বিএনপি নিশ্চিহ্ন হলে আওয়ামী লীগের কী লাভ

বিএনপির পক্ষ থেকে যখন দাবি করা হচ্ছে, তাদের নেতাকর্মী, এমনকি সমর্থকরাও পুলিশের গ্রেপ্তার ও আটক আতঙ্কে বাড়িঘরে থাকতে পারছে না; ব্যবসা বাণিজ্য, কাজকর্ম করতে পারছে না; পরিবারের সদস্যরা বিচ্ছিন্ন থাকায় অসংখ্য পরিবারকে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে, সেই সময়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি শেষ হয়ে যাচ্ছে; আগামী ১০-১৫ বছর পরে বিএনপি বলে কিছু থাকবে না। 

প্রশ্ন হলো, বিএনপি না থাকলে আওয়ামী লীগের কী লাভ? রাজনৈতিক দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন কি নিষিদ্ধ? বিএনপি কি নিষিদ্ধ কোনো দল? 

আজকে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া বা রাজনীতি থেকে মাইনাস করে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া চলছে বলে মনে হয়, সেই একই প্রক্রিয়া চলেছিল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন তথা রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্য। কিন্তু আওয়ামী লীগকে কি নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হয়েছে? 

প্রসঙ্গত গত ১৩ নভেম্বর খুলনা সার্কিট হাউস মাঠে এক জনসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আল্লাহ যার সঙ্গে আছে, তাকে কেউ হটাতে পারে না। শেখ হাসিনা জনগণের শক্তিতে শক্তিমান। তাকে কোনো অপশক্তি হটাতে পারবে না। ২৮ তারিখ সরকার তো যায় যায়। শেষ হয়ে গেছে? শেষ হয়ে যাচ্ছে তারা। বিএনপি এখন শেষ হওয়ার পথে। তারা বেশি তর্জন গর্জন করতে গিয়ে নিজেদেরই পতন ডেকে যাচ্ছে।’ (ডেইলি স্টার অনলাইন, ১৩ নভেম্বর ২০২১)।

এর পাঁচ দিন পর ১৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) চেয়ারম্যান সজীব ওয়াজেদ জয় সাভারে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি-জামায়াতকে ‘সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী’ দল উল্লেখ করে বলেন, ‘আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরে বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত বলে কিছু থাকবে না।’ (কালের কণ্ঠ, ১৮ নভেম্বর ২০২৩)।

সুতরাং বোঝা যাচ্ছে দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা এবং দলীয় প্রধানের ছেলের বক্তব্যের মধ্যে মিল রয়েছে। প্রশ্ন হলো আওয়ামী লীগ কি চাচ্ছে বিএনপি নামে কোনো দল বাংলাদেশে না থাকুক? বিএনপি না থাকলে আওয়ামী লীগের কী লাভ?

স্মরণ করা যেতে পারে, গত ২৬ আগস্ট রাজধানীর মিরপুরে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের আয়োজনে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এক রাতের মধ্যে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।’

তার মানে কি ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে তৈরি হওয়া ভয়ের কারণে তারা এখন বলছে যে বিএনপি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে অথবা তারা চাইছে বিএনপি শেষ হয়ে যাক? আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মতো কোনো দলকে কি আদৌ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া সম্ভব? 

রাজনীতির নিয়মই তো, কেউ ক্ষমতায় থাকবে, কেউ বিরোধী পক্ষে। এখানে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রশ্নটি কেন আসে? এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, দেশের অবকাঠামো খাতে যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে; করোনা মহামারি মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতি এখনো যে একটা মোটামুটি শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, তার কৃতিত্ব তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই।

নানা সমালোচনার পরও দ্বিমতের অবকাশ নেই যে, আওয়ামী লীগ এখনো দেশের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল। বিপুল জনগোষ্ঠীর সমর্থন তার পেছনে রয়েছে। তাহলে আওয়ামী লীগ কেন মনে করছে যে তারা ক্ষমতায় না থাকলে বিএনপি এক রাতেই তাদের ধ্বংস করে দেবে?

যে দলটি ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে; শীর্ষ দুই নেতার একজন বিদেশে, আরেকজন শারীরিকভাবে অসুস্থ; ভেতরে নেতৃত্বের কোন্দলের কথা মোটামুটি সবার জানা, সেই দলের হাতে আওয়ামী লীগের মতো একটি দল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, এ ধরনের কথার কী অর্থ দাঁড়ায়?

এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, প্রতিহিংসা এবং বিরোধী মতের অনুসারী তথা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাওয়ারই ইতিহাস, যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। যে মানুষটির ডাকে সাত কোটি মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল; যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করে দেশকে স্বাধীন করল সেই মানুষটিই কি না নৃশংসভাবে নিহত হলেন এই দেশেরই কিছু মানুষের হাতে! গবেষণা বলছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা বা তাকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাটি শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই। দুর্বৃত্তরা শুধু সময়ের অপেক্ষায় ছিল। পৃথিবীতে আর কোনো জাতি তাদের জাতির পিতাকে এভাবে নৃশংসভাবে খুন করেছে?

বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সমূলে ধ্বংস তথা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার আরেকটি বড় ঘটনা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীতে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করে দেওয়ার জন্য ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্টের নৃশংসতা শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল এবং এই ঘটনাটি দেশের প্রধান দুটি দলের মধ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি করে দিয়েছে।

আওয়ামী লীগ ২১ বছর ক্ষমতায় ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলতে নানারকমের চেষ্টা ও রাষ্ট্রীয় আয়োজন চলেছে। কিন্তু এ দেশের কোটি কোটি মানুষের মনে তিনি ছিলেন। আছেন। থাকবেন। যার ঠিকানা মানুষের হৃদয়ে, তাকে রাষ্ট্র মুছে ফেলতে পারে না। 

একইভাবে বিএনপি নিশ্চিহ্ন হলেও বিএনপির আদর্শ থাকবে। সেই আদর্শ যদি হয় আওয়ামী লীগের বিরোধিতা, তাহলে যত দিন আওয়ামী লীগ থাকবে, তত দিন সেই আদর্শ থাকবে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি থাকলে ওই আদর্শের মানুষেরা কোথায় যাবেন? কাকে ভোট দেবেন? তারা মিশে যাবেন আওয়ামীবিরোধী বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে। 

এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় র‌্যাডিকাল ফোর্সের জন্ম হয়। বিএনপির একটি বড় অংশ আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে, যা আওয়ামী লীগের জন্য আরও বেশি হুমকি তৈরি করবে। অর্থাৎ দৃশ্যমান বিএনপির চেয়ে অদৃশ্য বিএনপি; বৈধ বিএনপির চেয়ে নিষিদ্ধ বিএনপি অনেক বেশি হুমকি তৈরি করতে পারে আওয়ামী লীগের জন্য। আওয়ামী লীগ কেন অদৃশ্য শত্রু তৈরি করতে চায় সেটি স্পষ্ট নয়। কেননা বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে ঘোষণা করে একে রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করার দাবিও আওয়ামী লীগের মধ্যে আছে। এই দাবিটি খুব জোরালো না হলেও মাঝেমধ্যেই শোনা যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো একটি অভিজ্ঞ দলের নেতাদের এই উপলব্ধিটা জরুরি যে, তাদের জন্য জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কিংবা এ জাতীয় ধর্মীয় গোষ্ঠীর চেয়ে বিএনপি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি নিরাপদ। বিএনপিকে মোকাবিলা করা যে কোনও ধর্মীয় কিংবা র‌্যাডিক্যাল ফোর্সকে মোকাবিলা করার চেয়ে সহজ। 

মোদ্দা কথা, প্রতিপক্ষকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে না দিয়েও যে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করা যায়, আমাদের দেশে সেই সংস্কৃতিটাই গড়ে ওঠেনি। ওঠেনি বলেই এখন ক্ষমতাসীনদের মধ্যে আতঙ্ক ভর করেছে যে, তারা ক্ষমতা থেকে চলে গেলে এক রাতের মধ্যেই বিরোধী পক্ষের দ্বারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। প্রতিপক্ষককে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া বা দিতে চাওয়ার এই রাজনীতি আখেরে দেশ ও জনগণের জন্য তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও ভালো হয় না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //