পোশাক শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির বিপক্ষে মালিক পক্ষ

গত এক সপ্তাহ ধরে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে গাজীপুর অঞ্চলে শ্রমিকরা রাজপথ অবরোধ করে আন্দোলন করে চলছে। যা বিস্তৃত হয়েছে মিরপুর অঞ্চলে। এই দুই জায়গাতেই পুলিশ নির্মমভাবে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ পুলিশের পাশাপাশি আছে ‘শিল্প পুলিশ’ এবং বিজিবি। ব্যাপারটা এমন নয় যে সাধারণের চলাচল অব্যাহত রাখতে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ শ্রমিকদের হটিয়ে দিচ্ছে এবং বেধড়ক পেটাচ্ছে। এসব  আসলে পুলিশের ‘রেগুলেশন ওয়ার্ক’। 

১৯৮০ সালের দিকে পোশাক শিল্প গড়ে ওঠার পর থেকে শ্রমিকদের নিপীড়নের ক্ষেত্রে সকল সরকারের ফর্মুলা জিরো টলারেন্স। বাংলাদেশে যত পোশাক কারখানা আছে তার প্রায় সবই একধরনের দোজখবিশেষ। আগুন লাগার পর শ্রমিকরা বেরোতে না পেরে জ্যান্ত পুড়ছে এরকম ঘটনা বহুবার আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সাভার ইপিজেডে, আশুলিয়ায় আগুনে পুড়ে, তাড়া খেয়ে, মালিক পক্ষের লেলিয়ে দেওয়া ভাড়াটে গুন্ডাদের হাতে এ যাবৎ কত জন মরেছে তার সঠিক হিসাব নেই। থাকে না। যেন শ্রমিকরা মানুষ নয়।

এমন অভিযোগ প্রায়শই উঠেছে, ওই সব কারখানায় মাসের পর মাস ধরে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয় না। ব্যাংকের দেনা শোধ হয় না। ব্যাংক ক্রোক করে নিতে পারে মনে করে মালিক গং নিজেরাই আগুন ধরিয়ে দেয়। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের সময় কয়েক কোটি লিখিয়ে নেওয়া গেলে ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম ইত্যাদি করে একটা মোটা অঙ্ক রেয়াত পাওয়ার চিন্তা থেকে এ কাজ হচ্ছে তাতে এখন আর রাখঢাক নেই।

কারখানাগুলোর না-খাওয়া শ্রমিক এবং তাদের সন্তান-সন্ততিরা যখন কাফনের কাপড় গায়ে চড়িয়ে রাজপথে নামে তখনো সামান্যতম অনুকম্পা হয় না কারও। শেষবারের মতো সরকারের তরফে ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার ৩শ টাকা করে দেওয়ার পর মালিকপক্ষ বহু বৈঠক করেছে। সেখানে সমবেতভাবে তারা শ্রমিকদের বিরুদ্ধেই বিষোদ্গার করেছে। 

অভিযোগ আছে মিরপুরে আন্দোলনরত শ্রমিকদের মালিক পক্ষের লোকজন পিটিয়েছে। পরে তাদের সঙ্গে পুলিশ ও বিজিবিও যোগ দিয়েছে। এরই মধ্যে মালিক পক্ষ হুমকি দিয়ে বলেছে, ‘বেতন বৃদ্ধির নামে রাজপথে বিশৃঙ্খলা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা বেতন বৃদ্ধি নিয়ে বৈঠক করছি। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সুরাহা হবে।’ এখন প্রশ্ন উঠবে, আপনারা কারা যে শ্রমিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চান? আপনাদের কি অধিকার আছে ‘ব্যবস্থা নেওয়ার’? আসলে শ্রমিক শ্রেণিকে নিপীড়নের বেলায় ধনিক শ্রেণির অজুহাতের অভাব হয় না। 

শ্রমিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মালিক পক্ষ বেতন বৃদ্ধির যে হার প্রস্তাব করেছে তা চরম অবমাননাকর। বাজারে দ্রব্যমূল্য বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় উঠেছে যার সঙ্গে তুলনা করলে শ্রমিকদের ওই বেতন দিয়ে এক সপ্তাহ চলা যাবে হয়তো। শ্রমিকরা দাবি করেছে ন্যূনতম বেতন ২৫ হাজার করতে হবে। অথচ ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

জরুরি বিষয় হচ্ছে শ্রমিকদের যখন বছরের পর বছর ঠকানো হয়, তখন শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে হয় সরকারকে। কেননা এই শ্রমিকদের শ্রমেই বিদেশ থেকে ডলার আসে। কিন্তু শ্রমিকরা যখন প্রতারিত হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে, মার খাচ্ছে, পেটে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই; সে সময় সরকার নিরোর মতো নির্লিপ্ততায় বিষয়গুলো এড়িয়ে যাচ্ছে। সেই শ্রমিকরা যখন নিরুপায় হয়ে রাজপথে নামছে সরকার তখন মালিকদের পক্ষ নিয়ে শ্রমিক পেটানোর অনুমতি দিচ্ছে। এবার শ্রমিকরা কার কাছে যাবে? 

সবচেয়ে নির্মম হলো এই সমাজের প্রায় ৯৯ শতাংশ গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিপক্ষে। এটা এক বিস্ময়কর উপাত্ত। এমনকি অন্যান্য সেক্টরের শ্রমিকরাও এদের বিষয়ে নির্লিপ্ত। রিকশাচালকরাও গার্মেন্ট নারী শ্রমিকদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। দেশের শিক্ষিত সুশীল সমাজ প্রশ্ন করে না- কেন গার্মেন্ট শ্রমিককে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে পথে নামতে হবে? কেন তাদের বেতন সরকারের আইনকানুন মতে বৃদ্ধি পাবে না?

মালিকরা তাদের কারখানা শুরু করতে এবং উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, মহাদপ্তর, উপদপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের প্রতি মাসে যে পরিমাণ টাকা ঘুষ দেয় সেটা যে কোনো বিচারে শ্রমিককে দেওয়া বোনাস-ভাতার চেয়ে অনেক বেশি। অথচ তারা দেশের অর্থনীতি তো বটেই, রাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের অঙ্গুলি হেলনে দেশের শিল্পনীতি তৈরি হয়, প্রয়োগ হয়। তাদের দলে পাওয়ার জন্য সরকারি এবং বিরোধী দল উভয়েই প্রতিযোগিতা করেন। তার পরও তারা কেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বিভিন্ন সরকারি-আধাসরকারি দপ্তরে ঘুষ দেন? এ ব্যাপারে মালিকপক্ষের কোনো অভিযোগ নেই, প্রতিবাদ নেই?

আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বামপন্থি তো বটেই, সরকারও সাম্রাজ্যবাদী বলে থাকে- সেই তারাও চায় বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন হোক। অথচ বাংলাদেশের তথাকথিত উন্নয়ন সহযোগী জাপান-কোরিয়া শর্ত দিয়ে দেয়- ট্রেড ইউনিয়ন করতে দিলে তারা অর্ডার বাতিল করে দেবে। যে কারণে ওই দুটি দেশের অর্থায়নের ইপিজেডে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন নেই।

বুদ্ধিজীবীরা বলেন, ‘শ্রমিকের কাজের পরিবেশ উন্নত করতে হবে।’ কিন্তু শ্রমিকরা আগামী দিন কাজ করার জন্য আজকে বাঁচতে চায়। এক লাইনের এই অমোঘ সত্যটি খুব দ্রুত শ্রমিকদেরকেই বুঝে নিতে হবে। নিজের অস্তিত্ব দিয়েই বুঝতে হবে, কেননা এই জনপদে ২/১টি ব্যতিক্রম ছাড়া রাজনীতিক, সুশীল, উকিল-মোক্তার, ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক-কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবী কেউ গার্মেন্ট শ্রমিকের সহমর্মী নয়। এমন বৈরী সময়ে বাঁচার উপায় কী তা তাদেরই খুঁজে বের করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //