বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের নতুন মহাপরিকল্পনা ও জনপ্রত্যাশা

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে নতুন মহাপরিকল্পনার (মাস্টারপ্ল্যান ২০২৩-আইইপিএমপি) খসড়া ঘোষণা হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে জ্বালানি ক্ষেত্রে জ্বালানি রূপান্তর বা জ্বালানি খাতের সংস্কারের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কাজগুলো সংস্কারের মাধ্যমে সম্পূর্ণ করা হবে। এরপর জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ খাতকে বাণিজ্যিক খাতে পরিণত করা হবে। সরকারকে এ ব্যাপারে প্রলুব্ধ করা হয়েছে যে এটি সরকারের একটি রাজস্ব আয়ের অন্যতম খাত। অর্থাৎ এ খাতকে সরকারের অনার্স বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার একটা চেষ্টা করা হচ্ছে। জ্বালানির সবচেয়ে বড় একটি খাত হলো দেশীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন। এই উৎপাদনে গ্যাস, তেলের চাইতে কয়লাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়াটিতে কোম্পানিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, কোম্পানির লাভের জন্য সমস্ত আয়োজন করা হয়েছে। এ কারণেই খাতের ঘাটতি বাড়িয়েও কোম্পানিগুলো তাদের ঈপ্সিত মুনাফা করে যাচ্ছে। 

আমরা জানি যে, বিদ্যুৎ খাতের উৎপাদন ও বিপণনে ট্যক্স, ভ্যাট, কাস্টমস ডিউটি, আমদানিশুল্ক বাবদ সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে হয়। কিন্তু এ ব্যবস্থাটি প্রধানত কোম্পানিভিত্তিক হওয়াতে ঘাটতি চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। ১৯৯০ সালের পর থেকে এ রকম আত্মঘাতী কাজগুলো অব্যাহত আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে চরম ঘাটতি বৃদ্ধির ঘটনা ঘটছে। সেই ঘাটতি পূরণের জন্যই মূলত মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সরকারের ভর্তুকি বেড়ে গিয়েছে। সরকারের পক্ষে সেই ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমদানি ব্যয় সংকটে বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থানের বিষয়টি সংকটে পড়ছে। সেই কারণেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানির বিষয়টিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। এতে জ্বালানি খাত একটা বড় সমস্যার মধ্য দিয়ে চলে আসছে।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন শেষ হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। নির্বাচনের অল্প কয়েক দিন আগে জ্বালানি সমন্বিত মহাপরিকল্পনা ২০২৩ প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই মহাপরিকল্পনাতে জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টি অনুপস্থিত থেকে গেছে। এতে এ বিষয়ে করণীয়ের তেমন কোনো নির্দেশনা নেই। সেজন্য জ্বালানি খাতের যে কোনো উন্নয়নেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই বললেই চলে।

এখানে যেমন বলা হয়েছে যে, গ্রিড বিদ্যুতের কয়লা ও এলএনজি থেকে কয়লা ও তরলীকৃত গ্যাস বা এলএনজি আমদানি বাড়বে। এসব বাড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা, জ্বালানি সরবরাহের যে রূপরেখা দেওয়া হয়েছে সেটা আসলে আগেকার প্রায় অকার্যকর উন্নয়ন পরিকল্পনারই এক ধরনের ধারাবাহিকতা। এ কর্মকাণ্ডের একসঙ্গে ডকুমেন্টেশনের চেষ্টা এই পরিকল্পনাতে নেওয়া হয়েছে। এর ভয়ংকর দিক হলো- বিদ্যুতের চাহিদা প্রদর্শন। এর শঙ্কার সবচেয়ে মারাত্মক দিক হিসেবে বিদ্যুতের চাহিদা প্রদর্শন এবং তার ভিত্তিতে এই জ্বালানির উৎপাদন সক্ষমতা দেখানো হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহৃত হচ্ছে না এবং ক্যাপাসিটি দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো যেভাবে দেউলিয়া হচ্ছে-সেই বিষয়গুলো অ্যাডজাস্ট করা হয়নি। এমনকি এই অ্যাডজাস্টমেন্টের বিষয়টি পরিকল্পনাতে আসেইনি। এই বিষয়গুলো মূলত বিধিবদ্ধ কৌশল ও নীতির আওতাধীন। এসব নীতির ডিটেইল সরকারই গ্রহণ করে থাকে এবং সেই ডিটেইলের ভিত্তিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। সুতরাং এই পরিকল্পনাকে জ্বালানি খাত উন্নয়নে বা জ্বালানি খাতের সংকট মোকাবিলায় কোনো হাতিয়ার বা টুলস হিসেবে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই। 

নতুন এই মহাপরিকল্পনা করার পরও আগের অনিয়মগুলো চালু রাখলে এটা দিয়ে কোনো সংকটই মোচন হবে না। জ্বালানি খাতের প্রতিটি উন্নয়নে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হলে এবং সেখানে যদি দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইনের আগের কাঠামো অব্যাহত রাখা হয় তাহলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে না। একই সঙ্গে বিনিয়োগ অতিরিক্ত মাত্রাযুক্ত মুনাফা করার সুযোগ রেখে যদি এই আইন বলবৎ রাখা হয় এবং লুণ্ঠনমূলক ব্যয়ের সুযোগ থাকে, তাহলেও জ্বালানি খাতের শনির এই দশা কাটবে না। 

এজন্য প্রথমেই দরকার জ্বালানি সংক্রান্ত নীতির পরিবর্তন করা। প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনে দুটো কাজ প্রথমেই জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রথমত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ বাতিল করতে হবে। নতুন সরকার এসে শুরুতেই যদি এই আইন প্রত্যাহার করে নেয় এবং বাতিল করে দেয় তবে জ্বালানি খাতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতে পারে। পাশাপাশি বিআরসিতে মূল্য বৃদ্ধিটা যৌক্তিক হচ্ছে কি না এবং যে সমস্ত ব্যয় বৃদ্ধি দেখিয়ে ঘাটতি বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এ ছাড়া বাণিজ্যিক খাত হিসেবে গণ্য করে এ খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব নিয়ে অহেতুক খাতের ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে, সেই জায়গাগুলোতে যৌক্তিক সংস্কারের নীতি গ্রহণ করতে হবে। এরপর পর্যালোচনার মাধ্যমে সেগুলোর একটা যৌক্তিক পর্যায়ে উত্তরণ ঘটাতে হবে। এসব পরিকল্পনা নিয়ে নীতি গ্রহণ করতে পারলে, সেই পরিকল্পনামাফিক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ভোক্তাবান্ধব হতে পারে। আমরা সেই আঙ্গিকে ক্যাবের পক্ষ থেকে এনার্জি ট্রানজেকশন পলিসি ২০২২ ইতোমধ্যে প্রস্তাব করেছি এবং সরকারের কাছে জমা দিয়েছি। 

সরকারের কাছে জ্বালানি সনদ চুক্তির খসড়া স্বাক্ষরের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু চুক্তিটির ক্ষেত্রে এমন সদস্য পর্যবেক্ষক হিসেবে রয়েছেন, যাদের এখানে সংশ্লিষ্টতাই প্রশ্নবিদ্ধ। সুতরাং এই প্রক্রিয়ায় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে জ্বালানি খাতের সর্বনাশ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। 

সর্বশেষে বলা যায়, যদি নীতি ঠিক না করা হয়, তাহলে পরিকল্পনা দিয়ে কোনো কিছুই করা যায় না। নীতি ঠিক থাকলে সেই অনুযায়ী কী করতে হবে- সে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটাতে হয়। তাই নতুন মন্ত্রিসভা গঠন হলেও যদি পরিকল্পনা আগের মতোই চলতে থাকে, তাহলে প্রত্যাশা করার কিছু নেই। এখানে যদি সরকারের কৌশল ও নীতি না বদলায়, তাহলে পরিকল্পনা দিয়ে প্রত্যাশা করার কিছু নেই। আমরা দেখেছি যে, এখন পর্যন্ত এ খাতকে বাণিজ্যিক খাত হিসেবেই দেখা হচ্ছে। রাজস্ব আয় আদায়ের উৎস হিসেবে এই খাতকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। সরকারি মালিকানাধীন পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২০২২-২০২৩ সালে ৩০% মুনাফা; যেখানে কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ১৮ টাকার উপরে ১৯ টাকা হয়ে গেছে, যেখানে কয়লার বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় এত বেশি হয়ে গেছে- সেই বিদ্যুৎ ভোক্তা পর্যায়ে আনতে ২০ টাকার উপরে পড়বে। এখন ভোক্তার কাছে কৌশলে সেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ চাপানো হচ্ছে। যদি পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৩০% লাভ হয়, তাহলে সরকার কত রাজস্ব আয় আদায় করে-সেই সব বিষয়গুলোই এই সব পরিকল্পনায় ধারণ করা হয়েছে। তাই এই পরিকল্পনাকে আমরা কোনোভাবেই ভোক্তাবান্ধব, গণবান্ধব বলতে পারছি না। 

এখন নতুন সরকার গঠন হওয়ার পরও যদি এই পরিকল্পনা অব্যাহত থাকে-তাহলে কোনো জনপ্রত্যাশাই থাকার প্রয়োজন পড়ে না। জ্বালানি বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা ২০২৩ যদি একই কায়দায় বহাল থাকে, তাহলে সরকারের জ্বালানি খাতের আগের অবস্থানই অব্যাহত থাকবে। তাই আমি মনে করি যে, নতুন সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার বিষয়টি এ প্রসঙ্গে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তাদের ক্ষমতা গ্রহণের পদ্ধতিও এখানে আলোচনার বিষয় নয়। কে কীভাবে ক্ষমতায় এসেছে বা আসেনি সেটা ব্যাপার না। কিন্তু নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পরও যদি জ্বালানি খাতে পূর্বের নীতি ও পরিকল্পনা অব্যাহত থাকে, তাহলে সেটা আগের মতোই অশনি সংকেত হিসেবে বিবেচিত হবে। যদি সরকার পূর্বের মতো রাজস্ব আয় আদায়ের কৌশল একই রকম রাখে, তাহলে কোনো মহাপরিকল্পনাই কাজে আসবে না। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো যদি আধুনিক পাওয়ার প্ল্যান্টে কম খরচে ২০০ মিলি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, সেই বিদ্যুৎ যদি ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে ২০ টাকা লাগানো হয়, তাহলে আমাদের প্রত্যাশার জায়গাটা আর ধরে রাখা যায় না। 

লেখক: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //