অবরোধে কার লাভ কার ক্ষতি

বিএনপি ও তাদের শরিকদের ডাকা অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে কয়েকটি খবরের শিরোনাম:
এক. বাস পোড়ায়া দিতেছে, মনডা খারাপ: ডেইলি স্টার বাংলা, ৫ নভেম্বর ২০২৩।
দুই. অবরোধ ঘিরে ১৩ ঘণ্টায় ১২ বাসে আগুন: কালের কণ্ঠ, ৫ নভেম্বর ২০২৩।
তিন. অবরোধে বিভিন্ন স্থানে যানে আগুন, র‌্যাবের হাতে আটক ৭: একাত্তর টিভি অনলাইন, ১২ নভেম্বর ২০২৩।
চার. চতুর্থ দফার অবরোধেও যাত্রী পাচ্ছে না দূরপাল্লার বাসগুলো: বাংলা ট্রিবিউন, ১২ নভেম্বর ২০২৩।

অবরোধে যানবাহনে আগুন এবং নাগরিক দুর্ভোগের এরকম অসংখ্য সংবাদ পাওয়া যাবে। প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক দাবি আদায়ের জন্য অবরোধের মতো কর্মসূচির ফলে কার লাভ হয়? যারা অবরোধ ডাকেন তারাও কি দিন শেষে লাভবান হন? তাদেরও কি ভোট বাড়ে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, দাবি আদায়ের জন্য কেন এমন সব কর্মসূচি দিতে হয় যার ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ? যার সিএনজি অটোরিকশা জ্বালিয়ে দেওয়া হলো, তার অপরাধ কী? অবরোধের কারণে যে মানুষেরা জরুরি প্রয়োজনেও দূরপাল্লার বাস পাচ্ছেন না, তাদের কী অপরাধ? বিশেষ করে যে পরিবহন শ্রমিকরা বাসের চাকা না ঘুরলে পারিশ্রমিক পান না, এই সময়ে তাদের সংসার কী করে চলে? সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো কি তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়? 

বাস্তবতা হলো, কোনো দল হরতাল-অবরোধ ডাকলে বাস মালিকদের তরফে বাস চলাচল স্বাভাবিক রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। অথচ তাদের অধিকাংশই রাস্তায় বাস নামান না নিরাপত্তার শঙ্কায়। অনেকে নামান। আবার শহরের ভেতরের রাস্তায় বাস চললেও দূরপাল্লায় তথা মহাসড়কে বাস অনেক কম থাকে। যা থাকে তাতে যাত্রী থাকে খুবই কম। কারণ বাস যতই থাকুক নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া হরতাল-অবরোধে মানুষ কোথাও যাওয়ার জন্য বাসে ওঠে না। ধরা যাক আপনি ঢাকায় চাকরি করেন। হরতাল-অবরোধ চলাকালে যদি আপনার প্রিয়জন কেউ মারা না যায় বা খুব অসুস্থ না হয় কিংবা ব্যবসা ও চাকরির খুব জরুরি প্রয়োজন না হয়, অবরোধের মধ্যে তিনি বাসে চড়ে দূরে কোথাও যাওয়ার সাহস পান না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যতই অভয় দিক না কেন, মানুষের মন থেকে ভয় সরে না। তবে শুধু দূরপাল্লার বাসই নয়, বরং শহরের ভেতরে চলাচলকারী বাসেও আগুন দেওয়া হচ্ছে। ফলে শহরের ভেতরে চলাচল করতে গিয়েও মানুষকে আতঙ্কে থাকতে হয়।

২৮ অক্টোবর থেকে ১০ দিন ধরে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় রাজধানীসহ সারা দেশে ১২৫টি গাড়িতে আগুন দেওয়ার খবর জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মিডিয়া সেল। তবে বাস্তবে এই সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও বেশি। কেননা সব খবর ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলে পৌঁছায় না। 

বাসে আগুন দেয় কারা? রাজপথে বিপুল পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, আনসার এবং বিভিন্ন পয়েন্টে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থান এবং গোয়েন্দাবাহিনীর নজরদারি, হাজার হাজার সিসি ক্যামেরা ফাঁকি দিয়ে কী করে দুর্বৃত্তরা বাসে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়? কেউ কেন হাতেনাতে ধরা পড়ে না?

সরকারি দলের পক্ষ থেকে বরাবরই বাসে আগুন দেওয়ার জন্য আন্দোলনকারী বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করা হচ্ছে। গাড়িতে আগুন দেওয়ার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। যদিও বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করছে বিএনপি। তাদের দাবি, বাসে আগুন বা বোমা হামলা চালিয়ে বিএনপির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা চলছে। 

প্রশ্ন হলো যদি বিএনপি ও তার শরিক দলের লোকেরা বাসে আগুন না দেয়; যদি সরকারি দলের লোকেরা আগুন না দেয়, তাহলে কারা বাসে আগুন দেয়? অন্য কোনো গ্রহ থেকে কেউ এসে আগুন লাগিয়ে চলে যায়? এরকম অভিযোগও বেশ পুরনো যে, যখন কোনো দল হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দেয়, তখন অনেক সময় ‘তৃতীয় পক্ষ’ সুযোগ নেয়। তারা নানা ধরনের নাশকতা চালিয়ে দেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই তৃতীয় পক্ষ কখনো ধরা পড়ে বলে শোনা যায় না। 

গত ১২ নভেম্বর ডিএমপি সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, পরিপূর্ণ নিরাপত্তা বলতে আসলে পৃথিবীতে কিছু নেই। সব থেকে বেশি চ্যালেঞ্জিং হয় চোরাগোপ্তা কিংবা ছদ্মবেশে হামলা। তারপরও ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষে যত ধরনের নিরাপত্তা পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় সেটি কিন্তু আমরা করছি। কিন্তু যারা এ ধরনের চোরাগোপ্তা নাশকতা করছে, তারাও কিন্তু তাদের স্থান ও সময় পরিবর্তন করছে। তারা যে জিনিস দিয়ে নাশকতা করছে সেগুলোও পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে। এখন যারা যাত্রীবেশে চোরাগোপ্তা হামলা কিংবা নাশকতা করছে সেটি ১০০ ভাগ নির্মূল করা চ্যালেঞ্জিং। 

ঢাকার বিভিন্ন থানা এলাকার পুলিশ সদস্য ও স্থানীয়দের বরাতে গণমাধ্যমের খবর বলছে, প্রধানত চারটি কারণে বাসে অগ্নিসংযোগকারীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না। যেমন বিভিন্ন সড়কে সিসিটিভি থাকলেও এর অধিকাংশই নষ্ট। দ্বিতীয়ত যাত্রীবেশে উঠে বাসের ভেতরে অগ্নিসংযোগ করায় প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। তৃতীয়ত যেসব এলাকায় অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলো ঘটছে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সম্ভাব্য অপরাধীদের বিষয়ে খোঁজ নিয়েও তারা চেহারাগুলো চিহ্নিত করতে পারছেন না। এর থেকে ধারণা করা যায়, এক এলাকার অপরাধীরা অন্য স্থানে গিয়ে অগ্নিসন্ত্রাস করছে। চতুর্থত দায়িত্ব পালনকালে অনেক পুলিশ সদস্য বসে খোশগল্প করেন, বেখেয়ালি থাকেন এবং মোবাইলে লুডু খেলাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। ফলে অপরাধীরা দ্রুত গাড়িতে আগুন দিয়ে পালাতে পারছে।

নাগরিকদের মনে যে প্রশ্নটি আছে সেটি হলো, সহিংসতা ছাড়া কি দাবি আদায় করা যায় না? 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুল প্রচলিত কথা হচ্ছে ‘আন্দোলনের মাঠ যার দখলে, ভোটের ফলাফলও তার পক্ষে।’ অর্থাৎ সংলাপ বা আলাপ-আলোচনা নয়, বরং আন্দোলনের মাঠ দখল তথা রাজপথে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে পারলে এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পারলেই ভোটেও বিজয়ী। এই বক্তব্যই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার পথে প্রধান অন্তরায়। কেননা সব পক্ষই মনে করে, আন্দোলন করে জিততে হবে। সংঘাত-সহিংসতা হলেই কেবল প্রতিপক্ষ নমনীয় হবে। যে কারণে আলাপ-আলোচনা বা সংলাপের মধ্য দিয়ে বড় কোনো রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয়েছে- বাংলাদেশের ইতিহাসে তার নজির নেই।

তার কারণ কেউই তালগাছের মালিকানা ছাড়তে রাজি নয়। কেউ নিজের ভুল স্বীকার করতে রাজি নয় বলেই আলোচনা ও সংলাপের পথ তাদের পছন্দ নয়। বিরোধী পক্ষ মনে করে যেহেতু আলাপ-আলোচনায় সমাধান হবে না, অতএব এমন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে যাতে সরকার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। যে কারণে আন্দোলনটি একপর্যায়ে গিয়ে আর শান্তিপূর্ণ থাকে না। শুরু হয় জ্বালাও-পোড়াও, সহিংসতা। সাধারণ মানুষের প্রাণক্ষয়। দেশের সম্পদের অপচয়। আর সরকার মনে করে কোনোভাবেই আন্দোলন সফল হতে দেওয়া যাবে না। অতএব যেভাবেই হোক বিরোধী পক্ষকে দমন করতে হবে। সে কারণে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হয়। গণহারে চলে গ্রেপ্তার অভিযান।

অতএব দিন শেষে যে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন তা হলো, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপি ও তার শরিকদের ডাকে যে টানা অবরোধ কর্মসূচি চলছে, এর দ্বারা সাধারণ মানুষ, এমনকি বিএনপি সমর্থকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পরিবহন মালিক-শ্রমিকসহ সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু লাভ হচ্ছে কার? অবরোধ যদি আরও বেশি সহিংস হয়ে ওঠে, তাতেও কি তাদের নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় হবে? আপাতত তার কোনো লক্ষণ নেই। তাহলে অবরোধের কারণে যে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হচ্ছে; দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হচ্ছে, সেই ক্ষতিপূরণ হবে কীভাবে?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //