রাষ্ট্রের জন্য কতটা ভয়ংকর খাদিজা!

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় ১৫ মাস কারাভোগের পর গত ২০ নভেম্বর মুক্তি পেয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা। জেল থেকে বেরিয়েই তিনি সোজা চলে যান পরীক্ষার হলে। ওই দিন তার চতুর্থ সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়। প্রথম দিনের পরীক্ষা ভালো হয়েছে বলে জানান খাদিজা। তিনি কারাগারে বসেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ২০২০ সালে যখন খাদিজার নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়, তখন তার বয়স ১৭ বছর। জাতিসংঘ, এমনকি বাংলাদেশ আইনেও ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু। অথচ খাদিজাকে গ্রেপ্তারের পর তাকে রাখা হলো বড়দের কারাগারে। কিশোর সংশোধন কেন্দ্রেও পাঠানো হয়নি। কারণ মামলায় তাকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে যে দুটি মামলা হয়েছে, তার একটিতে তার বয়স দেখানো হয়েছে ১৯ এবং অপরটিতে ২২ বছর।

খাদিজার অপরাধ কী ছিল? তিনি একটি ফেসবুক ওয়েবিনারের হোস্ট বা সঞ্চালন করেন, যেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেনের একটি বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহী বক্তব্য আখ্যা দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। ওই আলোচক যেহেতু দেশের বাইরে থাকেন, তাই তাকে গ্রেপ্তার করা না গেলেও অনুষ্ঠানের সঞ্চালক খাদিজাতুল কুবরাকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

যুক্তির কথা হলো, আলোচকের বক্তব্যের দায় খাদিজার নয়। অনুষ্ঠানে একজন আলোচক কী বলবেন, সেখানে একজন সঞ্চালকের সব সময় ভূমিকা পালনের সুযোগ থাকে না। বিশেষ করে টেলিভিশন বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের লাইভ অনুষ্ঠানে। রেকর্ডেড হলে সেটি এডিট করার সুযোগ থাকে। কিন্তু কোনো আলোচক যদি সত্যিই সরকার বা রাষ্ট্রবিরোধী কোনো বক্তব্য দিয়েও বসেন, সরাসরি তার দায় সঞ্চালকের ওপর বর্তায় না। অথচ সঞ্চালককেই পুলিশ গ্রেপ্তার করল এবং আসামি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, এমনকি কিশোরী হওয়া সত্ত্বেও আদালত তাকে জামিন দেননি। ছয়বার তার জামিন আবেদন নাকচ হয়েছে। সবশেষ গত ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারকও খাদিজার জামিন আবেদন নাকচ করেন। নিম্ন আদালতে আবেদন বারবার খারিজ হওয়ার পর গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট খাদিজাকে স্থায়ী জামিন দেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ তখন জামিন আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে দুটি পিটিশন দাখিল করে এবং একজন চেম্বার বিচারক জামিন আদেশ স্থগিত করেন। অবশেষে উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে তার জামিন হয়। কিন্তু জামিন হওয়ার পরও তিনি সময়মতো জেল থেকে বেরিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। কেননা ১৯ নভেম্বর জামিনের আদেশ কারাগারে পৌঁছালেও মুক্তি পাননি খাদিজা। তার মুক্তির জন্য ১৯ তারিখ সারাদিন তার পরিবারের সদস্যরা কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে অপেক্ষা করেন। কিন্তু রাত ১১টা পর্যন্ত খাদিজা মুক্তি না পাওয়ায় তাকে ছাড়াই তারা ফিরে যান। এ সময় খাদিজার বোন সিরাজুম মুনিরা সাংবাদিকদের বলেন, ‘কুরিয়ারের বাইকে করে সন্ধ্যা ৭টায় আদালতের আদেশ কারাগারে এসেছে। আমি নিজে দেখেছি। এমনকি আমরা কুরিয়ারের লোকের সঙ্গে কথাও বলেছি। যখন জানতে চাইলাম কেন খাদিজাকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না, তখন এক পুলিশ সদস্য এসে আমাদের বললেন যে, তারা অন্যান্য সংস্থা এবং পুলিশের ছাড়পত্রের অপেক্ষা করছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার জন্য নাকি এ ছাড়পত্র লাগবে।’ এরকম নাটকীয়তার পর পরদিন ২০ নভেম্বর সকালে কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান খাদিজাতুল কুবরা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পরীক্ষার উপলক্ষ না থাকলে খাদিজাকে হয়তো এখনো কারাগারেই থাকতে হতো। 

প্রশ্ন হলো, খাদিজা একটি অনলাইন শোতে সঞ্চালক হিসেবে যে ভূমিকা পালন করেছেন, সেই অপরাধের ভয়াবহতা কি এতই তীব্র যে, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং কিশোরী হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রপক্ষকে তার জামিনের বিরোধিতা করতে হলো? এই শিক্ষার্থী জামিনে বের হলে কি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজ বা বড় ধরনের নাশকতায় যুক্ত হবে বলে সরকারপক্ষ মনে করে? 

এই শিক্ষার্থী রাষ্ট্রের জন্য কি এতটাই ভয়ংকর যে জামিন পেতে তাকে ১৫ মাস অপেক্ষা করতে হলো? তিনি কি কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসী যে জামিনে বের হয়েই কাউকে হত্যা করবেন? আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কী এমন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন যাতে বিচারক তাকে আইনত জামিন দিতে পারতেন না? খাদিজা এই আইনের কী এমন ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন বা তার উপস্থাপনায় যে অনুষ্ঠানটি হয়েছে সেখানে বক্তা যেসব কথা বলেছিলেন, তাতে রাষ্ট্রের কী এমন ক্ষতি হয়েছে কিংবা যার বিরুদ্ধে বলা হয়েছে, তার যদি সম্মানহানি হয়েও থাকে, তার পরও এই মামলায় কি একজন কিশোরী, যিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, তাকে জামিন দেওয়া খুব কঠিন?

মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘খাদিজাতুল কুবরা ও দেলোয়ার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশের বৈধ সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মনগড়া, বানোয়াট, মিথ্যা, মানহানিকর অপপ্রচার চালিয়ে আসছিলেন।’

প্রশ্ন হলো, একটি দেশের সরকার উৎখাত করা এতই সহজ? একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা চাইলেই দেশের বৈধ সরকার উৎখাত করে দিতে পারেন? তাহলে আর দেশে রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর কাজ কী? 

অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কিংবা টেলিভিশন চ্যানেল অথবা যে কোনো মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করা, এমনকি সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য রাজনীতিরই অংশ। গণতন্ত্রে এটুকু অধিকার স্বীকৃত। এসব বক্তব্যকে গুরুত্ব না দিলেও কিছু যায় আসে না। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হওয়ার পর থেকে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দেওয়া মানেই তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। যার সুবিধা নিচ্ছে একটি পক্ষ। আবার সরাসরি কেউ হয়তো ডিজিটাল মাধ্যমে না লিখে সংবাদপত্র বা কোনো বইপত্রে লিখলেন; সেই সংবাদ, বিশ্লেষণ এমনকি কার্টুনও ডিজিটাল মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে ডিজিটাল আইনে মামলা দেওয়া হচ্ছে। আইনের এ রকম ভয়াবহ অপপ্রয়োগ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে আছে কি না সন্দেহ।

এবার বিষয়টিকে একটু উল্টো করে দেখা যাক। গণমাধ্যমের খবর বলছে, খাদিজা খুবই সাধারণ পরিবারের একজন মেয়ে। তার বাবা কুয়েত প্রবাসী। সন্তানদের পড়ালেখার জন্য তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। খাদিজা বরাবরই ভালো শিক্ষার্থী। প্রশ্ন হলো এই বয়সে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হবে?

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বাইরে থেকে যারা সরকারবিরোধী নানা বক্তব্য দিয়ে আলোচিত এবং বিতর্কিত, অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ার হোসেন তাদের অন্যতম। প্রশ্ন হলো, এ রকম একজন ব্যক্তিকে নিয়ে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে সিরিয়াস পলিটিক্যাল শো করতে হলো কেন? খাদিজা কি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত বা তিনি কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর পার্পাস সার্ভ করছিলেন? 

শিক্ষাজীবন শেষ না হতেই এ ধরনের একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে তাকে নামতে হলো কেন? তার সামনে একটা দীর্ঘ জীবন রয়েছে। তার যে রাজনৈতিক বিশ্বাস বা তিনি যে আদর্শ ধারণ করেন, সেটি নিয়ে কথা বলা বা কাজ করার অজস্র সময় সামনে পড়ে আছে। এই বয়সে তাকে কেন এমন একটি কাজ শুরু করতে হলো যেখানে ঝুঁকি প্রচুর? তার বয়স ও পেশার সঙ্গে এ কাজটি কি মানায়? 

তার পরিবারের দাবি অনুযায়ী, তার বিরুদ্ধে যখন ডিজিটাল আইনে মামলা হয়েছে তখন তিনি অপ্রাপ্ত বয়স্ক। সুতরাং একজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা কিশোরীকে তার ছাত্রজীবনেই কেন জটিল রাজনীতির মধ্যে ঢুকতে হলো? খাদিজা কি স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজটি করেছেন নাকি তিনি পয়সার বিনিময়ে করেছেন? তার এই কাজে তার পরিবারের কি সমর্থন ছিল? 

খাদিজা একজন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক এবং তার পড়ালেখা শেষ হলে বা তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় নেতা-কর্মী হলে এই প্রশ্নগুলো উঠত না। এই প্রশ্নগুলো তোলার উদ্দেশ্য ‘ভিকটিম ব্লেইম’ নয়। বরং অন্য শিক্ষার্থীদেরও সতর্ক করা যে, কখন কোন কাজটি করতে হবে; কোন কাজের পরিণাম কী হতে পারে, সেটি মাথায় রাখা জরুরি। 

প্রায় ১৫ মাস কারাগারে থেকে খাদিজার মধ্যে কী উপলব্ধি হয়েছে জানি না। তবে তিনি যেহেতু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, ফলে এটি ধরে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত যে তিনি ‘পলিটিক্যালি কনশাস’ বা রাজনীতি সচেতন। কিন্তু সেই সচেতনতার অর্থ এই নয় যে, এই বয়সেই তিনি কোনো ঝুঁকিপূর্ণ খেলায় নামবেন। সবকিছুর একটা বয়স থাকে। সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে কাজ করলে বিপদের শঙ্কা কমে। 

খাদিজা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন, পরীক্ষা দিচ্ছেন, তার শিক্ষাজীবন নির্বিঘ্নে শেষ হোক এই প্রত্যাশা। সেই সঙ্গে তার মামলাটিও দ্রুত শেষ হবে এবং খাদিজার একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার পথে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা বিচারব্যবস্থা কোনো ধরনের অন্তরায় তৈরি করবে না, সেটিও প্রত্যাশা। খাদিজার জীবন সুন্দর হোক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //