‘কিংস’ ও জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ কী

এবারের নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, সেটি তফসিল ঘোষণার পরেই ধারণা করা যাচ্ছিল। কিন্তু জাতীয় পার্টি এবং বিএনপির বিকল্প হিসেবে যে দলগুলো (কিংস পার্টি নামে পরিচিত) নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, তাদের শোচনীয় পরাজয় কি কারও ধারণায় ছিল? 

প্রবীণ রাজনীতিবিদ এবং জাতীয় পার্টির (জেপি) প্রধান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মতো প্রার্থীও যে হেরে যাবেন, সেটিও কি আন্দাজ করা গিয়েছিল? অন্যদিকে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির প্রধান অংশে ভোটের পরে যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরও বেড়েছে, সেই দলটিরই বা ভবিষ্যৎ কী? 

বিএনপি থেকে বেরিয়ে গিয়ে যারা তৃণমূল বিএনপি এবং বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট (বিএনএম) নামে দুটি দল গঠন করেছিলেন এবং যারা সংসদে প্রধান বিরোধী দল হতে চেয়েছিলেন, তারাও কি আর রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকছেন? প্রধান বিরোধী দল হতে চাওয়া দুটি দল থেকে একজন প্রার্থীও যে জয়ী হলেন না, বরং দলের প্রধানদেরও জামানত বাজেয়াপ্ত হলো, সেটিরই বা তাৎপর্য কী? একই কথা কিংস পার্টি নামে পরিচিত আরেক দল বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) ক্ষেত্রেও।

৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ যে অনিশ্চিত, সেটি শুরুর দিকে পরিষ্কার ছিল না। কেননা দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বরও রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চায়। কিন্তু এবার আর ওয়াকওভার পাবে না। দেশের জনগণ আর হতে দেবে না। যতই চেষ্টা করুক শেখ হাসিনা, এককভাবে নির্বাচন করতে পারবে না, এটা আমি বলে গেলাম।’ (ইত্তেফাক অনলাইন, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩)।

কিন্তু বিএনপি এই অবস্থানে অটল থাকেনি। বরং ২৮ অক্টোবর রাজনীতির দৃশ্যপট পাল্টে গেলে বিএনপি তাদের এক দফা দাবিতে (সরকারের পদত্যাগ) আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং নির্বাচন বর্জনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তাদের ধারণা বা বিশ্বাস ছিল যে, দলীয় নেতাকর্মীদের শক্তি, দেশের জনগণের অংশগ্রহণ এবং বিদেশি শক্তির সহায়তায় তারা সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে আওয়ামী লীগকে বাধ্য করতে পারবে। কিন্তু সেটি সফল না হওয়ায় সত্যি সত্যিই মির্জা ফখরুলের ভাষায় আওয়ামী লীগ এবারও ‘ওয়াকওভার’ পেয়ে যায়। 

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এবার শুরু থেকেই বলা হচ্ছিল যে, এবারের নির্বাচন ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো হবে না। এবারের নির্বাচন আসলেই ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো হয়নি। বরং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও ‘স্মার্ট’ উপায়ে শেষ করতে পেরেছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি এবং তাদের শরিকরা হয়তো সেই ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি আঁচ করতে পারেনি বা সেই কৌশলের কাছে হেরে গেছে।

অনেকে বলার চেষ্টা করেন, সরকারের ফাঁদে পা দিয়েছে বিএনপি। যদি তাই হয়, তাহলে এটিও রাজনৈতিকভাবে বিএনপির জন্য একধরনের পরাজয়। হয়তো তাদের রাজনীতি ও ভোটের অঙ্কে কোথাও ভুল ছিল। অতএব আগামী দিনে বিএনপি ও তাদের শরিকদের রাজনৈতিক কৌশল কী হবে, সেটি সময়ই বলে দেবে। কিন্তু এই নির্বাচনে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো জাতীয় পার্টি এবং বিএনপির কথিত বিকল্প হিসেবে ভোটের মাঠে সক্রিয় হওয়া বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপি। 

বস্তুত জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ কোন্দল বহু বছর ধরেই ছিল, যা প্রকাশ্য হয় দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পরে। বিশেষ করে দলীয় প্রধানের পদ নিয়ে রওশন এরশাদ এবং জি এম কাদেরের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে অনেকে ‘দেবর-ভাবির টানাপড়েন’ বলেও অভিহিত করেছেন। সেই টানাপড়েন বা দলের ভেতরে প্রকাশ্য গ্রুপিংয়ের কারণে এবারের নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়েন রওশন এরশাদ এবং তার ছেলে সাদ এরশাদ। কিন্তু জি এম কাদেরের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেওয়া জাতীয় পার্টিকে সমঝোতার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ ২৬টি আসন ছেড়ে দিলেও তার সবগুলো ‘আনচ্যালেঞ্জড’ ছিল না। যে কারণে ওই ২৬টি আসনেও জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা জিততে পারেননি। দলটি এবার জয়ী হয়েছে মাত্র ১১টি আসনে, যা গত নির্বাচনের অর্ধেক। আর এই ঘটনাকে দলের নেতারাই দলীয় কোন্দলের পরিণতি বলে মন্তব্য করছেন। 

জি এম কাদের জয়ী হলেও ফলাফল প্রকাশের পর ভোটের নিরপেক্ষতা নিয়ে তিনি নিজেও প্রশ্ন তুলেছেন। আওয়ামী লীগ তাদেরকে ‘কোরবানি’ দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন। আর দলের পরাজিত প্রার্থীরা দুষছেন জি এম কাদেরকে। এ রকম বাস্তবতায় দলের দুজন শীর্ষ নেতা কাজী ফিরোজ রশিদ ও সুনীল শুভ রায়কে বহিষ্কার করা হয়েছে। অন্যদিকে জি এম কাদেরের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছেন দলের একটি অংশের নেতাকর্মীরা। অর্থাৎ একদিকে মাত্র ১১টি আসন নিয়ে জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দল হতে পারবে কি না তা নিয়ে যেমন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তেমনি অভ্যন্তরীণ কোন্দল সামাল দিতে গিয়েও হিমশিম খাচ্ছেন শীর্ষ নেতারা। বিশেষ করে জি এম কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। এই বিরোধের পরিণতি কী হবে; জাতীয় পার্টি দল হিসেবে আরও বেশি দুর্বল হয়ে যাবে কি না এবং দলের এ রকম ভগ্নদশা নিয়ে তারা সংসদে বিরোধী দল হিসেবে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। 

তবে যত যা-ই হোক রাজনীতি থেকে জাতীয় পার্টি এখনই হারিয়ে যাচ্ছে না। কেননা সারা দেশে না হলেও বৃহত্তর উত্তরবঙ্গে এখনো তাদের বিরাট ভোট ব্যাংক আছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও তাদের কমবেশি ভোট আছে। তাছাড়া জাতীয় পার্টি যেহেতু দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল এবং বিরোধী দল হিসেবেও কয়েকবার সংসদে ছিল, ফলে খুব দ্রুত দলটি রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাবে না। তবে অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে না পারলে তারা ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক দলে পরিণত হতে পারে। প্রশ্ন হলো, কিংস পার্টি নামে পরিচিত দলগুলোর কী হবে? 

দীর্ঘদিন বিএনপির সঙ্গে যুক্ত থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় কল্যাণ পার্টির প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমও এবার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এ নিয়ে তাকেও নানা সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু তিনি এমন একটি আসন থেকে জয়ী হয়েছেন, যেটি তার নিজের আসন নয়। যে কারণে বলা হচ্ছে, তাকে জিতিয়ে আনা হয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, অন্তত তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএমএর শীর্ষ নেতাদের কেন জিতিয়ে আনা হলো না বা তাদের কেন এমন পরিণতি হলো? 

এবারের নির্বাচনে তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৩৫ জন প্রার্থী দিয়েছিল তৃণমূল বিএনপি। কিন্তু বাস্তবতা হলো ভোটের মাঠে তাদের কেউই দাঁড়াতে পারেননি। একটি আসন থেকেও দলটির কেউ জেতেননি। স্মরণ করা যেতে পারে, মনোনয়নপত্র বিক্রি ও নির্বাচনী প্রচারে তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার একাধিকবার বলেছিলেন, তৃণমূল বিএনপি প্রধান বিরোধী দল হবে। অথচ তিনি নিজে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিশাল ব্যবধানে হেরে গেছেন। তিনি পেয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ১৯০ ভোট। 

একই অবস্থা হয়েছে নির্বাচনের আগে নিবন্ধিত দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেরও (বিএনএম)। তারা এবারের নির্বাচনে ৫৩টি আসনে প্রার্থী দিলেও একটিতেও জেতেনি। বরগুনা-২ আসনে (বিএনএম) থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন দলটির শীর্ষনেতা (প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক) ড. আবদুর রহমান খোকন। তিনি ২ শতাংশ ভোটও পাননি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর ও মহাসচিব মো. শাহজাহানও জামানত হারিয়েছেন।

বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমেদ মাইজভাণ্ডারিকে চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসন ছেড়ে দেওয়া হতে পারে, এমন গুঞ্জন ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আসনটি ছেড়ে দেয়নি। নির্বাচনে একতারা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ৩ হাজার ১৫১ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমেদ। গণমাধ্যমের খবর বলছে, সারা দেশে মাত্র দুটি আসন বাদে বাকি সব আসনেই জামানত হারিয়েছেন ‘কিংস পার্টির’ প্রার্থীরা।

জাতীয় পার্টিকে যেমন সমঝোতার মধ্য দিয়ে ২৬টি আসন ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, বিএনএম, তৃণমূল বিএনপি এবং বিএসপির সেই সৌভাগ্য হয়নি। হয়তো দলগুলোর শীর্ষ নেতারা ভেবেছিলেন, অন্তত তাদেরকে জয়ী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু সেটি যেহেতু হয়নি, ফলে আগামী দিনে তারা আর রাজনীতিতে কতটুকু সক্রিয় থাকবেন বা দল হিসেবেও দেশের রাজনীতিতে কতটা প্রাসঙ্গিক থাকবে, সেটি নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। 

ভোট অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ হয়েছে কি না, সেই তর্কের বাইরে গিয়ে সাদাচোখে এটিই প্রমাণ হয় যে, ভোটারদের মধ্যে এই দলগুলোর কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। আবার ভোট শত ভাগ অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও এসব দলছুট নেতা এবং তাদের দলের প্রার্থীরা যে খুব বেশি ভোট পেতেন, সেটিও ভাবার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং ভোটারদের মানসিকতার অতীত ইতিহাস তা-ই বলে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //