নির্বাচন-পরবর্তী রাজনীতি

বহু হুমকি-ধমকি, আগুন-নাশকতা, জল্পনা-কল্পনা পেছনে ফেলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ বলতে পারেন যে, এ তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগের সরকারই রয়েছে। কথাটা সর্বাংশে সঠিক নয়। যে কোনো জাতির জন্যই নির্বাচন মানে নতুন পরিস্থিতি, চ্যালেঞ্জ। ফেলে আসা দিনগুলোর সাফল্য-অর্জন, অভিজ্ঞতা-শিক্ষা, সীমাবদ্ধতা-ব্যর্থতার ওপর দাঁড়িয়ে নতুনভাবে শুরু করা হচ্ছে নতুন মন্ত্রিসভার কাজ। এজন্য ‘হানিমুন পিরিয়ড’ তথা ‘মধুচন্দ্রিমার সময়কাল’ (১০০ দিন) কথাটা রাজনীতিতে একটি মিষ্টিমধুর শব্দ।

গত ১৪ জানুয়ারি ছিল মন্ত্রিসভার সদস্যদের আনুষ্ঠানিকভাবে কাজে যোগ দেওয়ার প্রথম দিন। পত্রিকা পড়ে জানা গেল, নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়ে কমবেশি সবাই নির্বাচনী ইশতেহার সামনে রেখে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি বরদাশত করব না। দ্রব্যমূূল্য নিয়ন্ত্রণ ও কারসাজিতে জড়িতদের নজরদারির এবং সরকারি কেনাকাটায় জবাবদিহিতা-স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানরা কিংবা রাষ্ট্রদূতরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দিত করেছেন। জাপান, ভারত, চীন, রাশিয়া প্রভৃতি দেশ এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার বঙ্গভবনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কোনো দেশই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়নি।

প্রসঙ্গত নির্বাচনের আগে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এই অবস্থানের সুফল নিঃসন্দেহে পাবে আওয়ামী লীগের নতুন সরকার।

আওয়ামী লীগ যখন সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার প্রত্যয় এবং ‘উন্নয়ন দৃশ্যমান এবার হবে কর্মসংস্থান’ সেøাগান বাস্তবায়নে কাজ শুরু করছে, তখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান দল বিএনপি কী করছে তা জানা আগ্রহোদ্দীপক বৈকি! খুব গভীরভাবে লক্ষ করলেই দেখা যাবে, সংবাদমাধ্যমে বিএনপির যেমন কোনো খবর চোখে পড়ে না, তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিএনপিকে নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হচ্ছে না। নির্বাচনের পর পুলিশ চাবি দেয়নি অভিযোগ উত্থাপন করে ১১ জানুয়ারি তালা ভেঙে অফিসে প্রবেশ করে বিএনপি নেতৃবৃন্দ। এদিকে পুলিশ তালা দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বলেছে নিরাপত্তাকর্মী সোহাগ ২৮ অক্টোবর রাতে অফিসে ছিল এবং পরদিন সকালে তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে চলে গেছে। দুই বিপরীত মেরুর কথা কোনটা সত্য তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সোহাগ কোথায় এবং ওর বক্তব্য কী তা এখনো জানা যায়নি।

১৩ জানুয়ারি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, নির্বাচনের পর এখন আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি কী হবে, তা নিয়ে প্রতিদিন নেতারা বৈঠক করছেন।

বাস্তবে ২৮ অক্টোবরের পর থেকে জামায়াতসহ কতক ছোট দল নিয়ে বিএনপি সরকার পতন ও নির্বাচন বানচালের জন্য যে হরতাল-অবরোধ-অসহযোগের কর্মসূচি দিয়েছিল, ওই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য জনগণ তো নয়ই, এমনকি বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরাও মাঠে নামেনি। মুক্ত নেতারা কোথায়- এই প্রশ্নটি এখন বিএনপি ও এর সহযোগী দলগুলোর মধ্যে ব্যাপকভাবে উঠেছে। ১৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপি বিক্ষোভ মিছিল করেছে, শান্তিনগর থেকে কাকরাইল পর্যন্ত। এতটুকু রাস্তা অতিক্রমকারী মিছিল দাবি আদায় করতে পারবে, এমনটা মনে করা বাতুলতামাত্র।

নির্বাচনের পর দলটি যদি এখন তাদের অবস্থানগত শক্তি-সামর্থ্য নিজে অনুমান করতে না পারে, তবে দিনের পর দিন আলোচনা করেও পথ পাবে না। নির্বাচনের পর বিএনপির জন্য একটি ভালো খবর হচ্ছে, ১৫৬ দিন পর শরীর ভালো থাকায় নেত্রী খালেদা জিয়া বাসায় গেছেন। খবরটা অবশ্য আওয়ামী লীগের জন্যও ভালো। কেননা এমন অভিযোগ দলটিকে দেওয়া যাবে না যে, তার চিকিৎসার ব্যাপারে সরকার কোনো বাধা দিয়েছে। 

বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী উল্লেখিত সংবাদ সম্মেলনে ইতিহাস স্মরণে এনে বলেছেন, ১৯৬২ সালেও বোঝা যায় নাই ১৯৭১ আসছে। কথাটা সত্য। কিন্তু পরিস্থিতির ভিন্নতা অনুধাবনে তিনি সম্পূর্ণ ভুল করেছেন। এমন মূল্যায়ন হলে সবই ভুল হবে। তখন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জোয়ার। ষাটের দশকের সূচনা থেকেই গণজাগরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। নেতা-নেতৃত্ব-জনগণ ছিল লক্ষ্যাভিমুখী। এখন কি তেমন কোনো জোয়ার বা জাগরণ আছে! সর্বোপরি বিএনপি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে কিছুই স্থির রাখতে পারছে না, ২০১০ সালে হাইকোর্টের রায়ে খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উৎখাত করা হলো। বিএনপি নেত্রী বললেন তিনি ‘বাস্তুহারা’। তখন থেকেই সরকার পতনের আন্দোলনের শুরু। এভাবে চলতে চলতে এলো ২০১৪ সালের নির্বাচন। বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে সরকার উৎখাত, নির্বাচন বানচাল করার ডাক দিল। চলল হরতাল-অবরোধের নামে প্রকাশ্যে-গোপনে জ্বালাও-পোড়াও। কিছুতেই কিছু হলো না। গেল কিছু মানুষের জীবন। নষ্ট হলো জনগণের সম্পদ। বিএনপি হরতাল-অবরোধ তুলে নিতেও ভুলে গেল।

এমন কোনো মাঠে মারা যাওয়া আন্দোলন কি ষাটের দশকে হয়েছে? ২০১৪ সাল থেকে শিক্ষা নিয়ে বিএনপি জামায়াতকে দূরে ঠেলে ড. কামালকে সামনে রেখে ২০১৮ সালে নির্বাচনে শামিল হয়েছিল। সেই ধারাতেও বিএনপি থাকেনি। ২০২৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি আবার পাল্টে গেল। ড. কামাল এবারে আর রইলেন না। জামায়াতকে আবার কাছে টানল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা না দিয়ে বিএনপি হঠাৎ গেল ২০১৪ সালের হটাও সরকার, বানচাল কর নির্বাচন এবং হরতাল-অবরোধ ধারায়। বিএনপি আসলে বিগত ১৫ বছরে আন্দোলনের পথ-পদ্ধতি অবস্থা যথাযথভাবে ঠিক করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আর আওয়ামী লীগ দৃশ্যমান উন্নয়ন করতে সফল হয়েছে।

সংবিধান বহাল থাকা অবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক-শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ছাড়া, সংসদের ভেতরে-বাইরে আন্দোলন ছাড়া কখনো যে গণজাগরণ সৃষ্টি করা যায় না, তা বিএনপি অনুধাবন করতে অক্ষম। একইভাবে অক্ষম এটা বুঝতে যে জামায়াতকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নীতিগতভাবে সঙ্গী তথা ‘আত্মার আত্মীয়’ করলে বাংলাদেশে সরকার পতনের গণসম্পৃক্ত আন্দোলন গড়ে তোলা যাবে না। সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার দুটো পথ আছে। প্রথমটা হলো গণ-অভ্যুত্থান আর দ্বিতীয়টা হলো সামরিক শক্তির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ। 

বিগত ১৫ বছরের রাজনৈতিক গতিধারা বিবেচনায় নিলে দেখা যাচ্ছে, জনগণ এখন দুটো পথের কোনোটাকে গ্রহণ করতে চাচ্ছে না। বাস্তবে এবারের নির্বাচনের ভেতর দিয়ে কয়েকটি বিষয় সুম্পষ্ট হয়েছে।

প্রথমত দেশে সবচেয়ে বেশি সময়ের জন্য সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। নিয়তান্ত্রিক সাংবিধানিক শান্তিপূর্ণ ধারা রক্ষা করা যে দেশের উন্নতি-অগ্রগতির জন্য অতীব প্রয়োজন তা জনগণ অনুধাবন করতে পারছে। ক্যু-হত্যা, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় যে অনিশ্চয়তা ও অরাজকতা তা জনগণ অনুধাবন করতে পেরেছে। উন্নতি-অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকবে কি না প্রশ্নটি সামনে রেখে জনগণ এখন অবস্থান স্থির করছে।

দ্বিতীয়ত অবরোধ-হরতাল জনগণ বর্তমান দিনগুলোতে প্রত্যাখ্যান করেছে। 

তৃতীয়ত জনসম্পৃক্ত আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে চাপে রেখে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। স্বতন্ত্র প্রার্থী যেখানে জনগণকে সম্পৃক্ত করে নির্বাচনে নেমেছে, সেখানেও ভোট অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ হয়েছে।

চতুর্থত বিদেশি চাপ সহ্য করার মতো ক্ষমতা বাংলাদেশ আজ মোকাবিলা করতে সক্ষম। বিশ্ব আজ পাল্টে গেছে। এককেন্দ্রিক নয়, বহু কেন্দ্রে তা বিভক্ত। তাই আমাদের মতো দেশগুলো চাপকে সামাল দেওয়ার মতো পরিস্থিতি পাচ্ছে।

পঞ্চমত দেশের বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন জনগণের পছন্দের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই যায় না। এত বিপুল সংখ্যক নৌকার প্রার্থীর পরাজয় আগামীতে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোকে জননন্দিত ও ভালো প্রার্থী দিতে অনুপ্রেরণা জোগাবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে যে, ‘শিক্ষিত দক্ষ চৌকস ও দুর্নীতিমুক্ত মানুষদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী করে তোলা হবে।’ এটা যে সময়ের দবি তা এই নির্বাচন প্রমাণ করেছে।

ষষ্ঠত নির্বাচন প্রমাণ রেখেছে, ছোট ছোট দলগুলো বড় দল দুটোর সঙ্গে জোটে গেলে বিভক্ত বা বিলীন হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। উল্টোদিকে আলাদা হয়ে থাকলেও রাজনীতিতে এর কোনো মূল্য থাকে না, তেমন কোনো ভূমিকাও রাখতে পারে না।

সপ্তমত দেশে শতকরা ন্যূনতম ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ভোট পড়ার কথা। তাই ৪০ ভাগ ভোটারের ভোট প্রদান প্রমাণ করে, রাজনৈতিক বা সাংগঠনিকভাবে বিএনপি যতই ভুল করুক না কেন, এই দলের সমর্থন বিগত ১৫ বছরে কমলেও বিদ্যমান রয়েছে। অর্থাৎ পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণী থেকে বিচ্যুত হয়ে যে রাজনীতি নিয়ে এই দল প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, সেই রাজনীতির সমর্থন জনগণের বড় একাংশের মধ্যে রয়েছে। তাই সংসদ থেকে বাইরে থাকলেও এই দলের রাজনীতিকে বর্তমান জাতীয় ও বিশ্বপরিস্থিতিতে বিলীন করা সহজ কাজ নয়।

অভিজ্ঞতালব্ধ এই প্রমাণগুলো সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও ট্রেন ফেল করা দল বিএনপি কোন ভূমিকা নিয়ে আগামী দিনগুলোতে অগ্রসর হয়, এটাই দেখার অপেক্ষায় থাকবে দেশবাসী।

-কলাম লেখক, রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //