ইসরায়েল-হামাস সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা

হামাস-ইসরায়েল সংঘাতের একশ দিন পার হওয়ার পরও গাজায় ইসরায়েলি অলআউট অ্যাটাক বন্ধ হয়নি। প্রতিদিনই অজস্র ফিলিস্তিনির মৃত্যু হচ্ছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এই নিকৃষ্ট ক্লিজিংয়ের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে আসছে। উল্টোদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ইসরায়েলের মিত্র দেশগুলো দায় চাপাচ্ছে হামাসের ওপর। তাদের যুক্তিহামাস ন্যক্কারজনকভাবে ইসরায়েলি নাগরিকদের ওপর হামলা করে তাদের হত্যা না করলে ইসরায়েল পাল্টাহামলা করত না। সেই সঙ্গে আরও একটি হ্যাপেন্স বা কার্যকারণ সামনে আসে, তা হলো হামাসকে দিয়ে ইরানের গুটি চালানো। সারা বিশ্ব জানে হামাস পুরোপুরি ইরানের লজিস্টিক সাহায্যে চলে এবং ইরানের আদেশ-নির্দেশ পরামর্শ অনুসরণ করে।

পশ্চিমা এমন আরোপকে প্রমাণ করার জন্যই যেন ইরান গত ১৫ জানুয়ারি একযোগে সিরিয়া ও ইরাকের কয়েকটি অঞ্চলে রকেট হামলা করেছে। এর পরপরই পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে হামলা করেছে। এরপর ইরাক জাতিসংঘে ইরানের বিরুদ্ধে আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ দায়ের করে। পরে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ইসরায়েলই হামাসের ওপর আক্রমণ করে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে!’

ইরানের হামলার পসিবিলিটিগুলো কী
তেহরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে যে ইরাকের একটি কথিত ইসরায়েলি ‘গুপ্তচরবৃত্তি কেন্দ্র’ এবং সিরিয়ায় আইএসআইএস সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো ছিল তাদের বিরুদ্ধে ‘প্রাপ্য শাস্তি’। কারণ এরা ইরানের নিরাপত্তা নষ্ট করার চেষ্টা করেছে। ইরানের বেশ কয়েকটি মিডিয়া আউটলেট ফুটেজ প্রকাশ করেছে।

কয়েক বছর আগে মার্কিন বিমান হামলায় নিহত জেনারেল কাসেম সোলেইমানির স্মরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রায় ১শ জনের প্রাণহানি ঘটে এই মাসের শুরুর দিকে কেরমানে একটি বিস্ফোরণে। ইরান সেই বিস্ফোরণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে দায়ী করলেও আইএস হামলার দায় স্বীকার করেছিল।

এরপর রাস্ক শহরে একটি আত্মঘাতী বোমা হামলায় ১১ ইরানি পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছিল। তেহরান ওই হামলার পেছনে ইসরায়েলকে দায়ী করলেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান-ভিত্তিক জিহাদি গোষ্ঠী জইশ আল-আদল বিস্ফোরণের দায়িত্ব স্বীকার করে।

এই দুটো ঘটনার জন্য ইরান যাদের দায়ী করে আসছিল তারা আদতে দায়ী নয় জানার পরও ইরান তাদের সিদ্ধান্তে অনড় এবং কল্পিত ‘হামলা হতে পারে’ ভেবে আগাম আক্রমণ করে বসেছে সিরিয়া-ইরাক-পাকিস্তানে।

বর্তমান ইসরায়েল-হামাস দ্বন্দ্বের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন যুদ্ধবাস্তবতার মধ্যেই ইরানের বিপ্লবী গার্ডে স্ট্রাইক করল। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ৭ অক্টোবরের কুখ্যাত হামলা শুরু করার পর থেকে তেহরান আক্রমণে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছিল।

সিরিয়া, ইরাকের পর পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে জঙ্গি সংগঠন জইশ আল-আদলের ঘাঁটিতে এই হামলা চালাল ইরান। ইরাকের কুর্দিস্তান এবং সিরিয়ায় ইসরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের গোপন ডেরায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পরেই এই হানা। এই হামলায় দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি পাকিস্তানের। একই সঙ্গে তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছে এই ধরনের হামলা কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না। এমনকি পরবর্তীকালে এর ফল ভুগতে হবে বলেও হুমকি দিয়েছে পাকিস্তান।

হুমকির পর পরই বুধবার পাকিস্তান ইরানে রকেট হামলা করেছে। ইরানের দাবি, এই হামলায় ইরানের ৯ জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে।

আগেই ইরাকের কুর্দিস্তান এবং সিরিয়ায় ইসরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের গোপন ডেরায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর দাবি করে ইরান বলেছিল, ‘ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হামলায় কুর্দিস্তানে মোসাদের সদর দপ্তর ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।’ যদিও ইরাকের ‘কুর্দিস্তান স্বশাসিত অঞ্চলের’ প্রধানমন্ত্রী মসরুর বরজামি ইরানের দাবি খারিজ করে বলেছেন, ‘ওখানে মোসাদের কোনো ঘাঁটি ছিল না। অসামরিক বসতিপূর্ণ অঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। যারা নিহত হয়েছেন, তারা সকলেই সাধারণ নাগরিক।’ 

বেলুচিস্তানে ইরানের হামলার পরের দিনই ইরানের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। বিবৃতিতে পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, তাদের ‘মার্গ বার সরমাচার’ নামক ওই অভিযানে ‘বেশ কয়েক জন ‘সন্ত্রাসবাদী’র মৃত্যু হয়েছে।

ঘটনাচক্রে ইরান যখন পাকিস্তানের ওপর হামলা চালিয়েছে, তার ঠিক আগেই ইরান সফরে ছিলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। গত ১৪ জানুয়ারি তিনি তেহরানে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসির সঙ্গে দেখা করেন। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যেই দুই ঘটনায় ‘যোগসূত্র’ খোঁজার চেষ্টা করছেন। আর তা নিয়ে জোর আলোচনাও শুরু হয়েছে। সেই ডিমটি ভাঙলে অন্য এক উপাখ্যান শুরু হবে মধ্যপ্রাচ্য ও উপমহাদেশজুড়ে।

তবে দুই দেশের সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার ভারতের বিদেশ মন্ত্রক থেকে বলা হয়েছে, ‘বিষয়টি ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যকার। ভারত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েই চলবে। আত্মরক্ষার স্বার্থে কোনো দেশ পদক্ষেপ নিলে ভারত তা বুঝতে পারে।’ 

উল্লেখযোগ্য, এর আগে একাধিকবার সংঘাতে জড়িয়ে পড়া দুই দেশের বিরুদ্ধেই আন্তঃসীমান্ত এলাকায় হামলা চালায় এমন জঙ্গি গোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ইরান এবং পাকিস্তানের প্রায় ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে জঙ্গি কার্যকলাপ দীর্ঘদিন ধরেই ইসলামাবাদ এবং তেহরানের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আগেকার হামলার তুলনায় এবার ইরান এবং পাকিস্তানের হামলা এবং পাল্টা হামলায় দুই পক্ষের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টালমাটাল অবস্থা।

পাল্টাহামলার আগে ইরানের প্রতি কঠোর কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ইসলামাবাদ। ইরান থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করার পাশাপাশি ইরানের রাষ্ট্রদূতকে পাকিস্তানে আসতে বারণ করেছে।

দুদেশের সংঘাতে নিজেদের মতামত জাহির করতে আসরে নেমেছে চীন। তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে পারে এমন পদক্ষেপ থেকে দুদেশেরই বিরত থাকা উচিত। শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে একসঙ্গে কাজ করুক দুই দেশ।’

সঙ্গত প্রশ্ন উঠেছে; ইসরায়েল-হামাস সংঘাতে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৭ হাজার ফিলিস্তিনি এবং প্রায় ৩ হাজার ইসরায়েলির মৃত্যু হয়েছে। গাজা উপত্যকা কার্যত মাটিতে মিশে গেছে। সেই বিপর্যয়ের মধ্যেই কেন কথিত বন্ধুপ্রতিম দেশ পাকিস্তান-ইরান সংঘাতে জড়াচ্ছে? কেন ইরান মনগড়া অভিযোগে সিরিয়া-ইরাকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করছে?

পাশাপাশি এই প্রশ্নও উঠেছে যে শিয়া ইরানের প্রত্যক্ষ মদদে ইয়েমেনের শিয়া হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠী লোহিত সাগরের স্বাভাবিক জাহাজ চলাচলে বিঘœ ঘটানোর পরে হুতি লক্ষ্যবস্তুতে ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলা শুরু হয়েছে। জর্ডান বা লেবাননের মতো ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইয়েমেনের সীমান্ত নেই। দেশ দুটির অবস্থান অনেক দূরে। তার পরও হুতিরা কেন ইসরায়েলের কথিত বিরোধিতার নামে লোহিত সাগরের দখল নিয়ে কার্যত মস্তানি করছে? এখানেও কি ইরানি মদদ?

তার মানে দাঁড়াচ্ছে, এক ইরান কথিত ইসরায়েলকে নির্মূলের নামে হামাসকে দিয়ে ইসরায়েলে অতর্কিতে হামলা পরিচালনা করাচ্ছে, নিজেদের প্রতিরক্ষার নামে সিরিয়া-ইরাকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করছে, দীর্ঘদিনের বন্ধু পাকিস্তান ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে, হুতিদের দিয়ে জাহাজ দখল করাচ্ছে, লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল বন্ধ করাচ্ছে! এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইয়েমেনে বিমান হামলা করছে, রাশিয়া লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সকল মহলকে সংযম দেখাতে বলছে! চীন তাদের পরীক্ষিত বন্ধু পাকিস্তান এবং নব্য বন্ধু ও বিজনেস পার্টনার ইরানকে সংযত থাকতে বলেছে। আর ইরান অভিযোগ করছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিতে চাইছে ইসরায়েল! বড়ই গোলমেলে বিষয়।

এবার ছোট্ট একটা অঙ্ক মেলানো যাক। ইরান কিছুদিন আগেই বর্তমান বিশ্বের শক্তিধর বাণিজ্যিক জোট ব্রিকসের সদস্য হয়েছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতও হয়েছে। সে কারণে সৌদি-ইরান দ্বন্দ্বও ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। এর পর পরই ইরান মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদেরকে ‘অক্ষশক্তি’ হিসেবে মনে করতে শুরু করেছে? সে জন্যই তারা রাশিয়া-চীন-ভারত বলয়ে নিজেদের অবস্থান সংহত করেছে এবং পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া এবং অপরাপর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছে না? এমনকি সেই সিরিয়াতে হামলা করেছে যারা সরাসরি রাশিয়ার অন্যতম মিত্র দেশ, যেখানে আইএসআইএস দমনে রাশিয়া বিমানবাহিনী পাঠিয়েছিল।

সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে এখনই তার পূর্বানুমান ঠিক হবে না। তবে এতটুকু নিশ্চয়ই অনুমান করা যাবে যে ইরান আগুন নিয়ে ‘খেলতে’ নেমেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের একটি মহল দ্বন্দ্বের একদেশদর্শী বিশ্লেষণ করেই ইরানকে ‘হিরো’ বানিয়ে ফেলেছে। তারা ইরানের মধ্যেই নিজেদের সুপ্ত হিরোইজম চরিতার্থ করতে স্বপ্ন দেখছেন। এখন আপনি নিজেও একটু গভীরে চিন্তা করলে দেখতে পাবেন- একচেটিয়া পুঁজির সামরিক আগ্রাসনের হাত ধরেই আসছে অর্থনৈতিক আগ্রাসন। আসবেই। এটাই পুঁজির ধর্ম। আর সে ধর্মানুযায়ী পুঁজি তার দখল কায়েমের জন্য মানুষ আর আর্মস-অ্যামুনিশনকে একই বস্তু ভাবে। মধ্যপ্রাচ্যের এই যুদ্ধদামামায় যে কোনো সময় জড়িয়ে যেতে পারে উপমহাদেশ। যুদ্ধপরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমরা প্রস্তুত তো?

 -সাংবাদিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //