মিরপুরের শাহআলীর মাজারের পেছনের সড়ক ধরে কিছুদূর গেলেই রাস্তা পার হলে সোঁতা নদী তুরাগ। এক সময় তুরাগের খরস্রোতা স্বভাবের কথা লেখা আছে ইতিহাসে। তুরাগের পাড়েই ছোট্ট ছায়াঢাকা পাখিডাকা গ্রাম বিরুলিয়া। ব্রিটিশরা যখন দেশ শাসন করছে, তখন জমিদারদের লাঠিয়ালরা এ গ্রামে বাস করত। বীরদের গ্রাম থেকেই বিরুলিয়ার নামকরণ। বিরুলিয়ার ভেতর দিয়ে সাভার বেশ কাছেই। একটু হাঁটলেই চোখে পড়বে বিস্তৃত মাঠ, ফসল বুকে নিয়ে শুয়ে আছে। ঘন সবুজের মায়া আর দূরাগত বাতাসের এলোমেলো আবহ প্রাণ ভরিয়ে দেয়। বিরুলিয়ার পাশেই সাদুল্লাহপুর গ্রাম। তুরাগ তীরের আরেক জনপদ। সাদুল্লাপুর, পাশের গ্রাম শ্যামপুর, কমলাপুর, বাগ্মীবাড়ি সবই এক সময় ভাওয়াল পরগনার অধীন ছিল। এখন এগুলো ফুলের গ্রাম। একটা গ্রামের মানুষ আর কিছু না শুধু ফুল চাষ করে ভাবতেই ভালো লাগে।
গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ কত দূর চলে গেছে। যত দূরের দেখা মিলবে তার সবখানেই ফুল। অনেক মানুষ মাঠের ভেতর দিয়ে ডালা ভরা গোলাপ নিয়ে ফিরছেন। গোলাপের ঘ্রাণে ভরে আসে মন। এই গ্রামের ভেতরে ঢুকতেই চোখ আটকে যাবে যে কারও। এত বড় গোলাপের রাজ্য এর আগে কারও চোখে পড়েনি। গোলাপ ভরা গ্রাম দেখতে অজস্র মানুষ দল বেঁধে চলে আসেন সাদুল্লাপুরে। কী মায়া ভরা গ্রাম! যতদূর চোখ যায় শুধু গোলাপ আর গোলাপ। গ্রামগুলো প্রস্ফুটিত গোলাপের সুগন্ধ আর চোখ জুড়ানো দৃশ্য নিয়ে যেন সেজে আছে। লাল গোলাপের সমারোহের মধ্যে মাঝে মাঝে চোখে পড়বে কিছু সাদা গোলাপ, গ্লাডিওলাস, জারবেরার বাগান। সে এক আলাদা অনুভূতি যেন ছুঁয়ে থাকে অন্তরের এপাশ -ওপাশ।
গোলাপ চাষের কথা
সাদুল্লাপুর গ্রামের গোলাপচাষি চিন্ময় দাসের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, এই গ্রামে আগেও মানুষ ফুলের চাষ করত; তবে তা বিচ্ছিন্নভাবে। বাণিজ্যিকভাবে এখানে প্রথম গোলাপ চাষ শুরু হয় ১৯৯০ সালে। গোলাপের চাষ লাভজনক হওয়ায় ক্রমে এলাকার অনেকেই এর চাষে যুক্ত হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ফুল মিরিন্ডা গোলাপ, চায়না গোলাপ, ইরানি গোলাপ, জারবেরা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকা ইত্যাদির চাষ শুরু হয়। গোলাপের চাষ এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। গ্রামের পথের ধার ঘেঁষে রয়েছে অসংখ্য গোলাপের বাগান। লাল গোলাপের আধিক্য বেশি হলেও এর মাঝেই কিছু সাদা গোলাপ, গ্লাডিলাস, জারবেরার বাগানও চোখে পড়বে। বিপুল পরিমাণ গোলাপের ক্রয়-বিক্রয় হয় এ অঞ্চলে। লাল, নীল, হলুদ, গোলাপি, বেগুনিসহ বিভিন্ন রঙ ও আকৃতির গোলাপ রয়েছে।
গোলাপের হাট
শ্যামপুর গ্রামে প্রতি সন্ধ্যায় গোলাপের হাট বসে। হাটে পাইকারি ফুল কেনাবেচা হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য ব্যবসায়ীর আনাগোনা ঘটে সেখানে। গভীর রাত পর্যন্ত চলে এই হাট। এ ছাড়া মোস্তাপাড়ায় অবস্থিত সাবু মার্কেটেও গোলাপ বেচাকেনা হয়। গোলাপের চাহিদা সারাবছরই বিদ্যমান থাকায় চাষিরাও সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন।
ঢাকার কাছেই এমন ফুলের বাগানের কথা জানে না অনেকেই। একবার যারা এসেছেন তারা আসেন বারবার। গোলাপ গ্রামের এই সৌন্দর্য চোখ ভরে নিয়ে যায় অনেক মানুষ। চাষিদের ফুল তোলার দৃশ্যও বেশ উপভোগ্য। দুপুরের পর থেকেই চাষিরা বাগানে নেমে যান গোলাপ তুলতে। গাছের সারির এক পাশ থেকে ফুল তোলা শুরু করে শেষ পর্যন্ত মুঠো ভরে ফুল তোলেন। সাদুল্লাহপুর ও এর আশপাশের গ্রামে আছে তিনটি ফুলের হাট। বিকালে ফুলচাষিরা ফুল কেটে নিয়ে চলে আসেন হাটে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা এসে ভিড় জমান। রাতে জমে বেচাকেনা। ভোর হওয়ার আগেই গোলাপ গ্রামের ফুল পৌঁছে যায় রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা ফুল বিক্রির দোকানে। শ্যামপুর গ্রামের গোলাপচাষি গোপাল চন্দ্র বলেন, সারা বছরই গোলাপ চাষ হয়। এখানে মূলত মিরান্ডা প্রজাতির লাল গোলাপের চাষ হয়। অনেকেই গোলাপ বাগান দেখতে আসেন। যারাই ঘুরতে আসেন, কিছু টাকার ফুল কিনে নিয়ে যান।
কাফরুল এলাকা থেকে বেড়াতে এসেছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পারভেজ খন্দকার। তিনি বলেন, ‘সময় পেলেই এখানে ঘুরতে চলে আসি। ঢাকার এত কাছে এত সুন্দর গ্রাম ভালোই লাগে। ঘাটে নেমে হেঁটে হেঁটে কয়েক গ্রাম ঘুরে দেখি।’ উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের প্রায় ১৫শ কৃষক ৩শ হেক্টর জমিতে সারা বছরজুড়েই বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল চাষ করে। আর বিরুলিয়া ইউনিয়নে বিদেশি ফুল জারবেরা, মাম, জিপসি, গ্লাডিওলাসের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি চাষ হয়ে আসছে গোলাপের। গোলাপ গ্রামে গেলেই দেখা যায় কৃষকের ব্যস্ততা।
লুৎফর নামে এক চাষি গোলাপ বিক্রি সম্বন্ধে বলেন, ভালোবাসা দিবস, পহেলা ফালগুন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে গোলাপের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। এ তিন দিবসের জন্য বছরজুড়ে গোলাপচাষিরা চেয়ে থাকেন। প্রতিদিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিপুল সংখ্যক পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন। তাই ফুল দেখতে আসা পর্যটকদের ভিড়ে বিরুলিয়া-সাদুল্লাপুর থাকে মুখরিত। খাওয়ার জন্য সাদুল্লাহপুর ঘাটে বেশ কিছু দোকানপাট আছে। দুটি খাবার হোটেল আছে মোটামুটি মানের। সেখানে ভাত, ভর্তা, সবজি, ছোট মাছ ইত্যাদি পাওয়া যায়। ঘাটের মিষ্টির দোকান দই, মিষ্টিসহ গরুর দুধের চা পাওয়া যায়। গ্রামে ঘোরা শেষে অনেককেই মুঠো ভরে তাজা গোলাপ কিনতে দেখা যায়।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : গোলাপ গোলাপ গ্রাম তুরাগ নদী দীপংকর গৌতম
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh