বৈশ্বিক উষ্ণতার নেপথ্য কারণ

পৃথিবীর আজ অসুখ হয়েছে- কথাটি খুব পরিচিত শিল্প বা সাহিত্যের আঙ্গিকে, কিন্তু সত্যি আজ আমাদের প্রিয় আবাসভূমি যাকে আমরা পৃথিবী নামক গ্রহ হিসেবে জানি জন্মের পর থেকে সেটি আজ আক্রান্ত নানা রোগ ব্যাধিতে। বেশ জরাজীর্ন অবস্থার দিকে ক্রমশ ধাবিত হচ্ছে প্রিয় গ্রহটি। মজার ব্যাপার হচ্ছে জন্মসূত্রে পৃথিবীর ছিল না কোন অসুখ। আজ যে বিপন্নপ্রায় বিশ্ব আমরা অবলোকন করছি তা কেবল মনুষ্য সৃষ্ট। শতাব্দির পর শতাব্দি জুড়ে মানব সভ্যতার প্রয়োজন আর অপ্রয়োজনে, বিলাসিতার মাসুল দিতে হচ্ছে পৃথিবীকে। আমাদের দরকারেই তাকে অসুস্থ করে ফেলেছি ক্রমাগত আর যেটির অন্যতম উদাহরণ বৈশ্বিক উষ্ণতা। ঘুরে ফিরে এর ক্ষতিকর প্রভাব আমরাই ভোগ করছি। চলতি ও বিগত বছরগুলোয় এই উষ্ণতার তীব্রতা এতটাই বেড়েছে যা কিনা একটি বছর বিগত বছরের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। 

জলবায়ু পরিবর্তন কি?

জলবায়ু পরিবর্তন বলতে বিশ্ব জলবায়ুর উল্লেখযোগ্য দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনকে বোঝায় যা সূর্য, পৃথিবী এবং মহাসাগর, বাতাস, বৃষ্টি , তুষার, বন, মরুভূমি সবকিছুর সাথে সংযুক্ত একটি ইকো সিস্টেম। একটি স্থানের জলবায়ু নির্ধারিত হয় সে অঞ্চলের পুরো বছরের বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার পরিবর্তন ইত্যাদির সাপেক্ষে। আর বর্তমানে জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং মানব সভ্যতার অদূর ভবিষ্যতেই বিনাশের কারণ হতে চলেছে। 

আজ থেকে দেড় হাজার (১৫০০ বছর) বছর আগে দুইটি বিশাল আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে এক বছর পর পর বায়ুমণ্ডলে এত কালো ধূলিকণা স্থাপিত হয়েছিল যে সূর্যালোক পৃথিবীতে প্রবেশে বাঁধাগ্রস্ত হয়ে পড়ায় তাপমাত্রা কমে ফসল উৎপাদনে ব্যর্থতার শিকার হয়েছিল বিশ্ববাসী। সেসময় অনাহারে মারা যায় বহু মানুষ আর যা দিয়েই যাত্রা শুরু ব্ল্যাক ডেথের। 

বর্তমানে পরিলক্ষিত হচ্ছে বিপ্রতীপ পরিস্থিতির। বিশ্বব্যাপী মানুষ মারা যাচ্ছে অতি উষ্ণায়নের ফলে। 

আমরা একটু জেনে আসি এই উষ্ণায়ন নিয়ে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের তিনটি উল্লেখযোগ্য দিক রয়েছে: (১) বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটছে না, তাই জলবায়ু পরিবর্তনও হচ্ছে না; (২) বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে, কিন্তু এগুলো প্রাকৃতিক বা চক্রীয় ঘটনা যা মানুষের কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত নয়; এবং (৩) বৈশ্বিক উষ্ণতা ঘটছে যা মূলত প্রকৃতির ওপর মানুষের নামুখী অত্যাচারের ফলস্বরূপ আর তাই তাই জলবায়ু পরিবর্তনও মানুষের কার্যকলাপের প্রভাব।

গবেষণা বলছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা এবং বায়ুমণ্ডলীয় CO2 মাত্রা অতীতেও কখনও সমহার বা বেশি ছিল কিন্তু বর্তমান সময়ের মত এতটা বিধ্বস্ত অবস্থা দেখেনি মানবজাতি।

সাধারণভাবে, জলবায়ু বিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিদগণ তথ্যের উপর ভিত্তি করে বলছেন, যে দ্রুততার সাথে পৃথিবী উষ্ণ হওয়ার পাশপাশি জলবায়ু পরিবর্তনও হয়েছে, যা পূর্ববর্তী প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর সাথে ঠিক মানানসই নয়। 

দেখা যায়, অন্যান্য নক্ষত্রের তুলনায় সূর্য আসলে খুব স্থিতিশীল। শক্তি উৎপাদনে মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ পরিবর্তিত হয়ে থাকে এটি। আর ১১ থেকে ৫০ বছরের সৌরচক্রের নিয়মে দেখা যাচ্ছে, সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সাথে বিষয়টি সম্পর্কহীন। সূর্যের ক্রিয়াচক্র উষ্ণায়নের জন্য অন্যতম ভূমিকা পালন করলেও একমাত্র মূখ্য ভূমিকা এটিও রাখছে না। বিজ্ঞানীরা বর্তমানে বাতাসে ভেসে বেড়ানো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা যা 'কালো কার্বন' বা ‘ ব্ল্যাক কার্বন’’ নামে পরিচিত সেটিকেই উষ্ণতার জন্য অনেকাংশ দায়ি করছেন। 

গত ১৮ শতক আর ১৯ শতকের প্রারম্ভে জ্বালানি হিসাবে কয়লার যথেচ্ছাচার ব্যবহারকে বিজ্ঞানীরা বর্তমান উষ্ণায়নের বড় একটি প্রভাবক বলে মত জানিয়েছেন। একইসঙ্গে পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন এবং প্রাকৃতিক গ্যাসসহ পেট্রোকেমিক্যাল (প্লাস্টিক, ফার্মাসিউটিক্যালস, সার) নানা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে উষ্ণায়ন। 

গ্রীনহাউস গ্যাস বা GHG

গ্রীনহাউস গ্যাস সম্পর্কে সর্বাধিক সাধারণ এবং সর্বাধিক আলোচিত হল CO2 বা কার্বন ডাই অক্সাইড। প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানীরা এটিকে বায়ুমণ্ডলকে উষ্ণ করে এমন উপাদানগুলোর মানদণ্ড বা পরিমাপ হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন।

মিথেন হলো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ GHG যা উপরের বায়ুমণ্ডলে থাকাকালীন CO2 থেকে ২৮-৩৬ গুণ উষ্ণ হয়ে থাকে। গত ১০০ বছরের আনুমানিক তথ্য মতে USEPA GWP – গ্লোবাল ওয়ার্মিং পটেনশিয়াল বলছে  ১ টন মিথেন = ২৮-৩৬ টন eCO2 বা CO2 সমপরিমাণ।

আমরা জানি কিছু পুড়ে গেলেই CO2 বা কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হয়। আর এটি সবচেয়ে সাধারণ গ্রীন হাউজ গ্যাস যা দীর্ঘমেয়াদী GHG-এর প্রায় ৫৫% ব্যবস্থা দ্বারা গঠিত। 

মিথেন বা CH4, প্যারিয়ানে নাইট্রাস অক্সাইড (লাফিং গ্যাস) এবং NO/N2O বা সহজভাবে NOx যা সার উৎপাদন ও ব্যবহার, অন্যান্য শিল্প প্রক্রিয়া এবং নির্দিষ্ট কিছু পদার্থের দহনের একটি উপজাত আর এর সবকিছুই বিশ্ব উষ্ণায়নের উপাদান হিসেবে পৃথিবীকে গ্রাস করে আসছে। নাইট্রাস অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে খুব দীর্ঘ সময় স্থায়ী হয়। CO2 এর তুলনায় গত 100 বছরে দেখা গেছে এটির GWP হল ২৬৫-২৯৮।

অন্যদিকে ফ্লোরিনেটেড গ্যাসগুলো ওজোন ক্ষয়কারী হিসাবে পরিচিত একটি উপাদান যা রেফ্রিজারেটরে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। এটি অত্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী এবং অত্যন্ত উষ্ণায়নকারী একটি GHG যা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। 

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো- এটির কোন প্রাকৃতিক উৎস নেই, সম্পূর্ণরূপে মানবসৃষ্ট। ১০০ বছরের তথ্য উপাত্ত ঘেটে দেখা গেছে, এটির GWPs ১৮০০ থেকে ৮০০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে আর কিছু ভেরিয়েন্ট ১০,০০০ পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। 

আরেক উপাদান সালফার হেক্সাফ্লোরাইড বা SF6 বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতির জন্য ব্যবহৃত হয়। প্রাথমিকভাবে যাকে অস্তরক পদার্থ বা বিশেষ করে অস্তরক তরল বলা হয়। এগুলো ট্রান্সফরমার এবং গ্রিড সুইচিং গিয়ারের মতো উচ্চ ভোল্টেজ সম্পন্ন অ্যাপ্লিকেশনগুলোতে অন্তরক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। SF6 উপরের বায়ুমণ্ডলে হাজার হাজার বছর স্থায়ী হতে পারে এবং এর GWP ২২,৮০০।

কালো কার্বন এবং বিশ্ব উষ্ণায়নে এটির ভূমিকা কী?

ব্ল্যাক কার্বন (BC) হল জীবাশ্ম জ্বালানী, জৈব জ্বালানী এবং বায়োমাসের অসম্পূর্ণ দহনের ফলে নির্গত কার্বনের ক্ষুদ্র কণা। এই কণাগুলো অত্যন্ত ছোট আকারের যা 10 µm (মাইক্রোমিটার, PM10) হয়। যেখানে একটি একক ব্যাকটেরিয়ামের আকার 2.5 µm (PM2.5) এর চেয়ে কম ও মানুষের চুলের প্রস্থের এক ত্রিশ ভাগ। এটি দেয়ালের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করতে সক্ষম। এমনকি মানুষের ফুসফুস এবং রক্ত প্রবাহে এর উপস্থিতির দেখা পাওয়া যায়।

GHG এবং কালো কার্বনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস কি?

জীবাশ্ম জ্বালানী এবং কয়লা এবং পেট্রোলিয়ামের ব্যবহারের ফলে GHG এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প, পরিবহন ও আবাসিক জ্বালানির ফলে কালো কার্বনের সৃষ্টি হচ্ছে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের কেমন প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে?

জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন ডাই অক্সাইডের (CO2) স্তর এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, দ্রুত বরফ গলে যাওয়া, জীবাশ্ম রেকর্ড এবং বেশ কিছু প্রজাতির বিলীন সংক্রান্ত বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদী ডেটা আমাদের কাছে রয়েছে।

আর এসব ডেটা লক্ষ লক্ষ বছর আগের কথাই বলছে। যখন কিনা CO2 স্তর এবং তাপমাত্রার মধ্যে একে অপরে ঘনিষ্ঠাভাবে যে জড়িত তার প্রমাণ দেখিয়েছে যা একটি শক্তিশালী সম্পর্ক দেখাচ্ছে। সাম্প্রতিক সাম্প্রতিক সময়ে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে CO2-এর মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা পরিলক্ষীত হচ্ছে। 

সাগরে মাছের উপস্থিতি, সমুদ্রপৃষ্ঠের অবস্থান আর ঋতু বৈচিত্রের অস্বাভাবিক পরিবর্তন বলে দেয় আমরা হুমকির মুখে ইতোমধ্যে পড়ে গেছি। বিজ্ঞানীদের তৈরি মডেলে এমন তথ্যের প্রমাণ মিলেছে। আর জলবায়ুতে পরিবর্তন ঘটেছে কিনা তা পরীক্ষা করতে বিজ্ঞানীরা নানা তত্ত্বও যাচাই করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। 

ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত ঘেটে এমন একটি মডেল প্রস্তুত করা যেটির মাধ্যমে আমরা যেন জানতে পারি ভবিষ্যতে কতটা বিপর্যয় আমাদের অপেক্ষায় রয়েছে।  এক্ষেত্রে নাসা এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিক সংস্থাগুলো বলছে যে, উপরোক্ত যেসব উপাদান নিয়ে আলোচনা করেছি এসবের সত্যিকারের ভিত্তি রয়েছে। 

পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাইয়ের দ্বিতীয় ধাপ হল আসন্ন পরিবর্তনের পূর্বাভাস দেওয়া এবং সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে এটির সঙ্গে মোকাবেলায় আমরা কতটা প্রস্তুত। একদিকে হিমবাহের গতিপ্রকৃতি আর অন্যদিকে পোলার আইস ক্যাপে গ্রীষ্মকালীন সময়ে দ্রুত বরফ গলনের অবস্থার পর্যবেক্ষণ করলেই ভবিষ্যতের বাস্তবতা ওঠে আসবে। 

আর এসব পরিবর্তন CO2’র মাত্রা এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। ইতোমধ্যে NASA বা যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা এসব ভেরিয়েবেলের মধ্যে রিলেশনাল মডেলের মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করছে কীভাবে একে অপরের সঙ্গে কাজ করছে আর তা দেখতে ভিজ্যুয়াল টুলের ব্যবহারও শুরু করেছে সংস্থাটি। 

আর এমন নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে CO2 এর স্তর, তাপমাত্রা এবং মহাসাগরের pH ও অন্যান্য রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো সরাসরি কীভাবে একে অপরের সঙ্গে সংযোগ হিসেবে কাজ করছে তাও দেখা যাচ্ছে পুরো সিস্টেমটির মধ্যদিয়ে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //