শরিকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ‘সমঝোতা’

আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসনে ছাড় দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গণমাধ্যমে যেদিন (১৭ ডিসেম্বর) এই সংবাদ প্রকাশ হলো, সেদিন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এটি ‘সমঝোতা’ নয়, বরং তাদের ‘রাজনৈতিক কৌশল’। একই দিন আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলোকে আরও ৬টি আসন ছেড়ে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। 

প্রশ্ন হলো আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দলকেও কেন জাতীয় পার্টি, এমনকি ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের সঙ্গেও এরকম ‘সমঝোতা’ করতে হয় বা এ ধরনের ‘কৌশল’ নিতে হয়? আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ও শক্তি এত বেশি যে, একমাত্র বিএনপি ছাড়া ভোটের রাজনীতিতে আর কেউই তার প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। তারপরও দেশের প্রধান দুটি দল অন্যান্য দল নিয়ে জোট গঠন করে। কারণ ছোট ছোট দলকে বড় দলগুলো কাছে রাখতে চায় যাতে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী বড় দলের সঙ্গে জোট করতে না পারে। এখানে ভোটের চেয়েও দল ভারী দেখানো এবং প্রতিপক্ষের ওপর নৈতিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করাও একটি লক্ষ্য।

তবে এবার জাতীয় পার্টি এবং অন্য দলগুলোকে ৩২টি আসন ছেড়ে দেওয়ার কারণ নির্বাচনে বড় সংখ্যক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। কেননা সরকার তথা ক্ষমতাসীন দলের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিগত দুটি নির্বাচনের মতো এবারের নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হতে না দেওয়া। দেশের অভ্যন্তরে বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দলের চাপকে সরকারি দল খুব একটা পাত্তা না দিলেও বিদেশি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ আমলে নিতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু বহুদিন ধরেই অবাধ-সুষ্ঠু-অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য ভোটের বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করছে এবং তাদের এই অবস্থানের পেছনে কারণ যা-ই থাক না কেন, যেহেতু তারা বিরাট শক্তি এবং তারা সত্যি সত্যি কোনো দেশের বিরুদ্ধে চলে গেলে তাদের মিত্ররাও সেই দেশের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে, সে কারণে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যত সমালোচনাই করুক না কেন, অন্তত বাংলাদেশের ওপর যাতে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক অবরোধ না আসে; শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সদস্য নিয়োগ কোনো ধরনের জটিলতায় না পড়ে; যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি না হয়; যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে স্যাংশন বা ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় না পড়েন, সেজন্য সরকার বেশ সতর্ক। সরকার ও ক্ষমতাসীন দল বাইরে যা কিছুই বলুক না কেন, ভেতরে ভেতরে তারা এমন একটি অবস্থান ধরে রাখতে চায় যাতে তারা পুনরায় সরকার গঠন করতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র তথা তার মিত্র দেশসমূহের সঙ্গেও সম্পর্ক খুব বেশি খারাপ না হয়। 

মনে রাখা দরকার, পৃথিবীর অসংখ্য দেশেই গণতন্ত্র নেই। সেসব দেশের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক আছে। ব্যবসা আছে। বাংলাদেশেও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রয়েছে। এই অঞ্চলে তার প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা বজায় থাকাকে যুক্তরাষ্ট্র জরুরি মনে করে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, প্রতিবেশী ভারতের স্বার্থেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি। এর বাইরে বিবিধ ব্যবসায়িক ও কূটনৈতিক স্বার্থও রয়েছে। অর্থাৎ বিষয়টা একপক্ষীয় নয়। অনেকটা ‘উইন উইন’। 

এসব কারণে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার ব্যাপারে সরকার ও আওয়ামী লীগের ওপরে বিরাট চাপ রয়েছে। বিএনপি ভোটে থাকলে সেই চাপ মোকাবিলা করা যত কঠিন হতো, বিএনপি না থাকায় সেই চাপ অনেক কম। বরং এখনকার চাপ হচ্ছে ভোটে বেশি সংখ্যক দলের অংশগ্রহণ এবং ভোটকেন্দ্রে অন্তত ৫০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। 

যেহেতু বিএনপি মাঠে নেই এবং জাতীয় পার্টি ও অন্য শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি হয়েছে, ফলে বাকি আসনগুলোয় আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এখন পর্যন্ত এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় অবস্থান সহনশীল। নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলে সব প্রার্থীর টার্গেট থাকবে তাদের ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। তাছাড়া নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণাও জমজমাট হবে। সব মিলিয়ে ভোটকে অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং উৎসবমুখর দেখানোর জন্য এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা নমনীয়।  

আর এ কারণেই তাদেরকে জাতীয় পার্টি এবং শরিক অন্য দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় যেতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টিকে ২৬টি এবং শরিকদের ৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ এই আসনগুলোয় আওয়ামী লীগের প্রার্থী নেই। যদি এই সমঝোতা না হতো, তাহলে কী হতো? হয়তো জাতীয় পার্টি এবং শরিক দলগুলো ভোট বর্জন করত। 

স্মরণ করা যেতে পারে, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করেছেন। এমনকি এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলেও একাধিকবার মন্তব্য করেছেন। এসব কারণে অনেকের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছিল যে জাতীয় পার্টি হয়তো শেষ পর্যন্ত নির্দলীয় সরকার না হলে ভোট বর্জন করবে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের লক্ষ্য ছিল অন্তত গোটা তিরিশেক আসনে জয় নিশ্চিত করা।

সরকারি দলও জানে যে, জাতীয় পার্টি ভোট বর্জন করলে সেটি চলে যেত বিএনপির পক্ষে। বিএনপি তখন জোর গলায় বলতে পারত যে, আওয়ামী লীগের শরিকরাই তাদের সঙ্গে নেই। ফলে সরকারবিরোধী আন্দোলন কতটা তীব্র হতো তার চেয়ে বড় কথা, এই বিষয়টি বহির্বিশ্বে আওয়ামী লীগকে আরও বেশি চাপে ফেলত। ফলে সেই পরিস্থিতি এড়ানোর একমাত্র উপায় হলো কিছু আসনে শরিক দলগুলোর বিজয় নিশ্চিত করা। তাতে আওয়ামী লীগের কোনো ক্ষতি নেই।  বৃহত্তর দলের স্বার্থে আওয়ামী লীগের সামনে অন্য কোনো বিকল্পও ছিল না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //