্যাটিন আমেরিকার দেশ কলম্বিয়া নজির স্থাপন করেছে, তারা ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে। কলম্বিয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের নৃশংস বোমা হামলাকে ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যায়িত করেছে।

৫৭টি মুসলিম দেশের মধ্যে একমাত্র ইরানই হামাসের অকৃত্রিম বন্ধু। কিন্তু তারা যুদ্ধে জড়াবে বলে মনে হয় না। কোনো মুসলিম দেশ হামাসের হয়ে যুদ্ধ করবে না, এমনকি পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষও নয়। অবশ্য ইসরায়েলের সঙ্গে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের যুদ্ধ করার সক্ষমতা একেবারেই নেই। ইরাকে মোকতাদা আল-সদরের নেতৃত্বে মুসলমানদের বৃহত্তর গণজমায়েত হয়েছে, অন্যান্য মুসলিম দেশেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণজমায়েত হচ্ছে। শুধু গণজমায়েত নয়, প্রতি ওয়াক্ত নামাজে বিশ্বের মুসলিমরা ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য দোয়াও করছে। কিন্তু এই গণজমায়েত ও দোয়া ১৯৪৮ সাল থেকে বিগত ৭৫ বছরে ফিলিস্তিনিদের মুক্তি আনতে পারেনি। গাজায় ইসরায়েলের লাগাতার পাল্টা হামলার ঘটনায় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আমেরিকার ইহুদিরাও বিক্ষোভ করছে, এমনকি ক্যাপিটল হিলে ঢুকে তারা ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদও করেছে। গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের করুণ অবস্থায় খাবার ও চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে শতাধিক ট্রাক-লরি মিশর সীমান্তে অপেক্ষা করছে। জো বাইডেনের সম্মানে মাত্র ২০টি ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সারা বিশ্ব ইসরায়েলের দয়া ভিক্ষা করছে, ইসরায়েল তোয়াক্কা করছে না। যখন ইসরায়েল অনুমতি দেবে তখন ট্রাক-লরি মানবিক সাহায্য নিয়ে গাজায় ঢুকবে। এভাবে অবরুদ্ধ থাকলে গাজার ফিলিস্তিনরা পানি, বিদ্যুৎ, খাবার ও চিকিৎসার অভাবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। 

হামাস কেন জেনেশুনে জীবনের এমন ঝুঁকি নিল? আসলে নতুন করে তাদের হারানোর কিছুই নেই, মুসলিম দেশগুলো ক্রমান্বয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করছে, ইসরায়েল প্রতিনিয়ত বসতি স্থাপন করে তাদের পরিধি বাড়াচ্ছে। এছাড়াও ১৯৯৩ সালে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ গঠনের ৫ বছরের মধ্যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ৩০ বছরেও হয়নি। ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের পূর্বের অবস্থানে ফেরত যেতে নারাজ, হামাসও তাই জীবন দিয়ে মাঝে মাঝে তাদের অস্তিত্বের ঘোষণা দিয়ে থাকে, ইসরায়েলের বুকে মরণ কামড় বসায়। ইসরায়েলের সামরিক আক্রমণ তাদের সকল শক্তি সাময়িকভাবে বিধ্বস্ত করতে পারলেও তাদের পুরো শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না, ফিনিক্স পাখির মতো ছাই থেকে উত্থিত হবে, ফিলিস্তিন যুবকেরা, নিজ মাতৃভূমির জন্য জীবন উৎসর্গ করতে আরও জোরালোভাবে উদ্বুদ্ধ হবে।

লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //