রিয়ালপলিটিক, ভারতের বৈশ্বিক শক্তির মহড়া এবং কানাডার সাথে সম্পর্কের টানাপড়েন

এটি কেউ মানুক বা না মানুক ভারত এখন শুধু এশিয়াতে নয়, আন্তর্জাতিক অর্থাৎ বৈশ্বিক রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। বিজেপির অনেক সমালোচনার পরও বলতে হবে, ভারতকে এই শক্তির উচ্চসীমায় পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্বটা মূলত তারই। আর ক্ষমতায় আসার পরপরই বিজেপি শুধু ভারতের সামরিক শক্তি নয়, তার কূটনৈতিক সক্ষমতা, আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কিং, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর উন্নয়ন এবং সেই সাথে আকাশ প্রযুক্তিতেও গভীর মনোনিবেশ করেছে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কৌশল ও নীতিতেও সে বড় রকম পরিবর্তন এনেছে। কংগ্রেস আমলের শুধু রাশিয়ার সাথে তার একাত্মতার নীতি কিংবা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন থেকেও সে সরে এসেছে। সম্প্রতি ভারতের চন্দ্রাভিযান বিশ্বে নানা আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে। এই বছরই ২৩ আগস্ট ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন বা ‘ইসরো’র প্রধান শ্রীধারা পানিকার সোমনাথ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে তাদের স্পেস শাটল চন্দ্রযান-৩-এর সফল অবতরণ নিশ্চিত করেছে, যে জায়গায় ইতিপূর্বে কোনো দেশ তাদের রণতরী নামাতে সমর্থ হয়নি। চীনের প্রথম সফল চন্দ্রাভিযানের প্রধান বিজ্ঞানী ওইয়াং জিয়ুয়ান দাবি করেছেন যে, চন্দ্রযান-৩ চাঁদের দক্ষিণ মেরু থেকে প্রায় ৬১৯ কিলোমিটার দূরে অবতরণ করেছে। তারপরও এটি যে একটি সফল চন্দ্রাভিযান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভারতকে খাটো করে দেখে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার কোনো কারণ নেই। 

যে কোনো পরাশক্তি বা হবু পরাশক্তিকে কতকগুলো অবাঞ্ছিত ও অনাকাক্সিক্ষত কাজ করতে হয়, আর তা করতে হয় তার রাষ্ট্রের স্বার্থে। এই বিষয়টি আমি আলোচনা করতে চাই, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ‘রিয়ালপলিটিক’ ধারণার বশবর্তী হয়ে। রিয়ালপলিটিক আন্তর্জাতিক রাজনীতির রিয়ালিজম বা বাস্তববাদ ঘরানার চিন্তা থেকে উদ্ভূত। সে রাষ্ট্রের স্বার্থে কোনো নীতিনৈতিকতার ধার ধারে না। এতে সে যতটুকু নৈতিকতা মানে, তা হয় তার গোষ্ঠীগত স্বার্থের কারণে, নতুবা প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে, যদি প্রতিপক্ষ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তার চেয়েও বড় খেলোয়াড় হয়। তার ভালোমন্দ শুধু তার স্বীয় রাষ্ট্র ও তার জনগণকে কেন্দ্র করে। বাস্তববাদ মনে করে পৃথিবী নৈরাজ্যময়। মানুষ যতই সভ্যতার দাবি করুক না কেন, এখানে জঙ্গলের আইনই চালু আছে। ফলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সমশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘ব্যালেন্স অব পাওয়ার’ বা শক্তিসাম্যের ধারণা গড়ে উঠেছে মূলত বাস্তববাদকে কেন্দ্র করেই। আর এর আরও নগ্ন রূপ ‘ব্যালেন্স অব টেরর’ বা সন্ত্রাসের ভারসাম্য। অর্থাৎ তুমি আমার ক্ষতি করতে পারো বিধায় এবং আমি তোমার সমান বিধায় আমি তোমাকে কিছু করব না, বা তোমার সাথে শান্তি স্থাপন করব। 

রিয়ালপলিটিকের ধারণা গড়ে উঠেছে মূলত নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির (১৪৬৯-১৫২৭) ‘প্রিন্স’, টমাস হবসের (১৫৮৮-১৬৭৯) ‘ল্যাভিয়াথান’ এবং হান্স জোয়াকিম মর্গেনথ্যুর (১৯০৪-১৯৮০) ‘পলিটিক্স অ্যামাঙ নেশন্স’- এই তিন ক্ল্যাসিককে কেন্দ্র করে। এই তিন তাত্ত্বিকই মনে করেন নীতি ও নৈতিকতা রাজনীতিতে কোনোকালেই কার্যকরী কোনো পরশ পাথর ছিল না। 

এমনকি তথাকথিত ধর্মীয় নীতিনৈতিকতাগুলোও গড়ে উঠেছে এক এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থকে কেন্দ্র করে, অর্থাৎ সর্বজনীন  ও সর্বকালীন কোনো নীতিনৈতিকতা বলে কিছু নেই। তা আছে শুধু কল্পনাবিলাসীদের ভাবজগতে। বাহ্যত একটা রাষ্ট্রের কিছু আদর্শগত জায়গা থাকে, তা ধর্মীয় বা সেক্যুলার ধারা যা-ই হোক না কেন, প্রয়োজনে রাষ্ট্র তা বিসর্জন দিতে কখনোই কুণ্ঠিত নয়, যদিও বাইরে সে তা স্বীকার করতে নারাজ। কখনো কখনো সে তখন ধর্মের আরও সম্প্রসারিত ব্যাখ্যা আমদানি করে তার কাজকে জায়েজ করার জন্য। এমনকি বহুল পরিচিত ধর্মীয় আদর্শবাদগুলোও কোনো কোনো জায়গায় এই বাস্তবতার বাইরে নয়। পরে সেগুলোর নীতিনৈতিকতাগুলোকে সর্বজনীন করার চেষ্টা করা হয়েছে। যে কারণে কয়েক দিন পর পর নতুন ধর্মের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। অথবা একই ধর্মের বহুমুখী ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে; কারণ কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের সব অনুসারীও ধর্মের একই ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারেননি। ফলে সময়ের  সাথে একটি ধর্ম থেকে বহু ধারার সৃষ্টি হয়েছে। এখন রিয়ালপলিটিকের এই যে সম্প্রসারিত  ব্যাখ্যা দিলাম, ইতিহাসে সহজে তা বর্জন করাও সম্ভব হয়নি; কারণ এখন পর্যন্ত এটিই বিশ্বরাজনীতিকে বোঝবার সবচেয়ে কার্যকর তত্ত্ব, যা দিয়ে বিশ্বরাজনীতির মহাকালকেও সামগ্রিকভাবে বোঝা যায়। রিয়ালপলিটিকের আদিগুরু এক অর্থে গ্রিকদেশীয়  সমর বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাসবিদ থুকিডিডেস (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬০-খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০)। উন্নত গ্রিক সভ্যতার কিছুসংখ্যক লোক সেকালেই বুঝতে পেরেছিলেন, ধর্মের ব্যাকরণ মেনে রাজনীতি করতে গেলে বিপদে পড়তে হবে।

বিজেপি ভারতের সঙ্ঘ পরিবারের সদস্য। তার এজেন্ডা হিন্দুত্ববাদকে একটি বিশ্বজনীন শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। তার জায়গা থেকে এই আকাঙ্ক্ষা দোষেরও নয়। রিয়ালপলিটিকের জায়গায় তো নয়ই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রিয়ালপলিটিকে কি আদর্শবাদের কোনোই জায়গা নেই? তা আছে। কারণ আদর্শবাদ এক ধরনের সামাজিক পুঁজি হিসেবে কাজ করে। ওই আদর্শবাদ এক ধরনের ভ্রাতৃসঙ্ঘের সূচনা করে। তাতে তার সভ্যরা তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য লেনদেনের ক্ষেত্রে একটি বিশ্বস্ততার জায়গা খুঁজে পায়। কারণ সমষ্টিগত অবস্থান বা যূথবদ্ধতা ছাড়া মানুষ তো একা তার নিজের স্বার্থও পরিপূরণ করতে পারে না। এ বিষয়টি ভালোমতো বোঝার জন্য একটি কার্যকর বই হচ্ছে জঁ জাক রুশোর ‘সামাজিক চুক্তি’। সমাজের সাথে মানুষের একটি প্রকাশ্য বা অলিখিত চুক্তি থাকার কারণে সে সমাজের রীতিনীতি মেনে চলে, বিনিময়ে সমাজ তার প্রয়োজনগুলো মেটায়। এই নীতি থেকেই আধুনিক রাষ্ট্রের জন্ম। ঔপনিবেশিকতার জন্মও এখান থেকে। কারণ রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে ভাষা, ধর্ম বা সংস্কৃতিনির্ভর বর্গ থেকে। 

বর্গাধীন ব্যক্তি ওই বর্গের বাইরে কাউকে সুবিধা দিতে রাজি নয়। তার কারণও স্পষ্ট। ওই বর্গের সাথে তার বোঝাপড়া ভালো। ফলে তার চুক্তি আদতে ওই বর্গের সাথে। এই চুক্তির কারণে আপনার কাজ হাসিল করতে রাষ্ট্র তার প্রয়োজনীয় আইন অনুযায়ীই সব করবে, আপনাকে আলাদা করে কোনো ব্যক্তির কাছে ধরনা দিতে  হবে না। যদি কোনো রাষ্ট্রে সেটি করতে হয়, তবে বুঝতে হবে চুক্তি কাজ করছে না। সেমতে রাষ্ট্রও কাজ করছে না বলে বিবেচিত হবে। অবশ্যই রাষ্ট্রের কাছে ধরনা দিতে হতে পারে কোনো বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্য, কিন্তু ন্যূনতম নাগরিক অধিকারগুলো পাওয়ার জন্য নয়। যা হোক বিজেপির রিয়ালপলিটিকের আদর্শবাদ হিন্দুত্ব। 

সম্প্রতি ভারত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে একজন শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে হত্যার। তিনি হারদীপ সিং নিজ্জার। এই বছরের ১৮ জুন তাকে হত্যা করা হয়। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও কানাডা সরকারের নানা মাধ্যম এতে সরাসরি ভারতের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উত্থাপন করেছে। এই ঘটনার জের ধরে কানাডা একজন শীর্ষ ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করেন, যিনি র-এর প্রধান পবন কুমার রায়। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারত কানাডার একজন শীর্ষ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। সর্বশেষ ১০ অক্টোবর কানাডা ভারত থেকে তার ৬২ কূটনীতিকের ৪১ জনকেই প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ফলে কানাডার সাথে ভারতের সম্পর্ক এ যাবৎকালে সবচেয়ে করুণ অবস্থায় পৌঁছেছে।

আমরা জানি যে, খালিস্তান (অর্থাৎ পবিত্র স্থান) শব্দটি ১৯৪০ সালে প্রথম উত্থাপন করেন বিদেশে বসবাসরত অর্থাৎ শিখ ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠী একটি শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছে। স্বাধীন ভারতেও এই রাষ্ট্রের দাবি বারবার উত্থাপিত হতে থাকে। একে কেন্দ্র করে অতীতে বহু ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ভারতের বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার ইচ্ছা পূর্ণ করতে হলে তার নিজের রাষ্ট্রীয় অখ-তা টিকিয়ে রাখা জরুরি। এতকাল আমরা জানতাম যে, এক্সট্রাটেরিটোরিয়াল কিলিং শুধু উন্নত পশ্চিমা বিশ্ব করতে পারে। সোভিয়েত জামানায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ ছিল। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে ভারত সেখানে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বিষয়টি মানবাধিকারের দৃষ্টিতে খুবই নিন্দনীয়। কিন্তু যারা এই দোষ তাকে দিচ্ছে, সেই পশ্চিম নিজে তো অহরহ এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তাহলে ভারত কেন নিজের স্বার্থে তা করবে না? আর অন্যদিকে রিয়ালপলিটিকে তো তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কী সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সেই সুরাহা আগেই হয়ে গিয়েছে। কারণ পরাশক্তি হওয়ার ইচ্ছার জায়গায় এটিও একটি সামর্থ্য হিসেবেই বিবেচিত। 

ভারত এই খেলাটি আটঘাট বেঁধেই খেলেছে বোঝা যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে ভারতে। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদসহ নানারকম সমস্যা সমাধানে বহুমুখী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চুক্তিতে তারা ভারতের সাথে আবদ্ধ। এমতাবস্থায় কানাডার পক্ষে ভালোমতো নামার সুযোগ তাদের নেই। কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলি জানিয়েছেন যে, বিষয়টি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাককে অবহিত করা হলেও তারা মন্তব্য করা থেকে বিরত আছেন। কিন্তু কানাডাকে তথ্য সরবরাহকারী ফাইভ আইসের সদস্য এ দুটি দেশও। মনে করা হচ্ছে আরও অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখ নেতা ভারতের হিটলিস্টে আছেন। ভারত বাহ্যত এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। এই ঘটনায় ভারত ও কানাডার বাণিজ্যিক সম্পর্কে বড় প্রভাব পড়েছে। ভারতে কানাডীয় পণ্যের বড় বাজার আছে। অন্যদিকে ভারত কানাডীয় নাগরিকদের অনুপ্রবেশে বাধা দিচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধান এখন নির্ভর করছে ভারত এই খেলাটি কীভাবে খেলতে পারে, তার ওপর। মনে হচ্ছে সে কানাডার সাথে তার বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নয়। 

আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো যা করছে, তা তাদের রিয়েলপলিটিকের অংশ। সমস্যা হচ্ছে, আমরা তৃতীয় বিশ্বের অনেকে ন্যায়নৈতিকতার মামলা দিয়ে রাজনীতি বোঝার চেষ্টা করছি। যে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনকে আমরা নিন্দার্হ মনে করি। তার জুতসই কারণও আছে। কিন্তু প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই বিপদসংকুল পৃথিবীতে আপনি রিয়ালপলিটিককেই বা কীভাবে অস্বীকার করবেন?

লেখক: গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //