বিজয়ের মাস

ঐক্যের প্রতিশ্রুতি ও সমৃদ্ধির অঙ্গীকার

বিজয় সৌভাগ্যের প্রতীক। প্রতিটি মানুষের জীবনে বিজয় আসে। কিন্তু সেই বিজয় যদি হয় জাতীয় জীবনে, যদি একটি পরাধীন দেশকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা এনে দেওয়ার, তাহলে এই আনন্দের কোনো তুলনা চলে না। ১৯৭১ সালে নয় মাস যুদ্ধের ভেতর দিয়ে আমরা সেই বিজয় অর্জন করেছি। সুতরাং আমাদের এ বিজয়ের রং অন্যরকম।

‘বিজয়’ এই শব্দটির সঙ্গে মানুষের চেতনার রং মিলেমিশে থাকে। সেই রং আনন্দের, উচ্ছ্বাসের, উন্মুখ অভিব্যক্তির। সেই রং ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মানের। সেই রং কখনো কখনো মিশে থাকে অশ্রুসিক্ত মানুষের আর্তনাদের সঙ্গে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধশেষে আমাদের বিজয় অর্জিত হয়। সুতরাং আমাদের বিজয়ের রং অভিমিশ্র আনন্দ-বেদনা এবং শোক ও সম্ভ্রমের। 

আমাদের প্রাণের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার পঞ্চান্ন বছরের ছোট এক জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এই বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য। শৈশব থেকে তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, পাকিস্তানি শাসকদের নিপীড়ন-নির্যাতন, অন্যায় ও অবিচারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত না করতে পারলে কোনোদিন মানুষের সত্যিকারের মুক্তি আসবে না। সুতরাং তিনি নিরন্তর সংগ্রাম, মিছিল-মিটিং ও প্রচারণার মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিশেষে এদেশের সকল মানুষকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান যে জীবন যাপন করেছিলেন, সেই জীবন মিলেমিশে আছে এদেশের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তার গভীর বন্ধনে, বিশ্বাস ও আস্থার অঙ্গীকারে। ফলে অনিবার্যভাবেই এদেশের মানুষ তার নেতৃত্বে সংঘটিত হতে হতে একসময় বিস্ময়কর এক শক্তির উৎসে পরিণত হয়। আর সেই শক্তির পরিচয় আছে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ ও উজ্জীবিত হয়ে ওঠার মধ্যে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি পরিষ্কারভাবে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেয় যে, তারা আর বিচ্ছিন্ন নয়; তারা সমবেত, একত্রিত, আর কোনো অন্যায় মেনে নেবে না, কোনো অবিচারের কাছে মাথানত করবে না। কিন্তু নির্বোধ, অপরিণামদর্শী শোষক শ্রেণি কখনোই সুন্দরের শক্তি ও মাহাত্ম্য বুঝতে পারে না এবং সত্য ও সুন্দরের কাছে মাথা নত করতে চায় না। তারা তাদের দুর্বুদ্ধি, ষড়যন্ত্র, নিষ্ঠুরতা দিয়ে সবসময়ই সত্য ও সুন্দরকে পরাভূত করতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠে না। 

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের মঙ্গল, তাদের কল্যাণের কথা ভেবে আত্মগোপন না করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের হাতে ধরা দেন এবং তাকে অন্তরিণ করা হয় অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে। তার এই নির্বাসন, কারারুদ্ধ অবস্থা, নিপীড়ন-নির্যাতন বাঙালি জাতিকে আরও বেশি শক্তিমান, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, প্রত্যয়ী ও অঙ্গীকারাবদ্ধ করে তোলে। 

সময় এক নির্মম ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা। একটি শান্তিকামী, গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত একটি জাতিকে পাকিস্তানি অপশক্তির প্ররোচনায় যুদ্ধকেই অনিবার্য করে তুলতে হয়। সেই যুদ্ধে কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, মা হারিয়েছেন স্নেহের সন্তানকে, সন্তান হারিয়েছেন গভীর আশ্রয়স্থল বাবা-মাকে; স্ত্রী হারিয়েছেন তার প্রিয়তম স্বামীকে, বোন হারিয়েছেন প্রিয় ভাইটিকে। এই বিপুল হারানোর পটভূমিতে আমরা অর্জন করি আমাদের বিজয়। সুতরাং বিজয়ের রং যে বহুতর আনন্দের রঙে রঙিন ও ফুল্ল হয়ে উঠবে, তা নয়- গভীর বেদনা আর মর্মন্তুদ যন্ত্রণারও হতে পারে। 

প্রতিটি বছর আমাদের জীবনে বিজয় আসে অফুরন্ত প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা নিয়ে, জাতিগত ঐক্য আর সমৃদ্ধির বার্তা নিয়ে, একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনের আহ্বান নিয়ে। আজ আমরা যে বিজয়ের সম্মুখীন হচ্ছি তার রূপ-রস-ঐশ্বর্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। পেছনের দিকে তাকানোর সময় নেই এখন। এখন বিজয় মানে ঐক্যের প্রতিশ্রুতি, সমৃদ্ধির অঙ্গীকার। 

বিজয়ের আরেক নাম অধিকার। খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অধিকার। এই অধিকার আমরা অনেকাংশে অর্জন করেছি। তারপরই আসে মুক্তচিন্তা, গণতান্ত্রিক জীবনাচরণ, অসাম্প্রদায়িক জীবনতৃষ্ণা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অধিকার। একই সঙ্গে মিথ্যার বিরুদ্ধে, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে, শোষণ-নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস ও শক্তি অর্জন করাও হবে বিজয়ের প্রেরণা।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পর থেকে আমরা এই বিজয় অর্জন করেছি। সেই থেকে চলছে আমাদের দেশকে নিজেদের মতো করে গড়ে তোলার সংগ্রাম- মুক্তিযুদ্ধের মতোই আরেক যুদ্ধ। কিন্তু সেই যাত্রাপথের বিভিন্ন মোড়ে ওঁৎপেতে থাকা শত্রুদের নির্মম আক্রমণের শিকার হয়েছে জাতি। স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে দীর্ঘদিন পিষ্ট হয়েছে, পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু কিছুতেই বিজয়োন্মত্ত জাতির গতিকে প্রতিহত করতে পারেনি কেউই। গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশের ইতিহাসে মানব উন্নয়নের যে বিচিত্র ক্ষেত্র অর্জন হয়েছে তার সূচক অসাধারণ এবং ঈর্ষণীয়। শিক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন, মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে অগ্রগতি লাভ করেছে তা সত্যিই অসাধারণ। 

তারপরও বলব, আমরা এখনো অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। অসাম্প্রদায়িক জীবনভাবনার যে আলোকোজ্জ্বল অধ্যায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল, বিজয় লাভ করেছিল, সেই জীবনবাস্তবতা আজও আমরা লাভ করেতে পারিনি। এখনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সৌন্দর্য পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সম্পদের সুষম বণ্টনের যে আদর্শ নিয়ে এদেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই সাম্যের বাংলাদেশ এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাঙালি জাতিসত্তার দীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির যে সমৃদ্ধ ভা-ার আছে সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে লালন করার ক্ষেত্রেও অনেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে হবে। 

একটি গুণগত শিক্ষা বিস্তারের ভেতর দিয়ে; মানবিক, অসাম্প্রদায়িক ও দেশপ্রেমমূলক শিক্ষার ভেতর দিয়ে আমরা নিশ্চয়ই সেই অভীষ্টে পৌঁছতে পারব, যেখানে আমাদের স্বাধীনতা এবং বিজয়ের আদর্শ ও লক্ষ্যগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে। আমরা নিশ্চয়ই অদূর ভবিষ্যতে এমন এক বাংলাদেশকে দেখব, যে বাংলাদেশে দারিদ্র্য থাকবে না, সাম্প্রদায়িকতা ও অসহিষ্ণুতা থাকবে না, অন্যায়-অবিচার ও শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না। নিশ্চয়ই আমাদের বিজয়ের এই মহান আদর্শ ও ন্যায়সূত্রগুলো আমরা খুব শীঘ্রই অর্জন করতে পারব। আমাদের বিজয় আমাদের মহিমা, ঐক্য, সমৃদ্ধি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আমাদের বিজয় আমাদের অফুরন্ত ভালোবাসা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //