ড. আহমদ শরীফ: এক জেদি শিক্ষকের স্মৃতি

অমন জেদি, নৈতিক, একরোখা পণ্ডিত মানুষ কই আজকাল? নয়া জামানার প্রতিবাদীরা গোষ্ঠীর নিয়মের বাইরে চলতে পারে না তেমন। তাদের আছে ‘আমাদের পক্ষ আর তোমাদের পক্ষ’-নিজের বা আমার পক্ষ বলে কেউ নেই। সবাই না হলেও দলের ভাবনার বাইরে কেউ নেই। এটাই হয়তো আমাদের আজকের ঐতিহাসিক বাস্তবতা।

আজকাল বারবার আহমদ শরীফ স্যারের কথা মনে পড়ে। তিনি অনেকের কাছে থেকেও একাই চলতেন।

দুই
আমরা স্বাধীনতার পর প্রথম ব্যাচ। অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা ছিল, কিন্তু কেউ এসব নিয়ে তখন একবার আলাপও করত না। বড়াই, অহংকার, দাপট, কাউকে করতে দেখিনি। যুদ্ধ জীবনের অংশ ছিল, গেছি, এখন শেষ, নতুন কাজে নামো। মানুষ বর্তমানে বসবাস করত। অতীত টেনে আলগা সুবিধা চাওয়ার কালচার ইদানীংকালের ঘটনা। অনেকেই পলিটিক্স করত, কিন্তু ঘৃণা বিতরণ করা হতো না এত ঢাক ঢোল পিটিয়ে। আমরা ওইকালে বড় হয়েছি এটা বড় কপাল।

তিন
আমি ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিলাম, কিন্তু তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী খাতির ছিল সবার সঙ্গে। সেটা স্টুডেন্ট বা শিক্ষক যে-ই হোক। এখন কী অবস্থা জানি না; যেহেতু এখনকার মতো সব কিছু দলীয় ছিল না তাই সম্পর্ক হতো সহজে। আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সঙ্গে। তারা ছিল বাম ঘরানার লোকজন। মনে হয় ছাত্রলীগ ছাড়া সবাই বাম ছিল তখন। ওদের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিল সবার। কিন্তু ওই স্যার-শিক্ষক সম্পর্কের কথাটা এখন অনেক মনে পড়ে। আমাদের অনেকের জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া।

চার
আহমদ শরীফ স্যারের বাম ধারার প্রতি আগ্রহ ছিল একটি জনমানুষবান্ধব মতবাদ হিসেবে। কিন্তু তিনি সনাতনী মার্কসবাদী ছিলেন না। তার কিছুটা ভক্তি ছিল বিদ্যাসাগরের প্রতি। তবে মনে হয় তিনি সবচেয়ে বেশি দাম দিতেন নিজ বুদ্ধি, আত্মমর্যাদাকে। কিছু বুঝতে তার ফুকো-দেরিদার দরকার হতো না। তার গবেষণার পরিসর ছিল বাংলার মধ্যযুগ, কিন্তু ভাবতেন সমকালীন সময় নিয়ে। রাজনীতি নিয়ে দুটি সংগঠনের প্রধান ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ লেখক শিবির ও কমিটি ফর সিভিল লিবার্টিজ অ্যান্ড লিগ্যাল এইড। দুটিই তৎকালীন সরকারবিরোধী, কিন্তু এতে যারা জড়িত ছিল তাদের কারও কারও রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকলেও আদর্শের ভিত্তি প্রধান ছিল। তিনি কোনো দল করতেন না। না আওয়ামী লীগ, না বিএনপি, না কোনো বাম সংগঠন। এই দলহীন একা চলাটা আমার ভালো লাগত। অন্যদের সাফাই গাইতে হতো নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে, স্যারকে হতো না।

পাঁচ
১৯৭৫-এর পর এই পক্ষ -প্রতিপক্ষ বিষয়টি খুব তীব্র হতে থাকে। ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি আমার এক স্যার অধ্যাপক ওয়াদুদ রহমান সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হওয়ার পদে আবেদন করেন। ওয়াদুদ স্যার আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের নেতা আর শরীফ স্যার বাকিদের। এই প্রস্তাব নিয়ে যখন আলোচনা শুরু হলো একাডেমিক কাউন্সিল সভায়, শরীফ স্যার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ওয়াদুদ রহমান এই প্রতিষ্ঠানে সারা জীবন কাটিয়েছেন, সেবা করেছেন। আমি চাই তিনি একজন সম্মানিত অধ্যাপক হিসেবে থাকুন।’ অর্থাৎ এক দলের নেতা প্রতিপক্ষ দলের নেতাকে সমর্থন করছেন প্রমোশনের জন্য। এটা ব্যক্তিগত নৈতিকতার বিষয় ছিল, তার সমর্থকরা কেউ যা ভাবেনওনি, তিনি তাই করেন। এই কারণেই তিনি আলাদা ছিলেন। এখন এই কাজ রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে বিবেচিত হবে।

ছয়
তখন মার্শাল ল চলছে। একদিন লেখক শিবিরের জরুরি মিটিং ডাকা হলো। সেখানে জানা গেল যে আতাউর রহমান খান, প্রাক্তন চিফ মিনিস্টার-এক সভা করবেন ২১ উদযাপনের উদ্দেশ্যে। ততদিনে মন্ত্রিসভা গঠন হয়ে গেছে, বিএনপি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। স্যারের এই সব পছন্দের ছিল না। এক আগামী প্রধানমন্ত্রী স্যারের কাছে দেখা করতে এলেন। তিনি আর সংগঠন করতে পারবেন না, কারণ মন্ত্রী হচ্ছেন। ‘আমরা তো রাজনীতি করি স্যার, আমাদের ক্ষমতার কাছে থাকতে হয়।’ স্যার বললেন, ‘ওটা তো বটেই। তোমরা তো ক্ষমতা চাও।’ সেই বিব্রত মন্ত্রী চলে গেলে আমাকে বললেন, ‘যতজন সরকারের মন্ত্রী হবে সবাইকে সংগঠন থেকে বাদ দিতে হবে।’

সাত
শরীফ স্যার শেষে পর্যন্ত রাজি হলেন মিটিংয়ে যেতে, কিন্তু বললেন এক শর্তে। তিনি যা যা প্রস্তাব করবেন তা মেনে না নিলে ওয়াক আউট করবেন। আমি অবশ্য খুব খুশি, কোনোদিন ওয়াক আউট করিনি মিটিং থেকে, দেখা যাক। মিটিং শুরু হলো। স্যার যেভাবে সরকারের সমালোচনা শুরু করলেন তা বলার নয়। সবাই টেনশনে কিন্তু করার কিছু নেই। ওনার কথা কণ্ঠ ভোটে পাস হচ্ছে কারণ দ্বিমত করার কারও সাহস নেই। এদিকে আমি টেনশন করছি, ওয়াক আউট কখন হবে। শেষে আর না থাকতে পেরে ভিড় ঠেলে স্যারের কাছে পৌঁছালাম। বিষণ্ণ চেহারা নিয়ে বললাম, ‘স্যার ওয়াক আউটের কী হবে?’ উনি বললেন, ‘আমি তো চেষ্টা করছি, কিন্তু এরা এমনই, যাই প্রস্তাব করি তাই মেনে নিচ্ছে। শেষ চেষ্টা করে দেখি।’ সফল হননি। এক স্যার ও ছাত্র ওয়াক আউট না করতে পারার দুঃখ নিয়ে বাড়ি যায়।

আট
উনি আওয়ামী লীগবিরোধী ছিলেন কিন্তু বিএনপিপন্থি না। এটা যে সম্ভব তা এখন কারও মাথায় আসবে না। হয় আমাদের সঙ্গে, না হয় ওদের সঙ্গে মানসিকতার সমাজে। একদিন (১৯৭৭ সালের এক রাতে) তার বাসায়-আমি উপস্থিত তখন-একদল ছাত্র তার ফ্ল্যাট আক্রমণ করে। এমন অবস্থা যে স্যার বারান্দায় গিয়ে দরজা বন্ধে করেন বাঁচতে। কপাল ভালো পুলিশ এসে যায়, তারা পালায়। সেটা ছিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় গোষ্ঠী। কিন্তু একই সঙ্গে যখন তাকে সরকারি চাকরি অফার করা হয় তা নেননি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস প্রকল্পের দলিল বাছাই কমিটির সদস্য হননি। একটা কাগজে লিখলেন, ‘আমি কোনো সরকারি প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হই না।’

নয়
তিনি শিক্ষকতা করেছেন, অনেক সভায় যেতে হতো। আমি একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বিরক্ত লাগে না? তিনি বললেন, ‘খুব। কিন্তু তবু যাই। আমার কিছু বলার আছে সেই সুযোগ পাই। আমি একাই হাঁটব।’ স্যার আপনাকে সালাম।


লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //