সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ, অসহায় রেফারি

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির ব্যাপারে সরকার তথা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ যে চূড়ান্ত হার্ডলাইনে এবং বিএনপিও যে শেষবারের মতো নিজেদের দাবি আদায়ে মরিয়া- সেটি সাম্প্র্রতিক ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্ট। ফলে অতীতের মতো এবারও অনেকেই মনে করছেন বা বিশ্বাস করছেন যে, দেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে সংলাপ হলেই বুঝি নির্বাচনকেন্দ্রিক বিদ্যমান সংকট কেটে যাবে।

কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। কেননা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ বা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে বড় কোনো রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয়েছে, এমন নজির নেই। এবারও তার কোনো সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।

গত ৪ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ২৬টি দলের সঙ্গে সংলাপ করেছে নির্বাচন কমিশন। তারা ৪৪টি দলকে আমন্ত্রণ জানালেও ১৮টি দল তাতে সাড়া দেয়নি। সংলাপে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সম্প্রতি বিএনপির কিছু সাবেক নেতাকে নিয়ে গড়ে তোলা তৃণমূল বিএনপি অংশ নিয়েছে। বিএনপি অংশ নেয়নি। সংলাপের চিঠিও সম্ভবত বিএনপি নেতাদের হাতে পৌঁছায়নি। কারণ ২৮ অক্টোবরের সহিংসতার পর থেকে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ থাকায় নির্বাচন কমিশনের এই চিঠি দেওয়া নিয়েও নাটকীয়তা হয়। 

এরই মধ্যে বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে গত ২ নভেম্বর সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘জানোয়ারের সঙ্গে কোনো সংলাপ নয়।’ তার ভাষায়, ‘এই সন্ত্রাসী, জঙ্গি, এ অমানুষগুলো, এদের সঙ্গে কারা থাকে, আর তাদের সঙ্গে বসা? এই জানোয়ারদের সঙ্গে বসার কথা কারা বলে? আমার কথা হচ্ছে জানোয়ারদেরও একটা ধর্ম আছে। ওদের সে ধর্মও নাই।’ (বাংলা ট্রিবিউন, ২ নভেম্বর ২০২৩)। বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও দুর্বৃত্তপনা রুখে দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, অগ্নিসন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তদের ধরিয়ে দিন। এর দুদিন আগে ৩১ অক্টোবর বিকালে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনেও বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দেন প্রধানমন্ত্রী। ‘সংলাপের পার্ট শেষ’ বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও। ৫ নভেম্বর রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বিএনপি একটি ‘সন্ত্রাসী দল’। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে না। (ইত্তেফাক অনলাইন, ৫ নভেম্বর ২০২৩)।

অতএব দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের বড় দুই দলের মধ্যে যে কোনো সংলাপ হচ্ছে না, সেটি আপাতত নিশ্চিত। এমনকি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও বিএনপির সংলাপ হচ্ছে না। তার চেয়ে বড় কথা, আওয়ামী লীগ বা নির্বাচন কমিশন বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করবে কী করে? দলের চেয়ার‌পারসন খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত আসামি এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দ্বিতীয় প্রধান নেতা তারেক রহমান লন্ডনে। তিনিও সাজাপ্রাপ্ত। দলের মহাসচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক নেতাই জেলে।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে মাঠে সক্রিয় সাতজনের মধ্যে মহাসচিবসহ তিন গুরুত্বপূর্ণ নেতাই গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি। সক্রিয় অন্য চারজনও গ্রেপ্তার এড়াতে  আত্মগোপনে। বয়সের কারণে নিষ্ক্রিয় চারজন। আইনি জটিলতায় ভারতে আটকা একজন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন চার সদস্য। (সমকাল, ৪ নভেম্বর ২০২৩)। ফলে আওয়ামী লীগ বা নির্বাচন কমিশন এখন চাইলেও বিএনপির সঙ্গে কোনো সংলাপের সুযোগ নেই। আর দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও যদি পরিস্থিতি এ রকমই থাকে, তাহলে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও তাতে বিএনপি অংশ নেবে না বা নিতে পারবে না। (যদিও আগামী জানুয়ারিতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা নেই।)

এই যখন পরিস্থিতিতে দেশবাসীর মনে প্রশ্ন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি ২০০৭ বা ২০১৩-১৪ সালের মতো হতে যাচ্ছে? যদি তাই হয়, তাহলে করোনা অতিমারি এবং বৈশ্বিক নানা সংকটের ভেতরে ঘুরপাক খাওয়া দেশের অর্থনীতি আরও বেশি সংকটে পড়বে কি না? সংঘাত-সহিংসতা বন্ধ না হলে জানুয়ারিতে আদৌ নির্বাচন করা যাবে কি না? এসব প্রশ্ন, সংশয়ের ভেতরেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পরিবহন শ্রমিকদের উদ্দেশে বলেছেন, গাড়ির ভেতরে দুই-চারটা লাঠি রাখবেন। অবরোধের সময় নিজেদের আত্মরক্ষার্থে আপনারাও গাড়ির ভেতরে একটু গজারির লাঠি দুই-চারটা রাখবেন। সামনে পড়লে পিটায়া তক্তা করে দেবেন। আমাদের আইনেও বলে, যদি কেউ আপনাকে মারতে যায় তাহলে প্রতিহত করতে পারেন সম্পদ এবং নিজের জান রক্ষার্থে। এতে আইনে কোনো বাধা নেই। (যমুনা টেলিভিশন, ৪ নভেম্বর ২০২৩)। প্রসঙ্গত, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যে উৎসাহী হয়ে পরিবহন শ্রমিকরা স্বপ্রণোদিত হয়ে কাউকে মারধর করলে তার দায় কে নেবে, এই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। 

সংলাপ বা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে বড় কোনো রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয়েছে এমন নজির দেশে নেই। বরং রাজপথে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই দাবি আদায় করতে হয়েছে। আন্দোলনের মাঠ যাদের দখলে থাকে, ভোটের ফলাফল তাদের পক্ষেই যায়। এবারও যাতে বিএনপি আন্দোলনের মাঠ দখলে নিতে না পারে, সেজন্য সরকার শুরু থেকেই হার্ডলাইনে আছে। মাঝখানে অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা তৎপরতা, বিশেষ করে ভিসা নীতি ও স্যাংশন ইস্যুতে আওয়ামী লীগকে কিছুটা নমনীয় মনে হচ্ছিল। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচি ঘিরে পরিস্থিতি সেই জায়গায় নেই। বরং এখন সরকার তথা ক্ষমতাসীনরা স্পষ্টতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও আর পাত্তা দিচ্ছে না। 

সুতরাং সরকারের বিরুদ্ধে বড় ধরনের গণজাগরণ বা গণঅভ্যুত্থান তৈরি না হলে টানা চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগ যে সরকার গঠন করবে, সেটি মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিএনপির পক্ষে দেশের দলনিরপেক্ষ সাধারণ মানুষ কি দলে দলে রাস্তায় নেমে আসবে? তাতে লাভ কী? এখন যে কোনো আন্দোলনে সফলতা পাওয়া কঠিন। এখন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে যে কোনো বিষয়ে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলা যেমন সহজ, তেমনি সেই ক্ষেপে যাওয়া মানুষকে ভয় দেখিয়ে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখা আরও সহজ। কেননা নাগরিকরা এখন প্রতিনিয়তই নজরদারির মধ্যে রয়েছে। কোথায় যায়, কী করে, কার সঙ্গে ফোনে কী কথা বলে, কী পরিকল্পনা করে, কী লেখে বা কী বলতে চায়, তার ওপর আছে রাষ্ট্রের নানা বাহিনীর নজর।

তা ছাড়া মানুষ এখন অনেক বেশি বৈষয়িক, আত্মকেন্দ্রিক। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নামতে চায় না। ক্ষমতায় কে থাকল, এর চেয়ে তার বড় প্রশ্ন চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজের দাম কেমন। নিত্যপণ্যের বাজার ইস্যুতে সরকার এখন বেকায়দায় আছে সেটি অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এই ইস্যুতে কি লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে সরকারের পতন দাবি করে? সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফলে এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি তাতে মনে হচ্ছে বিএনপিকে ছাড়াই আরও একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে, যদি ভিন্ন কিছু না ঘটে। 

তবে বিএনপির মতো একটি বড় দল যদি নির্বাচনে না আসে বা এবারও একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হলে আন্তর্জাতিকভাবে সরকার বড় ধরনের চাপে পড়বে কি না এবং পড়লেও সেটি মোকাবিলা করার মতো সক্ষমতা ও কৌশল আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার রয়েছে কি না, তা এখনই বলা কঠিন। যেমন বলা কঠিন চলমান সংকটের আদৌ কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে কি না। গত ৪ নভেম্বর ২৬টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘রাজনৈতিক সংকট নিরসনের সামর্থ্য বা এখতিয়ার কমিশনের নেই। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এ সংকট সমাধান করতে পারে।’ অতএব রেফারি নিজেই যখন বলছেন তার কিছু করার নেই, তখন সেই খেলায় যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে এবং খেলোয়াড়রা ইচ্ছেমতো ফাউল করবেন, সেটিই স্বাভাবিক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //