কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক

সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষের ক্ষেত্রে যেটি ঘটে- মানুষ তার বুদ্ধি, বিবেক নিয়ে নিজেদের সুন্দরভাবেই প্রতিপালন করতে পারে। কিন্তু সমাজের কিছু মানুষ এ কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তাদের অশুভ ক্ষমতার বলে বিপুল মানুষের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও স্বাধীন কর্মোদ্যোতনাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। প্রকৃতিও নিজের মতো করে নিজেকে সুন্দরভাবে প্রতিপালন করতে পারে। কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রকৃতিকে ধ্বংস করে। মানুষ ও প্রকৃতি মিলিতভাবে পৃথিবীকে স্বর্গে পরিণত করতে পারে। কিন্তু সেই মানুষই আবার পৃথিবীকে নরকে পরিণত করতে পারে। 

এই কিছু মানুষ কারা? আমরা সেপিয়েন্স মানুষদের ইতিহাস পড়ে জেনেছি, সুদূর অতীতের আদি সেপিয়েন্স মানুষদের তৈরি সাম্যের সমাজ ভেঙে গিয়ে তৈরি হয়েছিল শ্রেণিবিভক্ত সমাজ। সেপিয়েন্স মানুষেরা তখন থেকেই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদিকে সমাজের খুবই অল্প কিছু মানুষ, অন্য সকল মানুষের যৌথ সম্পদ ও সম্পত্তি নিজেদের দখলে নিয়ে হয়ে উঠেছিল সমাজের প্রভু। অন্যদিকে আর সকল মানুষ হয়ে গিয়েছিল ওই কিছু মানুষের দাস। তারপর দাস মানুষদের রক্ত শোষণ করে তারা হয়ে উঠেছিল সামন্ত প্রভু, রাজা, মহারাজা, সম্রাট। সেই কিছু মানুষ সমাজের ৯০ ভাগ মানুষের ওপর নির্মম শোষণ-লুণ্ঠন, নিপীড়ন চালিয়ে সমাজকে নরকে পরিণত করেছিল। 

তারপর প্রতিষ্ঠিত হলো পুঁজিবাদী সমাজ। সেখানেও কিছু মানুষ হয়ে উঠল ধনিক পুঁজিপতি, আর বিপুল মানুষ হয়ে গেল তাদের শ্রমদাস। সেই কিছু মানুষ নতুনভাবে হয়ে উঠল প্রবঞ্চক, শোষক, নিপীড়ক, জুলুমবাজ, বিলাসী, লম্পট। আর বিপুল মানুষ হয়ে পড়ল শোষিত, নিপীড়িত, দরিদ্র, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত। ওই কিছু মানুষের কারণেই শুরু হলো যুদ্ধ, আগ্রাসন, গণহত্যা ও রক্তপাত। সেই কিছু মানুষ থাকল নিরাপদে, আর বিপুল মানুষের জীবন হয়ে উঠল, দুঃখ, দুর্দশা ও বঞ্চনায় কাতর, দুর্বিষহ। 

এ জন্যই সত্যদর্শী কবি এক অকাট্য সত্যকথা উচ্চারণ করেছেন, “কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক/কে বলে তা বহুদূর/মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক/মানুষেতে সুরাসুর।”

কবির ভাষায় এই ‘সুরাসুর’ কথার মধ্যে ফুটে উঠেছে এক রূঢ় বাস্তব সত্য। সুরাসুর কথার অর্থ হচ্ছে একই সাথে ‘সুর’ ও ‘অসুর’, অর্থাৎ দেবতা ও দানব। প্রাচীন ধর্মতত্ত্বমতে দেবতা হলো কল্যাণের প্রতীক, আর অসুর বা দানব হলো অকল্যাণ ও ধ্বংসের প্রতীক। হিন্দুধর্মে এক দেবতা আছে, তার নাম ‘দেবাসুর’। সে একই সাথে দেবতা ও অসুর (দানব)। মানুষের মধ্যেও দুই রকমের মানুষ আছে, ‘দেবতা’ ও ‘দানব’। কোনো কোনো মানুষ মানবপ্রেম ও কল্যাণের প্রতীক, আর কোনো কোনো মানুষ অকল্যাণ ও ধ্বংসের প্রতীক। 

মনীষীরা বলেন, মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব, অমৃতের সন্তান। আদিম সাম্যবাদী সমাজের সেপিয়েন্স মানুষেরা ‘অমৃতের সন্তান’ই ছিল, আজকের পৃথিবীরও বেশিরভাগ মানুষ ‘অমৃতের সন্তান’। আবার আদিম সেপিয়েন্স মানুষদের মধ্যে যেমন কিছু দানব-মানুষের উদ্ভব হয়েছিল, যারা পৃথিবীকে নরকে পরিণত করেছিল, তেমনি আজকের পৃথিবীতেও কিছু মানুষ দানবে পরিণত হয়েছে, যারা পৃথিবীকে নরকে পরিণত করেছে। এই দানব প্রকৃতির মানুষের দ্বারা সৃষ্ট সংকট ও প্রতিবন্ধকতার জন্য অন্য সকল মানুষের প্রতিপালন (জীবন ও জীবিকা) ভয়াবহ রকমের দুর্দশা ও দুর্গতির মধ্যে পতিত হয়েছে। এমনকি গোটা পৃথিবী আজ পুরোপুরি ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

দুই

জগৎ ও জীবনের প্রতিপালনের কাজে এই যে- ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণের ব্যাপারগুলো ঘটে, সেগুলো কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির দ্বারা ঘটে না। এই সবকিছুই মানুষই ঘটায়। ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে পৃথিবীর প্রায় সকল মানুষ, পৃথিবীতে মানুষে মানুষে একতা, ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের সমাজ কামনা করে। কিন্তু কিছু মানুষ অন্য সকল মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, শত্রুতা, অসাম্য, অশান্তি, যুদ্ধ ও সংঘাত সৃষ্টি করে। পৃথিবীতে কোনোদিন মানুষ সাম্য, মৈত্রী ও শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কিনা, তা ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করবে। সেই কাক্সিক্ষত সমাজ যদি কোনোদিন প্রতিষ্ঠিত হয়, তা মানুষই করবে। 

এ জন্যই সাধক কবি লালন বলেন, “মানুষ ভজ”। এই মানুষ ‘ভজার’ অর্থ মানুষকে উপাসনা করা নয়, এর অর্থ মানুষকে ভালোবাসা। সমাজে সাম্য, শান্তি, ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীর সকল মানুষ একতাবদ্ধ হতে পারে একমাত্র ভালোবাসার মাধ্যমে। রাজনৈতিক আন্দেলন বলি, বিপ্লবী আন্দোলন বলি, কিংবা সাংস্কৃতিক আন্দোলন বলি, সকল আন্দোলনের মূল সেøাগান হওয়া জরুরি- ‘মানুষকে ভালোবাস’। সকল প্রকারের আন্দোলনের ঘোষণার সাথে যুক্ত হওয়া জরুরি- ‘মানুষকে ভালোবাস’। কলে-কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে, মাঠে-ময়দানে, অফিসে-আদালতে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ুক- মানুষে মানুষে ভালোবাসার স্লোগান। সমাজ-বিপ্লবের চেতনাকে শানিত করার স্লোগানও হয়ে উঠুক- ‘মানুষকে ভালোবাস’।

-লেখক ও গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //