রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিসমাপ্তি কবে

সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেন যুদ্ধ কতকগুলো নতুন বাঁক নিয়েছে এবং বিশ্ব রাজনীতিতেও কতকগুলো নতুন ঘটনা ঘটেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি তো বটেই, কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও যে কোনো বৈশ্বিক ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয়। এক অর্থে যে কোনো বৈশ্বিক ঘটনা যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে স্পর্শ করে, তা কোনো না কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনাও বটে।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিকে সূচনা দিবস ধরলে, ইউক্রেন যুদ্ধ প্রায় দুই বছর সময় অতিক্রম করছে। বর্তমান বাজারকেন্দ্রিক পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে যে কোনো বৈশ্বিক সমস্যা দীর্ঘমেয়াদে চললে, তাকে মোকাবিলা করা কিংবা আপাতত মানিয়ে নেওয়া ও তার বিপরীতে টিকে থাকার একটি প্রক্রিয়া গড়ে তোলে। ফলে ওই সংকট ক্রমশ তার গুরুত্ব হারায়। এ ছাড়া বিশ্ব তাকে কেন্দ্র করেই থেমে থাকে না, আরও অনেক ঘটনা ঘটে। বিশ্ব জনমানস তখন সেদিকে তার চিত্ত নিক্ষেপ করে। সাম্প্রতিক ফিলিস্তিনের গাজা সংকট, ভারত-কানাডার সম্পর্কের টানাপড়েন, আসন্ন আমেরিকা, রাশিয়া ও ভারতের নির্বাচন, জাতিসংঘের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কের নতুন অধ্যায় রাজনৈতিক অনেক দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এ ছাড়াও বিশ্ব নতুন অর্থনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার দিকেও বোধকরি এগোচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্কের নতুন মেরুকরণ হচ্ছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধকে নতুন করে বোঝার একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। 

আগেও জেলেনস্কি অভিযোগ উত্থাপন করেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অস্ত্রের মুলো ঝুলিয়ে রুশ ফেডারেশন ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে তার দেশকে প্রক্সি যুদ্ধে ব্যবহার করছে, যদিও ইউক্রেন এখনো ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র নয়। আর দীর্ঘ চেষ্টা করেও ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য পদ লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে তিনি পশ্চিমাদের মত অগ্রাহ্য করে যুদ্ধে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে তাদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কৌশল ও প্রযুক্তির প্রথম সারির বিশেষজ্ঞ ইয়র্ক টাউন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো স্টিফেন ব্রাইয়েন এশিয়া টাইমসে কিছু চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলছেন যে, তার সহকর্মী ও বন্ধু ল্যারি জনসন, যিনি ভূতপূর্ব সিআইএ বিষয়ক বিশ্লেষকও বটে, মনে করছেন যে, সিআইএ ও এমআইসিক্স উভয়েই জেলেনস্কিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ছক ইতোমধ্যে করে ফেলেছেন। হয় সামনের মার্চে তাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দিতে বাধ্য করা হবে, আর তার মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্রপতি আসার পট তৈরি করা হবে, নতুবা কোনো জনবিক্ষোভের পট তৈরি করে তাকে ক্ষমতা থেকে হটানো হবে। এ রকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পররাষ্ট্র বিষয়ক উপসচিব ভিক্টোরিয়া জেন নিউল্যান্ড এবং ইউক্রেনে নিযুক্ত ভূতপূর্ব মার্কিন রাষ্ট্রদূত জিউফ্রি পিয়াটের ২০১৪ সালের একটি টেলিফোন বার্তালাপ সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে। তারা ইউক্রেনে পশ্চিমের অনুকূলে একজন রাষ্ট্রপতি খুঁজছিলেন এবং এ কাজে তৎকালীন মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের সাহায্যও তারা কামনা করেছিলেন। বর্তমানে রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত জ্যাক সুলিভানের সাহায্যও তারা সে সময় চেয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, ওই বছরই রুশদেশ সমর্থিত রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ফেডেরোভিচ ইয়ানুকোভিচকে ‘মর্যাদার বিপ্লব’-এর নাম করে ক্ষমতা থেকে হটানো হয়। ইউক্রেন যুদ্ধের সেটিও অন্যতম কারণ। ইউক্রেনের ভূতপূর্ব সামরিক বাহিনীর প্রধান ভেলেরি ছিলেন ফেডেরোভিচ জালুঝিনি, যাকে বিবেচনা করা হতো বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী একশ জন মানুষের একজন, সাম্প্রতিককালে তার সহযোগী মেজর জেন্নাদি চাস্তুয়াকভের মৃত্যুর পেছনেও অনেকে পশ্চিমের ছায়া দেখছেন। 

অন্যদিকে পশ্চিম ও গোটা দুনিয়া ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সাম্প্রতিক গাজা সংকটে। নতুন বিশ্বসংকট ইউক্রেন যুদ্ধকে অনেকটা গুরুত্বহীন করে ফেলেছে। এর প্রভাব পড়েছে পশ্চিম থেকে ইউক্রেনের রসদ সরবরাহের ওপর। বিবিসির জেসিকা পার্কার লিখেছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। আর আমরা দেখছি যে, সামনে আরও কঠিন সময় আসতে পারে নির্বাচনে জো বাইডেন পরাজিত হলে। ইউক্রেন যুদ্ধের ঘোর বিরোধী ছিলেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সামনের নির্বাচনে তার ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। জনজরিপে ৪৭% জনসমর্থন পেয়ে ট্রাম্প এগিয়ে, অন্যদিকে বাইডেন পেয়েছেন ৪৩% জনসমর্থন। ট্রাম্পের সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সম্পর্কও ভালো। তিনি পুতিনকে সম্মান করেন বলেও বেশ কয়েকবার জানিয়েছেন। অন্যদিকে ট্রাম্প এও বলেছেন যে, তিনি ক্ষমতায় থাকলে ইউক্রেন যুদ্ধ হতো না। পুতিনকে সরানোর চেষ্টাও হয়েছে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। অলিগার্ক ও ওয়াগনার গ্রুপের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব ইয়েভগেনি ভিক্টোরোভিচ প্রিগোজিন এ বছরের জুনে পুতিনবিরোধী এক ব্যর্থ অভ্যুত্থান করেন। তার আগে মে মাসে ক্রেমলিনে ইউক্রেন সামরিক বাহিনী বোমা বিস্ফোরণ করে। রাশিয়ার দাবি, এটি ছিল পুতিনকে হত্যার এক প্রচেষ্টা। সেপ্টেম্বরে মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গের কিছু আইনপ্রণেতা পুতিনকে ক্ষমতা থেকে সরানোর আহ্বান জানান। বলা বাহুল্য যে, এর সবই ব্যর্থ হয়েছে। ২০২৪ সালে রাশিয়াতে অষ্টম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হতে যাচ্ছে। তবে পুতিনের ক্ষমতা থেকে পড়ে যাওয়ার সে রকম কোনো আলামত নেই। অন্যদিকে আমেরিকা ও তার মিত্ররা ফিলিস্তিন সঙ্কটের কোনো সমাধান বের করতে পারেননি। ইউক্রেন যুদ্ধেও তাদের অবস্থা তথৈবচ। রাশিয়া, চীন ও ভারতও তাদের স্বমুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অনেকটা সাফল্য অর্জন করেছে। ফলে ডলারের একক কর্তৃত্ববিরোধী আন্দোলন অনেকটাই সাফল্য পেয়েছে। সামনের বছর ভারতেও নির্বাচন হতে যাচ্ছে। বর্তমান নরেন্দ্র মোদি সরকারের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ভালো। আর বিজেপিরও গণেশ উল্টানোর সম্ভাবনা ক্ষীণই মনে হচ্ছে। রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস খুব একটা জোরালো অবস্থানে আছে বলে মনে হয় না। আগের বার লিখেছিলাম যে, আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের মাঝামাঝি এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে। এখন সেই সঙ্গে আরও বলছি, বড়জোর তা ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত চলতে পারে। তার বেশি নয়। 

লেখক: গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //