সাজানো-গোছানো নির্বাচনী কনভয়

দেশে ১২তম সংসদ নির্বাচনের প্রায় সকল আয়োজন সম্পন্ন। এখন শুধু নির্ধারিত তারিখের আনুষ্ঠানিকতা বাকি। বিশ্বের বড় বড় গণতান্ত্রিক দেশ প্রকাশ্যে না বললেও আগামী নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে, ঠিক যেমন করেছিল ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে। ১০৫ জন নোবেল বিজয়ীসহ প্রায় ২০০ বিশ্বনেতার চিঠি অনুসারে, বাংলাদেশে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচনে বৈধতা ছিল না। এবারও সেই হেভিওয়েট দেশগুলো আগামী নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ কেন একতরফা নির্বাচন করতে যাচ্ছে?

বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন বয়কটের কারণে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তাদের মিত্ররা নির্বাচন বয়কট করার ডাক দিয়েছে। জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতারাও আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে ছিলেন। তাহলে কেন প্রধান বিরোধী দল, এমনকি সরকার সমর্থক কিছু দলের তৃণমূল নেতাও শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে দেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি বোঝাটা অপরিহার্য।

বাংলাদেশে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে চারটি নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে পরিচিত ‘টেকনোক্র্যাট’ নির্বাচনকালীন সরকার ছিল। কিন্তু ব্যবস্থাটি সংশোধনের প্রয়োজনের কথা বলে ২০১১ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর আওয়ামী লীগ সংসদে নিজেদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ব্যবস্থাটি বাতিল করে। আর এর মধ্য দিয়ে ‘স্থায়ী’ রাজনৈতিক সংকটও জন্মলাভ করে।

ক্ষমতাসীন দলগুলো কর্তৃক আমলাতন্ত্রে রাজনীতিকরণের কারণে বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা কঠিন। নির্বাচনী দৌড়ে এই আমলারাই নিজ নিজ এলাকায় প্রিসাইডিং অফিসারে পরিণত হন। মনোনয়ন অনুমোদন থেকে শুরু করে ভোট গণনা পর্যন্ত সমস্ত কিছুর দায়িত্বে থাকা ওই আমলাদের ক্ষমতাসীন দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব যে কোনো বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং তৃণমূল সেটা অন্য যে কারও চেয়ে বেশি ভালো জানে।

টেকনিক্যালি নির্বাচন কমিশনারদেরই চূড়ান্ত বক্তব্য রাখার এবং চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু তাদের ভূমিকাও সমানভাবে সন্দেহজনক। উদাহরণস্বরূপ নির্বাচন কমিশন ২০২৩ সালের আগস্টে একেবারে ন্যূনতম জনউপস্থিতির দুটি কম পরিচিত রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধিত করেছিল, যদিও প্রায় এক ডজন ‘সিরিয়াস প্রতিযোগী’র আবেদন তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল।

এক মন্ত্রীর ভাষ্য থেকে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে সরকার নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য এক দিকে বিএনপিকে প্রলোভন দেখিয়ে মাঠে নামাতে চেয়েছে, আবার কোনো কারণে নির্বাচন খানিকটা ‘ফেয়ার’ হয়ে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে ভেবে তফসিল ঘোষণার আগেই সিনিয়র নেতা ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়সীমার আগে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়নি। এর মাধ্যমে কার্যকরভাবে তৃণমূল এবং অন্যান্য নেতাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য রাজি করানোর সম্ভাবনাকে (যত কমই হোক না কেন) হত্যা করা হয়েছে।

নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন শুধু দেশের ভেতরেই নয়, সারাবিশ্বেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাই সুষ্ঠু ভোটের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার বিলুপ্ত করে নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। দেশের মানুষ যেভাবে অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনও তা-ই চায়।’

বিএনপির বক্তব্যকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে প্রতিহত কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ করা সম্ভব না। তিনি আরও বলেন, ‘যারা মনে করেছিল কে আসে কে না আসে... ফুল কিন্তু ফুটতে শুরু করেছে। আরও অনেক ফুল ফুটবে। মনোনয়ন ফরম নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া পর্যন্ত শত ফুল ফুটবে। কাজেই এ নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।’

এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক করতে দেশি-বিদেশি সব পক্ষের দাবি ও আহ্বান উপেক্ষা করে শুধু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার দোহাই দিয়ে কোনো রকম রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই ক্ষমতাসীনদের প্ররোচনায় তড়িঘড়ি করে তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা অংশীদারদের কাছে দেওয়া বক্তব্যে নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথাও তুলে ধরেছিল ইসি। 

অতীতে আর কখনো নির্বাচনের আগেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করার পক্ষে দেশি-বিদেশি এমন চাপ ও ধারাবাহিক রাজনৈতিক কর্মসূচি দেখা যায়নি। আন্দোলন দমনে বেপরোয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণগ্রেপ্তার, নিপীড়ন এবং আদালতের মাধ্যমে দণ্ডাদেশ দেওয়ার এমন নজিরও আর কখনো দেখা যায়নি। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকেও নির্বাচন বর্জন ও নির্বাচনবিরোধী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা দিয়ে নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার বিরোধী এক নজিরবিহীন ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে।

নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে, ভোটারদের আস্থা ও অংশগ্রহণের পরিবেশ নিশ্চিত করতে শেষ সময় পর্যন্ত সম্ভাব্য সব উপায় অবলম্বন করা। সে দায়িত্ব পালনে ইসির সদিচ্ছার প্রতিফলন দেখা না গেলেও নির্বাচন বর্জনকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশের অধিকার হরণের নির্দেশনা জারি করছে। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে তিনটি প্রধান দলের মধ্যে সংলাপ-সমঝোতার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে একটি জরুরি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করে মূলত সরকারি দলের মতামতের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন বলে মনে হয়। 

একটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক লিখেছেন, ‘নির্বাচন আসন্ন। এই সময়টাতে আমাদের ব্যস্ত থাকার কথা যোগ্য প্রার্থীর খোঁজে এবং আগে যারা নিরাশ করেছে, তাদেরকে শাস্তি দিতে। কিন্তু এর পরিবর্তে আমরা প্রতিটি রাত পার করছি উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর আশঙ্কায়, কখন যেন সাদা পোশাকের পুলিশ বা তাদের বেশে অন্য কেউ জোর করে ঘরে ঢুকে “গুম” করে দেয়। অপরাধ হলো, আমার কোনো বন্ধু বা আত্মীয় কোনো এক সময়, কোনো এক জায়গায় বিরোধী দলের কোনো এক মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন।

দেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাদেরকে আতঙ্কিত করছে। আর এর জন্য দায়ী সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই। এ ক্ষেত্রে সরকারের দায় বেশি। কারণ বিরোধী দল রাস্তায় নেমে আন্দোলন ও সহিংসতা শুরুর আগে সরকার বিদ্যমান মতভেদ নিরসনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি।’

প্রধানমন্ত্রী বারবার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের অঙ্গীকারের কথা বলে এসেছেন। কিন্তু তার নিজের এবং দলের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড কি তাই বলে? দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুলিশ যাদেরকে খুঁজছে, তাদের না পেলে পরিবারের সদস্য, ড্রাইভার, সহকারী, এমনকি বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়দের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। 

এখন প্রায় প্রতিদিনই বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী নেতা, ব্যাংকার ও বুদ্ধিজীবীরা সতর্ক করছেন যে আমাদের অর্থনীতি ভঙ্গুর অবস্থায় আছে, এবং জনগণ উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে জর্জরিত। এই অবস্থার মধ্যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে একটি বৃহৎ দলকে গ্রেপ্তার করে, ভেঙেচুরে খণ্ড খণ্ড করে, এক খণ্ডকে প্রলোভন দেখিয়ে দলে টানা। এরই মধ্যে সরকার ২৯টি দলকে নির্বাচনে টানতে সফল হয়েছে। এরা দরদাম করে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য আসন বাগাতে পেরেছে।

অথচ প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে সারা দেশে তাদের মোট ৮ হাজার ৯৫১ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাজনীতিবিদদের শাস্তি দিতে কীভাবে আইন ব্যবহার করা হচ্ছে, তার উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে জ্যেষ্ঠ ও সম্মানিত রাজনীতিবিদ এবং বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ঘটনাটি। তার বয়স ৭৫, হৃদরোগসহ নানা অসুস্থতায় ভুগছেন। গত ২৯ অক্টোবর সকালে ‘প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা চালানো’র মতো কারণ দেখিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

নতুন গজিয়ে ওঠা রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারি দলের কাছে বিজয়ের নিশ্চয়তা প্রার্থনা করছে। এ জন্য তারা সরকারি দলের প্রতীক ব্যবহার থেকে শুরু করে সরকারের কাছ থেকে নানা সহায়তা পেতে মরিয়া। না পেলে অভিমান করার ঘটনাও ঘটছে। সরকার যেহেতু আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপে রয়েছে, তাই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে এই কৌশল নেওয়া হয়েছে। মোটের ওপর যেটা দেখা যাচ্ছে, সরকার তার সকল প্রশাসনিক শক্তি প্রয়োগ করে একটি নির্বাচন করবে। সেই নির্বাচনে সাজানো বিরোধী দল, নির্বাচনী কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসমূহ, ব্যাপক শক্তিশালী আমলা বাহিনী, সরকারের ‘সিপাহসালার’ এবং সরকারের খুদ-কুঁড়ো গিলে ঘাড়ে-গর্দানে বিস্তর চর্বি জমানো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সবাই মিলে এক মহাযজ্ঞ ঘটিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা পয়মাল করে আবারও ৫ বছরের জন্য (এবং আগামী আরও দশ-পনেরো বছর) পাকাপাকি ক্ষমতায় আসীনের ব্যবস্থা পোক্ত করা হলো। দেশ? তাদের ভাবনায় দেশ নেই। ক্ষমতাই শেষ কথা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //