কপ২৮ সম্মেলনের সমাপনী, প্রত্যাশা ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা

দুবাই এক্সপো সিটিতে সদ্য সমাপ্ত হয়েছে এবারের (২০২৩) বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ২৮ অধিবেশন। বিশ্বের ১৯৩টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি ও আন্তর্জাতিক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী ও গণমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতিতে বেশ  জাঁকজমকপূর্ণ এই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রাষ্ট্রনেতাদের  কী করণীয়, পাশাপাশি বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে নানা বিষয়ে খুঁটিনাটি আলোচনার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল এই বিশ্ব মঞ্চ। দুবাই সম্মেলন শেষে কয়েকদিনের আলোচনার পর একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে সবাই একমত হয়েছে। এবারেই প্রথম সকল দেশ একযোগে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসতে একাত্মতা জানিয়েছে। কিন্ত ফেইজ আউটের ক্ষেত্রে কেউ এক হতে পারেনি। তবে বিশ্বের মানুষকে বাঁচাতে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার বিষয়েও অবশ্য সবাই একমত পোষণ করেছে। এ বিষয়ে কপ২৮ সভাপতি বলেছেন, চ্যালেঞ্জিংমূলক বাস্তবতা সামনে আসন্ন…এখনই সময় পৃথিবীকে বাঁচাতে সঠিক নির্দেশনা দেয়ার। 

জীবাশ্ম জ্বালানির ফলে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, কোটি কোটি জনসংখ্যার জীবন আজ হুমকির মুখে। আর এই কারণে নিজ নিজ দেশের সরকারগণ এটি ব্যবহারে বন্ধে একাট্টা হয়েছে।  আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কর্মীদের চোখে এবারের সম্মেলনের নানা খুঁটিনাটি জেনে আসা যাক। কোন দেশ কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, কার কেমন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ইস্যুতে এসব বিষয়েই কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কর্মীগণ। 

দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জন্য সাহায্যের আহবান ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসের 

সম্মেলনের মূল কক্ষের বাইরে এ বিষয়ে চুক্তি করা নিয়ে কথাবার্তা শোনা গেছে বলে জানান গনমাধ্যমকর্মীরা। ডেনমার্কের জলবায়ু মন্ত্রী জানিক জোরগেনসেন বলেন, ইউরোপিয় দেশগুলোর এ ব্যাপারে জোর ভাষায় কথা বলা উচিত। 

তিনি বলেন, এখন মনে হচ্ছে অবশেষে বিশ্ব স্বীকার করে নিল জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দূরে থাকা উচিত। এ সময় নিউজিল্যান্ডের জলবায়ু মন্ত্রী ডেনমার্কের মন্ত্রীর সুরেই কথা বলেন। 

তিনি বলেন, আমাদের প্রতিবেশী প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সঠিক এক চুক্তিতে পৌঁছাতে আমাদের কাজ করা আবশ্যক।

জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের ভাবনা 

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস কড়া ভাষায় বলেন, আপনাদের কারও পছন্দ হোক বা না হোক, এটা জেনে রাখুন জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এটি চুক্তিতে অবশ্যই থাকতে হবে। আমি আশা করি এ বিষয়ে আর কেউ অযথা বিলম্ব করবেন না। 

চুক্তিই একমাত্র সমাধান- অস্ট্রেলিয়া  

দেশটির জলবায়ু মন্ত্রী ক্রিস বাউয়েন চুক্তির বিষয়ে বেশ জোর দেন। এ সময় তিনি জীবাশ্ম জ্বালানির ফেজ আউট ইস্যুতে জোরালভাবে কথা বলেন। তিনি বলেন, চুক্তির মাধ্যমেই কেবল সমাধান আশা করা যায়। আর এটি হবে আমাদের জন্য এক মাইলফলক। 

যদিও তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন এমন চুক্তি আগেও হয়েছে যেগুলো আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়টি সবার ভাবনায় স্থান পাওয়ায় অবশ্য সকলকে ধন্যবাদ জানান তিনি। 

৩৯ দ্বীপ দেশের পক্ষে সামোয়া 

দ্বীপ দেশ সামোয়া এ প্রসঙ্গে তাদের খানিক সন্দেহের কথা জানায়। তাদের ভাষ্য, এর আগেও ৩৯ টি দ্বীপরাষ্ট্রের জোট এ বিষয়ে তাদের মতামত দিয়েছিল। তারা বলেন, আপনারা সবাই আমাদের আড়ালেই সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বলে থাকেন। 

ইউরোপিয় ইউনিয়ন: আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের ব্যাপারে একমত 

ইইউ’র জলবায়ু কমিশনার ওপকে হোয়েকস্ত্রা বলেছেন, দিনটি ছিল পরিতৃপ্তির। এবারে ইউরোপিয় ইউনিয়ন (ইইউ) শক্ত ভাষায় জীবাশ্ম জ্বালানির ফেইজ আউট ইস্যুতে কথা বলেছে। 

হোয়েকস্ত্রা বলেন, দিনটিকে স্বাগত জানানো উচিত, কারণ সবাই এবারে দীর্ঘ ৩০ বছর পর একমত পোষণ করেছে বিষয়টি নিয়ে। 

তিনি বলেন, আপনাদের জানাতে চাই একাত্মতার জন্য সকল প্রয়োজন আমরা পাশে আছি। 

কপ প্রধানের ভাষ্য 

কপ২৮ প্রেসিডেন্ট আল জাবের এ বিষয়ে দ্রুত, দ্রুত এবং দ্রুত এগিয়ে নিতে সবার প্রতি আহবান জানিয়েছেন। এ সময় তিনি সকল দেশগুলোকে তিন মিনিটের মধ্যে তাদের মতামত জানাতে বলেন। 

উন্নত দেশগুলোর দিকে বলিভিয়ার অভিযোগ 

আলোচনার সময় বলিভিয়ার প্রতিনিধি বলেন, আমরা ঠিক জানিনা কত দ্রুত সময়ের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ হবে। এটা স্বচ্ছতার কোনো বিষয় নয়, বিষয়টা সময়ের। বলিভিয়ার পক্ষ হতে বলা হয়, এখন দক্ষিণ আমেরিকার প্রতিনিধিগণ চুক্তিতে নায্যতার বিষয়ে সমালোচনা করে আসছেন। 

দেশটির মূখপাত্র বলেন, গত আট বছর যাবত দেখে আসছি উন্নত দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি অপসারণে তেমন ভূমিকা রাখেনি। 

বাংলাদেশের ভাবনা 

দেশটির প্রতিনিধিরা বলেন, এই প্রথম সকল জাতি তাদের ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে বেরিয়ে এসে সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। আমাদের বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে রয়েছে। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি নীচু দেশগুলোর জন্য বড় হুমকি। 

যুক্তরাষ্ট্র কী বলছে? 

যুক্তরাষ্ট্রের জন কেরি বলেন, দুবাইয়ে আজ ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্ম হল। 

তিনি বলেন, এটা স্পষ্ট যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দূরে সরে আসার অঙ্গীকার করা একটি বিশাল অর্জন, যদিও "বেশ কিছু লোক" বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করতেন। ইইউ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ এখানকার অনেক দেশ এবং গোষ্ঠী বলছে যে তারা এই চুক্তির মাধ্যমে "জীবাশ্ম জ্বালানিকে পর্যায়ক্রমে শেষ করতে" চায়।

এ সময় তিনি গাজা-ইসরায়েল ইস্যুতেও কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি আজ আশার আলো দেখছি, যদিও অনেকেই অন্য কিছু বলতেই পারেন। আমি সহযোগিতায় বিশ্বাসী। 

ঐতিহাসিক দিন ও কপ প্রেসিডেন্ট 

সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট দিনটিকে ঐতিহাসিক বলে মন্তব্য করেছেন। তেল, গ্যাস ও কয়লার অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে পৃথিবীকে উষ্ণ করে তুলছে। 

তিনি বলেন, যদিও অনেকেই বলবেন  এটা খুব কম দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্ব এই সত্য স্বীকার করতে আজ একত্রিত হয়েছে, আশা করি তা বাস্তবে পরিণত হবে। আপনি কি আজকের পরে একটি নতুন কয়লা চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আপনার জীবনের সকল সঞ্চয়ের ওপর বাজি রাখতে চান?

তবে বিশ্লেষকদের মত চুক্তিটি মৌলিকভাবে বেশ দুর্বল। কারণ সংযুক্ত আরব আমিরাতের সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় একাধিক পদক্ষেপে অবদান রাখতে বিশ্বকে সম্মত করতে জোরালো আহ্বান জানানো উচিত ছিল। 

আল জাবের বলেন, “বাস্তবায়ন” নিয়ে এই চুক্তি কতটা সফল সেটাই আসলে দেখার বিষয়। 

ব্রাজিলের ভূমিকা 

ব্রাজিলের প্রতিনিধি বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দূরে সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর নেতৃত্ব দেওয়া উচিত।

দেশটির মূখপাত্র বলেন, ‘’এই দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মিশনটি সরবরাহের চ্যালেঞ্জটি প্রত্যেকের প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করবে।‘’ 

তিনি বলেন, তার দেশ এতে সাহায্য করতে পেরে খুশি এবং সম্মানিত। এসময় তিনি ব্রাজিল দুই বছরের মধ্যে বেলেমের আমাজনে কপ আয়োজন করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন। 


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //