যুক্তরাষ্ট্র কি ‘ম্যানেজড’

‘তলে তলে সমঝোতা হয়ে গেছে’, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানামাত্রিক আলোচনা হয়েছিল। কেউ কেউ রসিকতাও করেছেন। যদিও ভোটের আগ মুহূর্তে, এমনকি ভোটের পরও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অবস্থান এবং তার বিপরীতে আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ দলের নেতাদের বক্তব্যে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না, আসলে কি সমঝোতা হয়েছে? কিন্তু এখন অনেকে মনে করছেন যে, সত্যিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝি ‘ম্যানেজড’ হয়ে গেছে। আসলে কি তা-ই? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে একটু পেছনে ফেরা যাক।  

বাংলাদেশ পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের বর্তমান ও সাবেক কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সম্পর্কের টানাপড়েন ‘ওপেন সিক্রেটে’ পরিণত হয়। এ রকম বাস্তবতায় গত বছরের এপ্রিলে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যে কোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে পাল্টাতে পারে।’ এরপর মে মাসে তিনি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় চায় না। আর এ কারণেই বাংলাদেশের বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।’ এমনকি ভোটের সপ্তাহখানেক আগে ‘লেটস টক’ নামে একটি অনুষ্ঠানেও তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সারাক্ষণ আমার বিরুদ্ধে লেগে আছে।’ 

পক্ষান্তরে বাংলাদেশের রাজনীতি, বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন এবং নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র তার বক্তব্যে অনড় থাকে। এমনকি ভোটের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান পাল্টায়নি। কিন্তু হঠাৎ করেই দৃশ্যপট পাল্টে গেলো কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে। কেননা গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি’ বলে একাধিকবার বিবৃতি দিলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক দেশ এরই মধ্যে নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। এমনকি নতুন সরকার গঠনের পরপরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা যার কড়া সমালোচনা করেছেন। শুধু মার্কিন রাষ্ট্রদূত নন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং হাতে নৌকা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। 

গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত ১৭ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের নবগঠিত সরকার ও জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। বাংলাদেশের সঙ্গে শিগগিরই নতুন পার্টনারশিপ কো-অপারেশন অ্যাগ্রিমেন্টে (পিসিএ) সই করতে যাচ্ছে ইইউ। 

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা এবং সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। মন্ত্রীর ভাষ্য, ‘আমাদের সমুদ্রে প্রচুর তেল আছে সেটা আমেরিকান একটি কোম্পানি অনুসন্ধান করেছে। এটি উত্তোলন করতে পারলে আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে। সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তাদের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা কিছুটা আছে। সেটা নিয়েও আলোচনা করেছি।’ 

এর আগের দিন ১৬ জানুয়ারি ডাক, টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। বৈঠক থেকে বেরিয়ে পিটার হাস সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বললেও পলক জানান, দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে কথা হয়েছে। 

পোর্টফোলিওর দিক দিয়ে প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী খুব বড় মন্ত্রী নন। কিন্তু তার দপ্তরটি গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের পৃথিবীতে প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ যার কাছে, তিনি সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান। অতএব প্রতিমন্ত্রী হলেও তার সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠকের তাৎপর্য ভিন্ন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পলক বলেছেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করতে পারে সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।’ এখানে মনে রাখা দরকার, প্রযুক্তি ও প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবসার আড়ালে এটি এখন প্রতিপক্ষের ওপর নজরদারির সবচেয়ে বড় অস্ত্র। ফলে বাংলাদেশের প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠকে আসলেই কী কী আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার সবকিছু জানা যাবে না। তবে এটি বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র যত সহায়তাই দিক না কেন, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নিজের স্বার্থ অনেক বেশি। 

এসব ইকুয়েশনও বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। কেননা মার্কিন রাষ্ট্রদূতও বলেছেন, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় নানা স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করতে চান। মানে ব্যবসা করতে চান। সেটি সমুদ্রের তলদেশে যেমন, তেমনি প্রযুক্তিতেও। তবে শুধু ব্যবসা নয়, এই অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্য রক্ষা তথা তার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর ওপর নজর রাখতে গেলেও বাংলাদেশকে প্রকাশ্য শত্রু বানিয়ে তার কোনো লাভ নেই, সেটিও যুক্তরাষ্ট্র ভালো করেই জানে। 

মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় কে থাকল; এখানে গণতন্ত্র আছে কি নেই; কোন প্রক্রিয়ায় এখানে নির্বাচন হলো; এখানে শ্রম অধিকার ও মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন ইতাদি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যা কিছুই বলুক না কেন এবং এসব বিষয়ে তাদের পররাষ্ট্র নীতি যা-ই হোক না কেন, দিন শেষে তাকেও তার আঞ্চলিক খবরদারির বিষয়টা মাথায় রাখতে হয়। সে কারণে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী আয়তনে ছোট্ট অথচ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশাল জনসংখ্যার দেশটিকে আমলে নিতে হয়। তার ব্যবসা ও বৈশ্বিক রাজনীতিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। পরিস্থিতি উইন-উইন।

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের যেমন কিছু স্বার্থ আছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মতো সক্ষমতাও বাংলাদেশের নেই, এটিই বাস্তবতা। আর কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে এখন এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানো কোনো পক্ষের জন্যই লাভজনক নয়। নয় বলেই এখন যুদ্ধটা হয় সাইবার দুনিয়ায়, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ টেরই পায় না। সাইবার দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিতে কোন দেশের সঙ্গে কোন দেশের কী চুক্তি আছে, সেটিও অনেক সময় আড়ালেই থাকে। 

প্রশ্ন হলো যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান কি মাঠের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির জন্য আরও বেশি হতাশার কারণ হলো?

এবারের নির্বাচন যে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো হবে না, সে কথা খোদ আওয়ামী লীগের তরফেও বলা হচ্ছিল। কিন্তু বিএনপি যে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশলের কাছে হেরে গিয়ে ভোট থেকে ছিটকে যাবে কিংবা তাদের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে এবং এবারও আওয়ামী লীগ অনেকটা ওয়াক ওভার পেয়ে যাবে, সেটি হয়তো বিএনপির ধারণায়ও ছিল না। তারা হয়তো ভেবেছিল শেষ মুহূর্তে হলেও আমেরিকা এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে যাতে করে সরকার ও আওয়ামী লীগ নির্বাচন পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয় কিংবা দেশে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হবে যাতে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে না পারলেও অন্তত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকবে না। কিন্তু তাদের এই অঙ্কের হিসাব মেলেনি।

বিএনপি হয়তো ভাবছিল যে, নির্বাচনের অব্যবহিত পর আমেরিকা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে যাতে করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে বিপদের সম্মুখীন হয়। কিন্তু ‘নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি’ বললেও আমেরিকা যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নতুন করে বড় ধরনের স্যাংশন বা অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না, সেটি মোটামুটি স্পষ্ট। 

আরেকটি কারণ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান। ভূরাজনৈতিক কারণে আয়তনে ছোট্ট এই বদ্বীপ রাষ্ট্রটি বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এই অঞ্চলে বিশ্ব শক্তিগুলোর অলিখিত স্নায়ুযুদ্ধ এবং নানাবিধ বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় স্বার্থে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা যেমন তাদের কাম্য, তেমনি এই দেশটি অস্থিতিশীল থাকলেও অনেকের সুবিধাএমন কথাও শোনা যায়। ফলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় কোন দল থাকল এবং তারা কোন দেশের কতটুকু স্বার্থ রক্ষা করছে বা করতে পারছে কিংবা ভবিষ্যতে করবে, সেটি বরাবরই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরাশক্তিগুলোর বিবেচনায় থাকে।

এই অঞ্চলে চীনের আধিপত্য ঠেকানোর জন্য ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে সম্পর্ক ছিল, সেই রসায়ন বদলে গেছে ভারত অনেক বেশি রাশিয়াকেন্দ্রিক হওয়ায়। কেননা রাশিয়ার সঙ্গে চীনের বন্ধুত্ব পুরনো। আবার চীন এখন বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী। বিশেষ করে দেশের অনেক বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে সরাসরি চীনের তত্ত্বাবধানে। এমনকি চীনের প্রচুর প্রকৌশলী ও শ্রমিকও এসব প্রকল্পে কাজ করছেন। কিন্তু বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে চীন-নির্ভরতা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের জন্য দুশ্চিন্তারও কারণ হতে পারে।

শুধু বাংলাদেশ নয়, বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় রাখতেও বাংলাদেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখন কোনো একটি দেশ একা ভালো থাকতে পারে না। ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে একটি দেশ আরেকটির ওপর নির্ভরশীল। যে কারণে ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশের বাজারে গমের সংকট হয় এবং গমের সংকট হলে অনেক খাদ্যপণ্যের উৎপাদন কমে যায়। উৎপাদন কমে গেলে দাম বেড়ে যায়। তা ছাড়া কোনো একটি দেশ অস্থিতিশীল হলে তার প্রতিবেশী দেশগুলোতেও তার ঢেউ লাগে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //