গানের গুরু উস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খান: আপনাকে সালাম

আজকাল আমি পুরনো দিন নিয়ে বেশ কিছু লেখা লিখি। লোকে পছন্দও করে। নস্টালজিক লেখা বলা যায়। পাঠক বলে এত ছোট করে নয় বেশি করে লিখুন, সব হারিয়ে যাওয়ার আগে। এই রকম লেখা পড়ে পাঠকের ভালো লাগে জেনে আমার ভালো লাগে। এগুলো স্মৃতিচারণ কিনা জানি না। তবে অন্য কালের কথা। আর একটা উদ্দেশ্যও আছে এ ধরনের লেখার  পেছনে।

দুই: আমি ফেসবুকে ও মিডিয়ায় গালি, বিদ্বেষ, ঝগড়া দেখে আর পড়ে ক্লান্ত। মানুষ কাউকে ভালো তো বলেই না বরং গালি দিলে ভালো বলে। গালি দিলে বেশ জোশ জোশ ভাব আসে মনে, নিজেকে বীর মনে হয়। আমার ভালো লাগে না। তাই আমি যে সব মানুষ দেখেছি, যাদের সঙ্গে হেঁটেছি তাদের কথা বলি। এতে সুবিধাও আছে- এরা আজকাল অত সক্রিয় না অথবা গত, তাই ঝগড়া কম অন্যদের সঙ্গে। দ্বিতীয়ত এই সব ভালো লাগা মানুষকে নিয়ে কথা তো সুন্দর, সৌম্য হবেই। বলা যায় এটা এক ধরনের কাউন্টার কলাম চর্চা আজকের রুচির বিপক্ষে। তাই এই পুরান দিনের কথা লেখা মাঝেমধ্যে।

তিন: যা-ই হোক, বিষয়ে আসা যাক। আজকাল অনেকেই গান শেখে। কেউ যায় গানের ইস্কুলে, কেউ যায় ওস্তাদের বাড়ি, কেউ শেখে ইউটিউব থেকে, কেউ নিজে নিজে। আগে এই যান্ত্রিক সহায়তা বাদে বাকিগুলো চালু ছিল, আমাদের বাড়িতেও। আমি, আমরা ভাইরা গান শিখতাম, আমাদের বাসায় এসে শেখাতেন যিনি, তিনি হচ্ছেন উস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খান। তখনকার কালে খুব পরিচিত গানের সঙ্গীত শিক্ষক। কুমিল্লার মানুষ, আলাউদ্দিন খাঁর এক ধরনের আত্মীয়ও বটে। ওনার বাবাও সঙ্গীত চর্চা করতেন, তিনজন মিলে একটি গোষ্ঠী করেন- নামটা খেয়াল পড়ছে না। উস্তাদজির ঢাকার দুনিয়ায় নাম ছিল তবলাবাদক হিসেবে। এমনকি উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ যখন ঢাকায় আসর করেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গত করেছিলেন। তবলা, গান দুইটাই শেখাতেন। গান শিখত আমার সবচেয়ে বড় ভাই, আর তবলা মেজো ভাই। আর আমি বসে বসে শুনতাম।

চার: তখন আমার বয়স পাঁচ হবে, কিন্তু ঠুমরি, ভজন গান খুব ভালো লাগে। রেডিও শুনতাম সবার মতো, আর শুনে শুনে গাইতাম। একদিন মা-বাবা শুনে আমাকে বললেন, গান শিখবে? আমি মাথা নাড়লাম। পরের দিন উস্তাদজি যখন এলেন, বাবা আমাকে নিয়ে তার কাছে গিয়ে ১০ টাকার একটা নোট সালামি দিয়ে বললেন, ‘আপনার নতুন ছাত্র। ওকেও শেখান।’  আমার তালিম শুরু হলো।

পাঁচ: উস্তাদজি পাশে বসিয়ে বললেন, ‘যে গান জানো গাও।’ আমি শুরু করলাম কণিকা ব্যানার্জীর ‘আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজাও বাঁশি’ গান দিয়ে। শেষ হলে ভাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ও তো ভালো পারে। কারও কাছে শিখেছে?’ ভাই বললেন, ‘না, নিজেই গাইতে গাইতে শিখেছে।’ তখন উস্তাদজি যে কাজটা করলেন সেটা আমার মনে করি রীতিমতো বিপ্লবী। তিনি বললেন, ‘ওকে সারগাম শেখাব না এখন। কানে শিখুক আগে। যখন গান ভেতরে জায়গা পেয়ে যাবে তখন সারগাম শিখবে।’ আমার তালিম নেওয়া শুরু হয়ে গেল।

ছয়: প্রথম যে গানটা শিখলাম সেটা কার গান জানি না, তবে সন্ধ্যা আগমনের গান। তা হলে ‘পুরিয়া ধানশ্রী’ রাগে হতে পারে। লিরিক্স এক লাইন মনে আছে কেবল, ‘গোধূলি লগনে কে এলে চুপি চুপি রাঙা পায়...’। এত ভালো লাগে আজও শুনতে। কেবল এই একটা লাইনই মনে আছে, সাথে সুরটা, গায়কীটা। সবসুদ্ধ কেবল এক লাইন। তাই গাই মাঝে মাঝে।

দ্বিতীয় গানটা খুব পরিচিত। ‘তুম জাগো মোহন পিয়া’- খুব জনপ্রিয় ভৈরবী রাগ। এই রাগটা শেষ রাতের, কিন্তু হয়ে গেছে সকালের গান। কোনো গানের আসরের শেষ সমাপ্তির গান। ততক্ষণে ভোর হয়ে যায়, তাই ভোরের রাগ হয়ে গেছে। (কোথায় পড়লাম, ভুল হতে পারে)

তৃতীয় গানটির কথা, ‘আল্লা হু আল্লা, জাল্লে শানে আল্লাহ...’ এই গানটা নিয়ে একটু বাড়তি কথা আছে।

সাত: প্রথম গানটার হদিস পাব না মেনে নেই, দ্বিতীয় গানটা সবার চেনা। কিন্তু তৃতীয়টার সন্ধান অনেক করেছি, পাইনি। আমার খুব প্রিয় ছিল গানটা, বিশেষ করে এর গায়কী। বছর পাঁচেক আগে প্রথম শুনি উস্তাদ বিসমিল্লাহ খান বলছেন গানটা নিয়ে। বহু সার্চ দিয়ে খুঁজি, পাইনি তখন এর বেশি। কিন্তু খোঁজা থামাইনি। একদিন হঠাৎ শুনি প-িত অজয় চক্রবর্তী গাইছেন গানটা। শ খানেক বার শোনার পর নরমাল হই। ফিরে পেলাম  শৈশব কৈশোরে হারিয়ে যাওয়া নিজের প্রিয় গান। এটাও ভৈরবী রাগের গান, আমার সবচেয়ে প্রিয় রাগ।

আট: আমি গান গাইনি। তবে ওই কয় বছর শিখে যেটা হয়েছে- আমার কান একটু গানবান্ধব হয়েছে। আজ এত বছর পরও প্রতিদিন গান শুনি- আহার, স্নান, বিদ্যাচর্চার মতো নিয়মিত। উস্তাদজি আমাকে যেটা দিয়েছে- সেটা হলো এই ভালোবাসা, একটু প্রশিক্ষিত শ্রবণ ক্ষমতা, সঙ্গীতপ্রিয়তা। গানের কথা নয়, আমার সুর প্রিয়। কথার বাসভূমি কবিতায়। সঙ্গীতের ঘর সুরে। উস্তাদজি এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন আমাদের বাড়িতে যে আমার মা পর্যন্ত গিটার শেখা শুরু করেন। একবার সঙ্গীতের দুনিয়ার দরজা খুললে সেটা আর বন্ধ হয় না।

নয়: একটা ঘটনা বলি। একদিন তিনি বললেন, কাল আমি রেডিওতে গান গাইব, তুমি শুনবে। পরের দিন রেডিও ছাড়া হলো, তিনি গাইছেন, ‘ক্যা করু সজনী, আয়েনা বালাম...’ বড়ে গোলাম আলী খাঁর ওমর ঠুমরি-ই সেই যে শুনলাম ১৯৫৮ সালে, আজও শুনছিই। কতবার হবে? এক লক্ষ হলো এই কয়দিনে?

দশ: তাই আজ ধন্যবাদ, কৃজ্ঞতা। তাসলিম জানাই আপনাকে উস্তাদজি। জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি, কিন্তু আপনার দানের তুলনা হয় না। আপনি আমাকে বিশ্বের সুন্দরতম অনুভব উপভোগ করতে শিখিয়েছেন। আমি উনার পরিবারের কাউকে চিনি না। যদি কেউ চেনেন, আমার অনুভূতি পৌঁছে দিয়েন। সালাম উস্তাদজি, সালাম।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //