ইনফ্লেশনের হাত ধরে আসে শ্রিংকফ্লেশন

যে ব্র্যান্ডের বিস্কুট আমরা দীর্ঘদিন ধরে খাচ্ছি, সেদিন তার প্যাকেট খুলতেই মনে হলো বিস্কুটগুলো আকারে ছোট, ছাঁচ মনে হয় বদলে ফেলা হয়েছে। ভেতরে যে একটা শক্ত প্লাস্টিকের ফয়েল থাকে, ওটাকে ঠিক রেখে বিস্কুটের সাইজ বদলে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিস্কুট পরিমাণে কমে গেছে। এক সময়ে একটা স্লোগানের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম যে, ছোট প্যাকেট বড় ধামাকা। আর এখন আমরা দেখছি বড় প্যাকেটের ছোট ছোট হতাশা! টাকার ইনফ্লেশনের সময়কালে নিত্যপণ্যের বাজার মানেই হতাশা। প্রতিনিয়ত জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, কিন্তু তার লাগাম টেনে ধরার উপায় নেই। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য এমন বেড়েছে যে সরকার নির্দিষ্ট দাম বেঁধে দিলেও বাজারে তার প্রভাব পড়ছে না।

উপরন্তু যেসব পণ্যের দাম কাগজে-কলমে সেভাবে বাড়েনি তা পরিমাণে কমে গেছে। বিরিয়ানির প্যাকেট ছোট হয়েছে। ভেতরে মাংসের পরিমাণ কমে গেছে। শিঙাড়া, পুরি, পিঁয়াজু বা সমুচা, কোনোটাই আর আগের আকৃতিতে নেই। বর্তমান আকার দেখলে মনে হবে, হঠাৎ করে লিলিপুটের দুনিয়ায় ঢুকে পড়েছি। কেকের প্যাকেট ঠিক থাকলেও ঠিক নেই কেকের সাইজ। ৩০ টাকার কোল্ড ড্রিংক ৫০ টাকায় ঠেকলেও তা দৃশ্যমান আছে। কিন্তু অদৃশ্য বস্তুগুলো যে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারছে না, তার কুফল পড়ছে ভোক্তার ওপর। বেচারারা না জেনেই একই দামে অর্ধেক পণ্য কিনছে। না ভরছে পেট, না মিটছে পুষ্টির চাহিদা। এক সময় ১০ টাকার চিপসের প্যাকেটে থাকত ২৫ গ্রাম চিপস। সেই পরিমাণ কমে আসে ২২ গ্রামে, আর এখন তা মাত্র ১৫ গ্রামে ঠেকেছে। অথচ প্রতি প্যাকেটের দাম একই আছে। ১০ টাকা দামের মিল্ক পাউডার মিনি প্যাকে থাকত ১৮ গ্রাম, যা এখন মাত্র ১০ গ্রাম। এছাড়াও আগে ১০ টাকা দামের চানাচুরের প্যাকেটে থাকত ৩৫ গ্রাম, যা এখন মাত্র ২৫ গ্রাম; এবং আগে ১০ টাকা দামের বিস্কুটে থাকত ৫৫ গ্রাম, যা এখন মাত্র ৩৯ গ্রাম।

এভাবে বাজারের সব বড় বড় ব্র্যান্ডেরই বিভিন্ন পণ্যের পরিমাণ ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, অথচ মূল্য রয়েছে আগের মতোই।

স্টেশনারি পণ্য বা সাবান শ্যম্পু, তেলের মতো পণ্যেরও একই অবস্থা। কিন্তু কেনইবা এমন অদৃশ্য পরিবর্তন? ব্যবসায়িক পরিভাষায় এভাবে কোনো পণ্যের পূর্বের দাম অপরিবর্তিত রেখে পণ্যের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার চর্চাকে বলা হয় ‘শ্রিংকফ্লেশন’। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বেশ বুদ্ধিদীপ্ত একটি কৌশল মনে করা হয় এটিকে। কারণ আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় দ্রব্যের দাম একই থাকছে। কিন্তু আদতে ওজনের প্রতি এককের দাম ঠিকই বেড়ে যাচ্ছে। এটি এক ধরনের মার্কেটিং কৌশল। যেটি বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দা চলাকালীন ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা এবং কোম্পানির লাভের মাঝে একটি ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যবহৃত হয়।

বলাই বাহুল্য শ্রিংকফ্লেশনের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি পড়ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে দ্বিগুণ খরচ করতে হচ্ছে তাদেরকে। আগে এক প্যাকেটে যে চাহিদা মিটত এখন দুই প্যাকেট কিনতে হয়। সুতরাং দাম ওই দ্বিগুণই দিতে হচ্ছে। আবার কেউ কেউ শ্রিংকফ্লেশনের প্রভাবে প্রায় সব পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এর প্রভাবে অনেকের স্বাস্থ্যেই ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। এই ব্যাপারটা বিশেষভাবে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ও নারীদের জন্য। কেননা তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোর ব্যবহারে হয়তো লাগাম টানতে হবে। সম্প্রতি পত্রিকার এক রিপোর্টে আমরা দেখতে পাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘শ্রিংকফ্লেশনে’র প্রধান শিকার হবেন সেই জনগোষ্ঠী, যাদের মধ্যে শিক্ষার হার বা গণিতের জ্ঞান কম। কারণ প্যাকেটপ্রতি কোনো পণ্যের পরিমাণ কমে গেলেও সেটি এরকম লোকদের নজরে পড়বে না। অবশ্য, পরিমাণ কমের ব্যাপারটি প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকলেও যা হয়তো তারা কখনো খেয়াল করেন না। অথচ সরাসরি পকেট থেকে বেশি টাকা বের করতে হলে ব্যাপারটি অবশ্যই তাদেরকে ধাক্কা দিত।

এমনকি খুব উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরাও তো এই বিষয়টি বুঝতে হিমশিম খায় যে, কেজিপ্রতি পণ্যের ক্ষেত্রে, পরিমাণের সামান্য হ্রাসও, মূল্যের অনেকখানি বৃদ্ধির সমানুপাতিক। উদাহরণস্বরূপ, দাম আগের মতো রেখে কোনো পণ্যের পরিমাণ ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া মানে হলো প্রতি ইউনিটে ওই পণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া, কিংবা দাম ১০০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার সমান। আরও সহজভাবে বলা যায়, কোনো পণ্যের পরিমাণ ১০০ শতাংশ হ্রাস পাওয়া ওই পণ্যের দাম ১০০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ। কারণ একটি পণ্যের পরিমাণ ১০০ শতাংশ কমে গেলে তো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না!

তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের অবকাশ থাকে, শ্রিংকফ্লেশন ক্রেতাদেরকে একভাবে ধোঁকা দেওয়া কি না, বিশেষত যখন ক্রেতারা সরল মনেই আগের দামে একটি পণ্য কিনে ভাবছে, তারা পরিমাণও আগের মতোই পাচ্ছে। যদিও একে সবক্ষেত্রে ধোঁকা ভাবারও অবকাশ নেই, যেখানে পণ্যের গায়ে তার পরিমাণ উল্লেখ থাকে। ক্রেতা ধোঁকা যা খাচ্ছে তা মূলত ইনফ্লেশনের ধাক্কা, শ্রিংকফ্লেশন তাকে ভোগাবে যদি না ইনফ্লেশন কমে যাওয়ার পরও পণ্যের পরিমাণে কোনো পরিবর্তন না ঘটে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //