ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ

একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর আমার অনুভূতিটা ছিল রোগমুক্তির। যেন একটা কঠিন রোগে পেয়েছিল, দুরারোগ্য ব্যাধি। রোগটা সমষ্টিগত আবার ব্যক্তিগতও। আমরা সবাই ভুগছিলাম, এক সাথে এবং আলাদা। বোধটা সামান্য নয়।

সাতচল্লিশে আমরা আরও একবার স্বাধীন হই, তখন স্বাধীনতা এসেছিল স্টিমারে করে। সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্ট দুপুর বেলা যে জাহাজটি এসে থামে, গোয়ালন্দ থেকে পদ্মাপাড়ের ভাগ্যকুলে সেটিকে আমাদের মনে হয়েছিল স্বাধীনতার জাহাজ। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের মস্ত একটা পতাকা উড়ছিল, সদম্ভে। সারা জাহাজ সুসজ্জিত ছিল ছোট ছোট অসংখ্য পতাকায়। স্টিমার ঘাটে পন্টুনে বহু মানুষ দাঁড়িয়ে ওই জাহাজের প্রতীক্ষায়, যার মধ্যে আমিও ছিলাম। একটি কিশোর। আমার হাতেও নিশান। সেই নিশান নাড়িয়েছি আমরা, জিন্দাবাদ দিয়েছি। জাহাজের রেলিংয়ে দাঁড়ানো যাত্রীরাও দিয়েছে, সমান উৎসাহে। স্বাধীনতার জাহাজ পরে আটকা পড়ে গেছে, চরায়। পাকিস্তান একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে আমাদের জন্য, যার লক্ষণ ও পীড়া স্পষ্ট হচ্ছিল, ক্রমাগত। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ। বাঁচার প্রয়োজনে। 

একাত্তরে রোগমুক্তি যে আসন্ন সেটা বোঝা যাচ্ছিল। আমরা জিতব কি জিতব না, এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে নিশ্চয়ই, কখনো কখনো, কারও কারও মনে। অনেকের মতো আমিও নিশ্চিত ছিলাম জিতবই। প্রশ্ন ছিল কবে, কীভাবে, কতটা যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে সেটা ঘটবে। হয়তো সময় লাগবে, ক্ষতি হবে, কে থাকবে কে থাকবে না কে জানে, কিন্তু রোগটা থাকবে না। যাবেই চলে। 

পঁচিশে মার্চের পর থেকে আমার নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা ছিল না। নানা জায়গায় থাকতাম। আমি তখন সকলের সঙ্গে সংলগ্ন, সকল পীড়িত মানুষের সঙ্গেই একত্র; কিন্তু আবার বিচ্ছিন্নও, রোগীরা যেমন হয়। আমার বিচ্ছিন্ন ভাসমানতার কারণ ছিল একটি নয়, দুটি। প্রথম কারণ আমি বাঙালি, দ্বিতীয় কারণ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর হানাদাররা বিশেষভাবে চটা ছিল, ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকদের যোগাযোগের দরুন। আগের শাসকেরা যেমনটা ভেবেছে পাকিস্তানিরাও তার ব্যতিক্রম করেনি, ধরে নিয়েছে ছাত্রদের বিপথগামিতার পেছনে শিক্ষকদের উসকানি কাজ করেছে। সেটা আদৌ সত্য ছিল না। ছাত্ররা কারও উসকানির জন্য অপেক্ষা করেনি। নিজেরাই বের করে নিয়েছে নিজেদের পথ। প্রাণের দায়ে, বাঁচার প্রয়োজনে। হানাদাররা তাদের হিসেবে শিক্ষকদের মধ্যে যে-কয়জনকে অপরাধী বলে চিহ্নিত করেছিল তাদের মধ্যে আমিও একজন। 

পঁচিশে মার্চ রাতে সহকর্মীদের কয়েকজন শহীদ হয়েছেন। ছাত্র এবং কর্মচারীও। সেসব খবর ছাব্বিশ তারিখের ভোরে একেকটি আতঙ্কের মতো এসে পৌঁছাচ্ছিল। পরের দিন সকালে কার্ফু ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সপরিবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। সেই যে বাসা ছেড়েছি, আর ফেরা হয়নি। দু-একবার যে এসেছি সে শুধু জিনিসপত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য। ফেরারির মতো। 

না ফেরার কারণ ছিল। হানাদাররা যাদেরকে খুঁজছে তাদের মধ্যে আমার নাম যে রয়েছে সেটা জানা হয়ে গিয়েছিল এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই। আমার এক নিকটাত্মীয় ছিলেন পুলিশে, একেবারে গোয়েন্দা বিভাগেই। সামরিক দপ্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ওই বিভাগকে বলা হয়েছিল, সে-তালিকায় আমার নাম নিচে নয়, উপরের দিকেই ছিল, তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন। এক বিকেলে অফিস সময়ের বাইরে তিনি ঝুঁকি নিয়ে হলেও আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার দপ্তরে, তালিকাটি দেখাতে। বুঝলাম যে এর পরে আমার পক্ষে কোনো একটি ঠিকানায় বেশি দিন থাকা নিরাপদ হবে না। তাই করেছি আমি। যাদের আবাসে থেকেছি তারাও যে সবাই খুশি হয়েছেন আমাকে পেয়ে তেমনটা বলা যাবে না। রোগ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, হাসপাতালের রোগীরা যে পরস্পরকে সাহায্য করতে পারে তা নয়। আমি যে একটি নয়, দুটি রোগে আক্রান্ত সেটা তারা সঠিকভাবে না জানলেও আশঙ্কা তো করতেন। সেপ্টেম্বরে মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও গভর্নর টিক্কা খানের স্বাক্ষর করা চিঠি এসেছিল কয়েকজন শিক্ষকের নামে। ভবিষ্যতের জন্য সাবধান করে দিয়ে। প্রাপকদের মধ্যে নিজেকে দেখে বিস্মিত হইনি, তালিকাটি তো আমার জানাই ছিল, আগেই। 

আমার বন্ধু ও সহকর্মী জয়নুল আবেদীন চলে গেলেন সীমান্ত পার হয়ে। আমি যাব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়া হলো না, নানা টানাপড়েনে। আমাদের ধারণা হয়েছিল যে, যুদ্ধটা বেশ কিছুদিন চলবে, তাই দেশের ভেতরেও সুযোগ থাকবে কাজ করবার। 

অবাঙালিদের দেখেছি, আশেপাশে। এতদিন উদ্বাস্তু ভাবত তারা নিজেদেরকে, তাদের অনেকেরই এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থা। বাংলার অন্ধকার আকাশে তাদের সৌভাগ্য যেন তারার মতো দীপ্যমান। তাদের মধ্যে ভদ্রগোছের যারা সেসব মানুষকেও মনে হতো অহঙ্কারী। 

ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখে আমরা ঠিক করেছি এবার ঢাকা ছেড়ে চলে যাব, লম্বা সময়ের জন্য। ব্যাংকে যার যা গচ্ছিত ছিল তুলে নিয়েছি। কয়েকটি রিকশা নিয়ে রওনা দিয়েছি সদরঘাটের দিকে। গ্রামে চলে যাব। এবারও বোধ হয় স্বাধীনতাকে গ্রামে দাঁড়িয়েই দেখতে পাব, ২৩-২৪ বছর আগে একদিন যেমন দেখা পেয়েছিলাম। কথাটা তখন ভাবিনি, কিন্তু ঘটনা ওই রকমই দাঁড়াতো, গ্রামে যদি যাওয়া হতো। যাওয়া হয়নি। সদরঘাটে পৌঁছে দেখি আরও কেউ কেউ এসে গেছেন। সপরিবারে। অন্য অঞ্চলের মানুষ তারা, কিন্তু সেদিকে যাওয়ার উপায় নাই, আমরা যাচ্ছি শুনে ঠিক করেছেন আমাদের সঙ্গেই যাবেন, আমরা যেখানে যাই সেখানেই। তাতে তেমন অসুবিধা ছিল না, অসুবিধা যা ঘটবার ঘটল নৌকার অভাবে। পনেরো-ষোলো মাইল যেতে হবে নদীপথে, শীতকাল, বিকেল শেষ হয়ে যাচ্ছে, সন্ধ্যা নামবে, তারপরেই অনিশ্চয়তা। নৌকা পাওয়া কঠিন হলো। শেষ পর্যন্ত ছাদখোলা মালবাহী বড় একটা নৌকার মাঝিদের রাজি করানো গেল বটে, কিন্তু মালপত্র নিয়ে সব মানুষের তাতে জায়গা হয় না, জায়গা হলেও কাত হয়ে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা। ঠিক হলো যারা অতিথি হয়ে যাচ্ছেন তারা ওই নৌকায় যাবেন, আমরা যারা স্থানীয়, পরে রওনা হবো। কিন্তু সেই সন্ধ্যায় আর কোনো নৌকা পাওয়া গেল না। নিরুপায় হয়ে ভাবলাম পরের দিন সকালে রওনা হবো। সেই সকাল আর আসেনি। 

সদরঘাট থেকে শহরে নিকটতম আত্মীয় বাড়ি কোনটা তার খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল সেটি ওয়ারীতে। সেই বাসাতেই গিয়ে উঠলাম আমরা, বাকিরা। রাতের জন্য। কিন্তু সেই রাত বড় দীর্ঘ হয়েছিল। রাতেই জানা গেল কার্ফু জারি করেছে একটানা। নাকি তারা প্রস্তুত হচ্ছে যাবার আগে শেষ কামড়টি দিয়ে যাওয়ার জন্য। সেটি ভয়ঙ্করই হবার কথা। বিদেশি রেডিও আশা দিলো, কিন্তু ভরসা দিতে পারল না। চৌদ্দ-পনেরোতে আমরা আটকা পড়ে আছি। যাদের বাসায় আছি, তাদের অসুবিধা হচ্ছে কি না, বাসায় খাবার-দাবার কতটা আছে বা নেই, সে-নিয়ে কেউ ভাবছে না। সকলেই একই উদ্বেগে উদ্বিগ্ন, বাঁচা যাবে কি না। দূরে মাইক্রোফোন দিয়ে কারা যেন কী বলে যাচ্ছে, অবাঙালি গলা। স্লোগানও শোনা যাচ্ছে মনে হয়, ওরা কি তবে মিছিল করে বের হচ্ছে, বাঙালি-নিধনে? থেকে থেকে গোলাগুলির আওয়াজ আসছে, কোনদিক থেকে বলা মুশকিল। শোনা গেল, পানি ও বিদ্যুৎ শিগগিরই বন্ধ হয়ে যাবে। একজন শুনে এসেছে পানির সঙ্গে বিশ মিশিয়ে দেবে। আর কিছু না হোক, ডিনামাইট দিয়ে শহরটাকে উড়িয়ে দিতেও তো পারে? আর এটা তো খুবই সম্ভব যে শত্রু ও মিত্র বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি বিনিময়ের মাঝখানে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে শহরের অনেক এলাকা। রাস্তায় রাস্তায় কি যুদ্ধ হবে, সামনাসামনি, মুখোমুখি, হাতাহাতি? কে জানে। ষোলোই ডিসেম্বরের সকাল থেকেই বোঝা যাচ্ছিল পাকিস্তানিরা তেমন কিছুই করতে পারবে না, বরঞ্চ তাদের নিজেদের আত্মসমর্পণই আসন্ন। ভারতীয় বেতারে বিভিন্ন ভাষাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হচ্ছে। করলে কী কী সুবিধা তা জানাচ্ছে। না করলে কী কী ঘটবে তাও জানাতে বাকি রাখছে না। জলে স্থলে অন্তরীক্ষে-সব দিক দিয়েই পাকিস্তানিরা যে অবরুদ্ধ, তারা বলছে সে-কথা। বিদেশি বেতারও সমর্থন করছে সংবাদ। ঘণ্টায় ঘণ্টায় নতুন নতুন খবর পাওয়া যাচ্ছে। 

এক সময়ে শোনা গেল সেই বহু-প্রতীক্ষিত সংবাদ। হানাদারেরা আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছে। জানা গেল রেসকোর্সে ঘটবে সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। খবর শুনে চারদিক থেকে মানুষ বেরিয়ে পড়েছে। যেন এইমাত্র রাত কাটাল, সকাল হয়েছে। আমরা কেউ বের হইনি। কিন্তু মনে হয়েছে আমরা আর আগের আমরা নেই। স্বাভাবিক হয়েছি, প্রশস্ত প্রসারিত দীর্ঘ হয়ে উঠেছি, কিন্তু তাই বলে জায়গার কোনো অভাব নেই, সমস্ত দেশই তখন আমাদের। এখন অনেক কিছু ঘটবে। অনেক কিছু পাওয়া যাবে। এখন কোনো অস্থিরতা নেই। বড় কথা অসুখটা সেরে গেছে। আমরা নিরাময় হয়েছি। 

বিকেলে বের হয়েছিলাম ওই বাসারই এক তরুণের সঙ্গে। সে আমার বন্ধু স্থানীয়। ওই কয়দিনের আটককালে বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়েছে। বের হয়েছি রোগমুক্ত মানুষের মতো, স্বস্তি ও আশ্বাস নিয়ে। আমার সঙ্গের তরুণটি অনেক বছর আছে ওই পাড়ায়। সবাই তার পরিচিত। মোড়ে একটা জটলা দেখিয়ে বলল, ওগুলো রাজাকার ছিল, টিটকারি করতো, এখন মনে হয় ভোল পাল্টাবার তালে রয়েছে। 

রেললাইন পার হয়ে হাটখোলা রোড ধরে এগিয়েছি। দেখলাম লাশ পড়ে রয়েছে, এখানে-সেখানে। সৎকারের লোক নেই, তাকাবারও সময় নেই কারও। এখন যেটি বঙ্গভবন, তখন তা ছিল গভর্নর হাউস, সেই ভবনের কাছে আচমকা দেখি এক তরুণ প্রায় লাফ দিয়ে নামছে আমাকে দেখে। চিৎকার করে বলছে, আপনি বেঁচে আছেন? 

তারপরেই ভয়ঙ্কর খবরটি দিলো সেই তরুণ। বলল, অনেকেই নেই। চৌদ্দ তারিখে ধরে নিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় গিয়েছিল ওই তরুণ, তার প্রিয় অধ্যাপকের খোঁজে, ফুল নিয়ে গিয়েছিল, বিজয়ের শুভেচ্ছা জানাবে বলে। ফিরে যাচ্ছে অশ্রুসজল চোখে। তার শিক্ষকটি নেই। চৌদ্দ তারিখে কার্ফুর ভেতরে তাকে ধরে নিয়ে গেছে আল-বদর। আরও অনেককে। কজনকে কে জানে। বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় তখন আহাজারি। আমাকে দেখা যায়নি, কারণ আমি ছিলাম না সেখানে, আমার কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা ছিল না ওই নয় মাস, না দেখে কারও কারও ধারণা হয়েছে আমিও হয়তো বেঁচে নেই, আমাকেও হয়তো বা ধরে নিয়ে গেছে। যাদের পাওয়া যাচ্ছে না তাদের একটি তালিকা শুনিয়েছিল ওই তরুণ। পথের পাশে দাঁড়িয়ে। শুনে বিজয়ের আনন্দ যেটুকু ছিল নিঃশেষ হয়ে গেল। কেবল বেঁচে যে আছি এই স্বার্থপর চিন্তাটা ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতি তখন সেই মুহূর্তে ছিল কি আমার? মনে পড়ে না। তবে স্মরণ করতে পারি যে, মনে হয়েছিল একটু আগে যে কয়েকটি লাশ দেখে এসেছি পথে তারা জীবন্ত হয়ে উঠেছে, আমার অত্যন্ত আপনজন হয়ে উঠেছে তারা। আরও অনেক মানুষ, যারা হারিয়ে গেছে তারাও চলে এসেছে। যেন মৃত্যুই সত্য, বিজয়ের পরে।

অল্প কয়েক পা এগিয়ে আরেকটি দৃশ্য দেখেছিলাম সেদিন। সেটাও বিজয়ের নয়, পরাজয়ের। আলোর নয়, অন্ধকারের। গভর্নর হাউস তখন শত্রুমুক্ত। পাহারাদার বলতে কেউ নেই। সেই ফাঁকে কিছু লোক ঢুকছে আর বের হয়ে আসছে। যারা বের হচ্ছে তাদের মনে হচ্ছে বিজয়ী বীর। এই মাত্র শত্রু হত্যা করেছে। যে যা পেরেছে, পেয়েছে হাতের কাছে নিয়ে বের হয়ে আসছে। কারও হাতে টেবিল ফ্যান, কেউ তুলে নিয়েছে সিঙ্গার মেশিন, কেউ গুছিয়ে নিয়ে চলেছে বিছানার চাদর। মুখে বীরের হাসি। বিজয়ীর। 

বিজয় তো ঘটেছিল সেদিন। অত বড় পরাক্রমশালী, সুসজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে, চতুর্দিকে আনন্দের ধ্বনি, ছুটছে গুলি, বন্ধু জড়িয়ে ধরছে বন্ধুকে। মস্ত বড় সত্য সেটা। কিন্তু ইতিহাসের আরেক ধারাও তো উপস্থিত ছিল। ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিয়েছে বহুজন। সেই ঘাতকরা অন্য কেউ নয়, এই বাংলাদেশেরই সন্তান। এবং বিজয় শেষ হতে না হতেই শুরু হয়েছে লুণ্ঠন। সঙ্গে সঙ্গেই। এক অন্ধকার মিশে গেছে আরেক অন্ধকারের সঙ্গে। 

বিষণ্ণ পায়ে ফিরে এসেছি ঘরে। নানান রকম খবর চতুর্দিকে। পাড়ার ছেলেরা যুদ্ধে গেছিল, তাদের কেউ কেউ ফিরে এসেছে। তারা গল্প বলছে নানাবিধ। বীরত্বের, কৌতুকের, কোনোমতে বেঁচে-যাওয়ার। একটু পরে দেখি মিছিল বের হয়েছে একটা। ঠিকই, সেই রাজাকারেরাই। সত্যি সত্যি। জিন্দাবাদ দিচ্ছে। শেখ মুজিবের ছবি সংগ্রহ করেছে ইতিমধ্যে। এমনকি ইন্দিরা গান্ধীরও। গলায় তাদের জোরের অভাব নেই। 

রাতে আরেক দৃশ্যের বিবরণ পেলাম। দেখেছে দুজন তরুণ। দেখে ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। আগের দিন, পনেরোই ডিসেম্বর তখনকার স্টেট ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা বের করে বহ্ন্যুৎসব বসিয়েছিল পাকবাহিনী। পুড়ে ছাই করে দিয়েছিল টাকার স্তূপ। কিন্তু সবটা পোড়েনি। কিছু ছিল অর্ধ দগ্ধ, কিছু প্রায় অক্ষত। লুঙ্গিতে ভরে বেশ কিছু টাকার নোটের বস্তা বানিয়েছে এক তরুণ; সেই বস্তা মাথায় চাপিয়ে ছুটছে। উন্মাদের মতো। লুঙ্গিটা তার পরনের। পরনের লুঙ্গি খুলে বস্তা বানিয়েছে। লজ্জা সংকোচের কোনো বালাই নেই। ছুটছে। খেয়াল নেই যে সে দিগম্বর, কেননা মাথায় তার টাকার বোঝা। 

ষোলো তারিখে চতুর্দিকে গুলির শব্দ। থামছে না। সবটাই আনন্দের, উল্লাসের, বিজয়ের। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, রোগ কেটে যাওয়া মানেই স্বাস্থ্য ফিরে আসা নয়। স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য সময় লাগবে। নেতৃত্বও প্রয়োজন হবে। সেই নেতৃত্ব পাওয়া যাবে কি, যে নেতৃত্ব পারবে এত সব বিশৃঙ্খলা ও পরস্পরবিরোধী শক্তিকে একত্র করতে, মানুষ ও সম্পদের যে ক্ষতি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে তা পূরণের ব্যবস্থা নিতে।

ওই প্রশ্নের জবাব অবশ্য পাওয়া গেছে। গত বায়ান্ন বছর ধরেই।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //