কাগমারী সম্মেলন: স্বাধীনতার নান্দিমুখ

কাগমারী সম্মেলন আমাদের স্বাধীনতার নান্দিমুখ। পলাশীর প্রান্তরে অস্তমিত হয়ে যাওয়া স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার উদগ্র বাসনা। সেই বাসনা তেজোদীপ্ত করতে যুগে যুগে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্তরের রাজনীতিবীদদের পাশাপাশি এদেশের ফকির, সন্নাসী, সিপাহী, জনতা, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এই সময়কালেই ভারতবর্ষে উচ্চবর্গের রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস, মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছে। কিন্তু পৃথকভাবে নিম্নবর্গের রাজনীতি আর বাংলার স্বাধীনতার কথা ক’জনইবা ভেবেছেন। হ্যাঁ, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ভেবেছেন। আসামে বাঙ্গাল খেদা বিরোধী আন্দোলন, লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়েই তিনি প্রথম নিম্নবর্গের মানুষের অনুকূলে পৃথক বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নবীজ বপণ করেছিলেন। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের 'স্টেটস' শব্দটি তাকে আশাবাদীও করে তোলে। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মেটাতে তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের তরীতে উঠেছেন। তবে এসব রাজনৈতিক দলের সাথে থেকেও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতির।

অন্নদাশঙ্কর রায় তাকে নিয়ে লিখেছেন, ‘তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে অন্য কোন নেতার তুলনা আনতে হয় না। তার সময়ে কিংবা তার আগে পরে যত নেতা এসেছেন, মওলানা ভাসানী সবার থেকে আলাদা এক চরিত্র। কিংবা বলা যেতে পারে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আদর্শিক জগৎ, যেখানে মিলবে না মহাত্মা গান্ধী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, সুভাসচন্দ্র বসু অথবা জয়প্রকাশ নারায়ণের মতো কোনো চরিত্র।’ আর তাই তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে জুড়ে দিয়েছিলেন জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলন, কৃষক প্রজা মুক্তির আন্দোলন ইত্যাদি। কংগ্রেস, মুসলিম লীগের জমিদার শ্রেণীর অনেক নেতাকেই তিনি তার আন্দোলনে সামিল করে ছেড়েছেন। অন্যদিকে কৃষক মেহনতি  শ্রেণীকেও তাদের মুক্তি সংগ্রামে সোচ্চার করে তুলেছেন। ভারত ভাগের শেষ সময়েও তিনি সিলেটের সফল গণভোট আর আসামে গণভোটের প্রস্তাব পেশের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার সাথে নিজেকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ১৯৪৭ সালের দেশভাগ তার সেই আশা পরিপূর্ণ মেটাতে পারেনি। 

মওলানা ভাসানী মওলানা ভাসানীই। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হতে না হতেই তিনি বাঙালি চেতনার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানি চেতনার দ্বৈরথ আর শোষণের নয়া মেরুকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হলেন। ১৯৪৮ সালের শুরুতেই উচ্চারণ করতে বাধ্য হলেন, ‘আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম?’ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ গঠন করলেন। ১৯৫৪ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সাথে নিয়ে ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্টের বিজয় নিশ্চিত করলেন। কিন্তু ক্ষমতা লাভের পর আওয়ামী লীগকে মুসলীম লীগের পুরনো পথে হাটতে দেখে তিনি আশাহত হলেন। আয়োজন শুরু করলেন কাগমারী সম্মেলনের। ১৯৫৭ সালের ৬, ৭, ৮, ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের অজপাড়াগাঁ কাগমারীতেই তিনি ডাক দেন আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের। তৎকালীন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবে নয় বরং সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তি উদ্যোগে আয়োজিত এবং অনুষ্ঠিত কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক কাম রাজনৈতিক সম্মেলন। এই  সম্মেলনে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর তার সাংস্কৃতিক চৈতন্যোদয়ের ডাক দেন।

অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতে, ‘এমন একটি সাংস্কৃতিক আয়োজন অবিভক্ত বাংলায় আগে ও পরে অথবা কখনও হয়নি।’ কাগমারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে মওলানা ভাসানী বস্তুত স্বাধীন জাতিরূপে বাঙালি আর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাংস্কৃতিক ভিত-ভূমি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। এই সম্মেলনে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানিয়ে শুধু স্বাধীনতার আগাম ঘোষণাই দেন নাই; একটি স্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দর্শনও উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। আসলে সম্মেলনটি নামে সাংস্কৃতিক সম্মেলন হলেও সেখানে ভাষা, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি, ভূমিব্যবস্থা, কৃষি, রাসায়নিক শিক্ষা, নারীসহ বিষদ বিষয় ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু। যেমনঃ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, পাকিস্তানের ভাষা; ড. কুদরত-ই-খুদা, পূর্ব পাকিস্তানের রাসায়নিক শিল্পের ভবিষ্যত উন্নতি; ড. মাহমুদ হোসেন, অন দ্য কনসেপ্ট অব ইসলামিক কালচার; ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, পূর্ব পাকিস্তানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব; ড. আখলাকুর রহমান, থটস্ অন দ্য ফাইনানশিয়াল অ্যাসপেক্ট অব দ্য ডেভেলপমেন্ট অব এগ্রিকালচার; শওকত ওসমান,  আধুনিক বাংলা সাহিত্য; ড. মুহাম্মদ ওসমান গনি, বিকল্প খাদ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা ও পন্থা; আবদুল হাকিম, পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা; অধ্যক্ষ ওসমান গনি, পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম; ড. নুরুল ইসলাম, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন; বি. এম. আব্বাস, সেচ ব্যবস্থা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ; ড. সামসুদ্দিন আহমদ, অন হার্ট ডিজেস; ডা. এম. এন. নন্দী, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়নে মেডিকেল এসোসিয়েশনের ভূমিকা; মিসেস কুলসুম হুদা, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ইত্যাদি।

বাংলাদেশের তৎকালীণ প্রায় সকল বয়সের প্রগতিবাদী লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, নাট্যকার, সংগীতাজ্ঞ, সাংবাদিকসহ ভারত, ব্রিটেন, মিসর, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন, সেভিয়েত ইউনিয়ন প্রভৃতি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছিলেন এই সম্মেলনে। কাগমারী সম্মেলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল এই সম্মেলন থেকেই মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের মানুষকে প্রত্যক্ষভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। 

মওলানা ভাসানী কাগমারী সম্মেলনের এক ফাঁকে গ্রামের পথে হাটতে হাটতে ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘পূর্ব বাংলা একদিন স্বাধীন হবেই। ১২ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।’ তাই এদেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি জনতার জন্যৎ সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি প্রতিচ্ছবি তিনি আঁকতে চেয়েছিলেন এই কাগমারীতে বসেই। আর কি হবে সেই স্বাধীন দেশের মানচিত্র, চিন্তা আর বোধের ধারণা? কাগমারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তিনি একটি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রবল প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।রাজনীতি আর সংস্কৃতির স্রোতধারাকে এক মোহনায় টেনে এনেছিলেন। যে পথ ধরে হেটে হেঁটেই আমরা স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় কাগমারী সম্মেলন হতে প্রাপ্ত সেই আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিচয় আমরা বহন করতে পারিনি। তাই বাঙালি জাতির মুক্তি আসেনি। আমাদের স্বাধীনতার ফসল লুটেরা অর্থনীতি আর বিজাতীয় সংস্কৃতির কাছে জিম্মি।  আমরা ভঙ্গুর হতে হতে ফতুর হতে চলেছি। কাগমারী সম্মেলনের চেতনা আমাদের গড়ার পথ দেখাতে পারে। কেননা কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক। এই মাইলফলক এড়িয়ে অন্য কোনো পথে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস সঠিক পূর্ণতা পায় না।

লেখক: সদস্য সচিব, ভাসানী পরিষদ ও প্রকল্প সমন্বয়ক, ভাসানী গবেষণা প্রকল্প।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //