শুধু মুসলিম উম্মা নয়, সকলের একতাবদ্ধ হওয়া দরকার

১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে ইহুদি এসে ইসরায়েল রাষ্ট্র ও তার আশেপাশে বসতি স্থাপন করেছে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ এই অঞ্চলকে ভাগ করে ৪৫ শতাংশ ফিলিস্তিনিদের জন্য বরাদ্দ করে একটি মানচিত্র তৈরি করে। ইহুদির সংখ্যা তুলনামূলক কম হওয়া সত্ত্বেও জাতিসংঘ ফিলিস্তিনিদের চেয়ে ইহুদিদের বেশি জায়গা বরাদ্দ দেওয়ায় জাতিসংঘের প্রস্তাব ও মানচিত্র ফিলিস্তিনিসহ কোনো মুসলিম দেশ মেনে নেয়নি। আমাদের ধর্ম অনুযায়ী ইহুদি অভিশপ্ত জাতি। ধর্মের কারণে এই মনোভাব অধিকাংশ মুসলমানের মনে জাগরূক থাকে; জাগরূক থাকে বলেই ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের ইহুদিদের ভূমধ্যসাগরের অথৈ পানিতে ডুবানোর বাসনা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো নবগঠিত ইসরাইলে আক্রমণ করে বসে। দুঃখজনক হচ্ছে, নতুন একটি রাষ্ট্র্রের সঙ্গেও মুসলিম দেশগুলো হেরে যায়। মুসলিম দেশগুলোর রোষ কমেনি, মুসলিম দেশগুলো আবার ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল আক্রমণ করে শুধু হারেনি, প্রচুর ভূমিও হারায়। 

১৯৭৩ সালে রাশিয়ার সমরাস্ত্রে সমৃদ্ধ হয়ে প্রথমে সিরিয়া, পরে মিশর ইসরায়েল আক্রমণ করে আবার পর্যুদস্ত হয়। ফিলিস্তিনিদের জন্য আর কোনো ভূমিই থাকল না, শরণার্থী হয়ে পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশগুলোতে আশ্রয় নিল। মুসলিম দেশগুলোও ফিলিস্তিনিদের পিটিয়েছে, নিজের দেশ থেকে উচ্ছেদ করেছে। উচ্ছেদ না করেও উপায় ছিল না, কারণ ফিলিস্তিনিরা আশ্রয়দাতা দেশের ভূমি থেকে গিয়ে ইসরায়েলের মাটিতে গেরিলা আক্রমণ চালিয়েছে। ইসরায়েল গেরিলা আক্রমণের প্রতিঘাত করেছে আশ্রয়দাতা দেশের ওপর। একই কারণে কয়েক দিন আগেও সিরিয়ায় বিমান হামলা করেছে ইসরায়েল; শুধু ইসরায়েল নয় আমেরিকাও সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল পরবর্তীকালে গাজা এবং জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর ফিলিস্তিনিদের বসবাসের জন্য ছেড়ে দিলেও জাতিসংঘের মানচিত্র অনুযায়ী জায়গা ছাড়েনি এবং স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ দেয়নি। এ কারণেই ১৯৯৩ সালে পিএলওর নেতা ইয়াসির আরাফাতের শান্তি চুক্তি হামাস মানতে রাজি হয়নি, সশস্ত্র সংগ্রাম করে নিজেদের অধিকার রক্ষায় ব্রতী হয়। হামাসের অসহযোগিতায় শান্তি চুক্তি শান্তি আনতে পারেনি। গাজার ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস যুদ্ধ করলেও জাতিসংঘের বিভিন্ন অধিবেশনে যোগ দিচ্ছে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি মাহমুদ আব্বাস। কারণ আমেরিকা ও তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলো হামাসকে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন মনে করে। নিজেদের অধিকার রক্ষায় সংগ্রাম করায় হামাস আমেরিকার চোখে সন্ত্রাসী। 

হামাসেরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথমে পাথর দিয়ে যুদ্ধ করেছে, যা ‘ইন্তেফাদা’ নামে পরিচিত। ১৯৮৭ সালে শুরু হওয়া ইন্তেফাদার বৈশিষ্ট্য ছিল আইন অমান্যের মাধ্যমে নিরস্ত্র প্রতিরোধ। গাজা উপত্যকা এবং পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিরা প্রথমে ইসরায়েলি শাসন ব্যবস্থা ও তাদের আইনকে মানতে অস্বীকার করেছিল, অস্বীকার করেছিল ট্যাক্স দিতে, তাদের প্রদত্ত লাইসেন্সে গাড়ি চালাতে। ফিলিস্তিনিরা শুরু করেছিল অসহযোগ আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলনে তারা বর্জন করেছিল ইসরায়েলি পণ্য। পাথরের আঘাতে অতিষ্ঠ হয়ে ইসরায়েলের সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি করেছে, মরেছে অগণিত শিশু, কারণ শিশুরাই ছিল পাথর নিক্ষেপের বড় যোদ্ধা। এ পর্যন্ত তারা বড় কোনো সশস্ত্র সংঘাতে যায়নি। তারপর এলো নির্বাচন, ২০০৬ সাল। হামাস ফিলিস্তিনি আইনসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, কিন্তু বাদ সাধল আমেরিকা। আমেরিকা নির্বাচিত হামাস সংগঠনকে ক্ষমতায় বসতে দিল না। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হামাসকে সন্ত্রাসী অভিধায় আখ্যায়িত করে আমেরিকা তাদের চরিত্র উন্মোচন করেছে। বিশ্ববাসী জানল স্থান, কাল, পাত্র ভেদে আমেরিকার দৃষ্টিতে সন্ত্রাস আর গণতন্ত্র ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা পায়। 

হামাস আন্তর্জাতিক আঙিনায় কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে না, তারা তাদের সীমিত অস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলকে একটু ব্যতিব্যস্ত রাখছে মাত্র। নিজের ভূমি উদ্ধারে যুদ্ধ করার জন্য হামাস সন্ত্রাসী হলে ইসরায়েল সন্ত্রাসী রাষ্ট্র নয় কেন? নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় একাত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়েছে; ঠিক তেমনি আমেরিকার বিরোধিতায় নির্বাচনে বিজয়ী হামাসকে ক্ষমতা না দেওয়ায় তাদের নিত্য সঙ্গী হলো অস্ত্র। মিশরেও আমেরিকার গণতান্ত্রিক ভূমিকা উন্মোচিত হলো, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারকে তারা বলল সন্ত্রাসী, তাই নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে আনা হলো অগণতান্ত্রিক সামরিক সরকার। আমেরিকার আচরণ দেখলে মনে হয়, বাংলাদেশেও তারা গণতান্ত্রিক সরকার চায় না, চায় তাদের আজ্ঞাবহ সরকার। বর্তমানে হামাসের একমাত্র সহযোদ্ধা লেবাননের হেজবুল্লাহ বা ‘আল্লাহর দল’ এবং ইয়েমেনের হুতি সম্প্রদায়। 

হেজবুল্লাহ লেবাননভিত্তিক শিয়াপন্থি একটি রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র সংগঠন। ১৯৯০ সালে লেবাননে সংঘটিত গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পরও হিজবুল্লাহ অস্ত্র ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে মধ্যপ্রাচ্যে হেজবুল্লাহকে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা না করেও হেজবুল্লাহ ইসরায়েলের ওপর থেমে থেমে রকেট ছুড়ছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে নামার ক্ষেত্রে হেজবুল্লাহর অভ্যন্তরীণ ঝুঁকি রয়েছে, লেবাননের সেনাবাহিনী হেজবুল্লাহর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ালে হেজবুল্লাহ দুই পক্ষের আক্রমণে নিস্তেজ হয়ে যাবে, পরিশেষে লেবানন সরকারের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হবে। অন্যদিকে চৌদ্দশ মাইল দূর থেকে ইয়েমেনের হুতিরা রকেট ও ড্রোন ছুড়লেও আয়রন ডোম বা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ইসরায়েল তা আকাশেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। হেজবুল্লাহর রকেটের পরিণতিও একই হচ্ছে। আয়রন ডোম বা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিপক্ষের রকেট, ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে বিপুল অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হলেও তাতে ইসরায়েলের সমস্যা হচ্ছে না। 

১৯৪৮ সাল থেকে অদ্যাবধি আমেরিকা ১২৪ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র দিয়েছে ইসরায়েলকে। এ ছাড়াও পৃথিবীর শীর্য ধনীদের প্রায় সবাই ইহুদি। ইসরায়েলের অব্যাহত আগ্রাসনের জবাবে হামাস ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের অভ্যন্তরে সামরিক অভিযান চালিয়ে বেসামরিক লোকদের হত্যা করা ছাড়াও দুই শতাধিক লোককে অপহরণ করে গাজায় নিয়ে যায়। বেসামরিক লোকদের হত্যা করা জঘন্য অপরাধ; তা হামাস-ইসরায়েল সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু ইসরায়েল প্রতিঘাতে যা করছে তা দুনিয়ার ইতিহাসে চরম অপরাধ। গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সর্বাত্মক যুদ্ধে হাজার হাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনি হতাহত হচ্ছে; হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসাকেন্দ্র, শরণার্থী শিবির ইসরায়েলের বোমার আঘাতে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে হাজার হাজার মানুষের জীবন্ত সমাধি হচ্ছে। পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, ওষুধ নেই, চিকিৎসা নেই, খাবার নেই। একদিকে মুহুর্মুহু বোমার আঘাতে ভবনগুলো ধসে পড়ছে, অন্যদিকে বেঁচে থাকা মানুষগুলো হাতের দশ আঙুল দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে আপনজনদের উদ্ধারের চেষ্টা করে যাচ্ছে। জ্বালানি তেলের অভাবে অ্যাম্বুলেন্সের স্থলে গাধার গাড়ি আহত আর নিহতদের টানছে। মিশর থেকে গাজায় প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা ত্রাণের ট্রাকগুলোর কয়েকটির চাকা ঘুরছে ইসরায়েলের দয়ায়। ইসরায়েলের প্রতিশোধ স্পৃহা এত নৃশংস যে, শিশুদের হত্যা করে হামাসকে নির্বংশ করে দিচ্ছে যাতে বড় হয়ে কেউ হামাস হতে না পারে। 

ইয়াসির আরাফাত ও ফিলিস্তিনিরা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ, তাদের পক্ষ হয়ে এক সময় খ্রিষ্টান ফিলিস্তিনও যুদ্ধ করেছে; কিন্তু ইসরাইলের নির্যাতন, বসতি স্থাপন, ভূমি দখল, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে একগুঁয়েমির বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষ ফিলিস্তিন নেতাদের শান্তির অন্বেষণ সাধারণ ফিলিস্তিনিদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে, তাদের আস্থা চলে যায় ইসলামি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের ওপর। কিন্তু মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রু সাম্প্রদায়িকতা, মাত্রাতিরিক্ত সম্প্রদায় প্রীতি। সম্প্রদায় প্রীতি থেকে সারা বিশ্বের মুসলিম সমাজ আজ হামাসের পক্ষে মুসলিম উম্মাকে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানাচ্ছে; এমন সঙ্কীর্ণতার জন্যই ফিলিস্তিন সমস্যা পঁচাত্তর বছর ধরে শুধু মুসলমানের সমস্যাই রয়ে গেছে, সর্বজনীনতা পায়নি। কিন্তু মুসলিম দেশগুলো যা করেনি তা করে দেখিয়েছে লাতিন আমেরিকার কলম্বিয়া, বলিভিয়া ও চিলি। গাজার মানুষের ওপর ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার প্রতিবাদ স্বরূপ দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে বলিভিয়া; অন্যদিকে কলম্বিয়া ও চিলি ইসরায়েল থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিয়েছে। লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশও গাজাবাসীর পক্ষে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু এই দেশগুলো মুসলমান অধ্যুষিত নয়।

ইসরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে ইরান ছাড়া বাকি মুসলিম দেশগুলোর কণ্ঠস্বর মিনমিনে, মুখের কাছে কান নিয়ে শুনতে হয়। মার্কিন সরকারসহ পশ্চিমের দেশগুলো ইসরায়েলের নৃশংস গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞকে সমর্থন দিয়ে গেলেও ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে এবং গাজায় ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ মিছিল করছে; এই বিক্ষোভ মিছিলে হাজার হাজার ইহুদিও যোগ দিচ্ছে। মানবতার বিপর্যয় রোধ করে যুদ্ধ আর মৃত্যু ঠেকাতে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। তাই শুধু মুসলিম উম্মা নয়, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে সমগ্র বিশ্বের মানবতাবাদীদের ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হওয়া দরকার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //