বাংলা ভাষা নিয়ে নৈরাজ্য চলছে

ভাষার মাধ্যমে মানুষের সংস্কৃতি প্রকাশ পায়। ভাষা ব্যবহারের মধ্য দিয়েই একজন মানুষকে চেনা যায়। আমাদের জাতীয় পরিচয় কী, সেটাও ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। কিন্তু আমাদের এখনকার ভাষার যে ব্যবহার তা খুব গৌরবজনক নয়। আমি দেখেছি, মানুষ সঠিকভাবে বাংলা উচ্চারণ করে না। বাংলা ভাষার সাথে ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে ফেলে। আর বিশেষ করে টেলিভিশনে, নাটকগুলো ভাষার ব্যাপারে একেবারেই সচেতন নয়। সেখানে শুধু হুংকার, চিৎকার, ভাষার অশুদ্ধ ব্যবহার। অথচ গণমাধ্যমের ভাষা কিন্তু জনজীবনের উপরে প্রভাব ফেলে।

লেখার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে গুছিয়ে লিখছে না। লেখার অভ্যাসটাই আগের মতো নেই। শিক্ষিতরা মনে করে, যে কোনোভাবে লিখলেই চলে। ইংরেজিতে যখন কেউ লেখেন, তখন ভুল হলে তারা লজ্জা পান। বা ভুল যাতে না হয় তার চেষ্টা থাকে- এজন্য ডিকশনারি দেখেন এবং চিন্তা করেন। অথচ বাংলার ব্যাপারে তারা যেন খুব স্বাধীন; শুদ্ধভাবে পড়তে বা লিখতে হবে- এটা ভাবেনই না। তার মানে হচ্ছে বাংলা ভাষায় লেখা ও বলার ব্যাপারে একটা অবজ্ঞার ভাব আছে। ভুল হলো কি না, শব্দটা যথার্থ কি না, বানান ঠিক আছে কি না বা অভিধান দেখে যাচাই করে নেবে এটার প্রয়োজনীয়তাই মনে করে না। এটা দুঃখজনক।

আরেকটা ব্যাপার আছে, ব্যক্তিগত কথাবার্তাতেও একটা গ্রাম্যতা থাকে। যেমন- আগে আমরা মনে করতাম প্রমিত ভাষাতেই কথা বলতে হবে, এটাই ভদ্রভাষা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, প্রমিতর মধ্যে কথ্য বা স্থানীয় ভাষা চলে আসছে। লেখার ক্ষেত্রেও প্রবন্ধ বলেন, গল্প বা উপন্যাসে কথ্য ভাষাটাকেই ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি খাইছি, গেছি এই টাইপের শব্দ ব্যবহার চলছে। আগে যেমন আমরা শুনতাম গুরুচণ্ডালী ভাষা, সাধু-চলিত মিশ্রিত, এখন যেন সেই অবস্থা চলছে। ভাষা নিয়ে সর্বত্র একটা নৈরাজ্য বিরাজ করছে। আমাদের সমাজে এবং রাষ্ট্রে এসব নিয়ে কোনো জবাবদিহিতা নেই। একটা ভুল কাজ করলে তার জন্য যে দায়ী হওয়া বা তাকে অভিযুক্ত করা এটাই যেন নেই। ফলে সর্বত্র একটা জবাবদিহিতার অভাব ঘটছে। এটা রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু হয়েছে এবং সেটা প্রতিফলিত হচ্ছে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। মানুষ ভাবে, যেহেতু বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এর ব্যবহারের ব্যাপারে প্রত্যেকেই স্বাধীন। এটার শুদ্ধ ব্যবহার সম্বন্ধে আমাদের কোনো দায়িত্ব নেই। 

একটা জিনিস লক্ষ করার বিষয়, বাংলা ভাষা কিন্তু সবসময় জনগণের ভাষা ছিল এবং জনগণই এই ভাষা রক্ষা করেছে। উচ্চ শ্রেণির লোকেরা এক সময় ফার্সি ব্যবহার করত, তার আগে সংস্কৃতি, তারপর ইংরেজি। মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের সাধারণ মানুষই কিন্তু বাংলা ভাষাকে রক্ষা করেছে এবং তারাই এর অভিভাবক। কিন্তু এই জায়গাটাতেই ভাঙন ধরেছে। সাধারণ জনগণের যেমন এখন ক্ষমতা নেই, সেরকম বাংলা ভাষাও আগের মতো শক্তিশালী হচ্ছে না। ভাষার শক্তি শুধু আওয়াজের উপর নয়, এর যথার্থ ব্যবহার, অর্থপূর্ণতা, এর দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করার উপর অনেকটা নির্ভর করে। 

আরও একটা ব্যাপার, আমাদের গবেষণামূলক রচনাগুলো বাংলায় নয় বরং ইংরেজিতে প্রকাশ হয়। ভাষা শক্তিশালী হয় জ্ঞানী লোকদের ব্যবহারের মধ্য দিয়েই। আবার ভাষা সমৃদ্ধিশালী হয় সাহিত্যিকদের কারণে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে জ্ঞানী লোকরা এখন বাংলায় গবেষণা প্রকাশ করতে চান না। তারা ইংরেজিতে বই লিখতে পছন্দ করেন। কারণ তারা মনে করেন ইংরেজির বাজারটা অনেক বেশি। বাংলা ভাষার লেখকরাও ঠিক ওইভাবে দায়িত্বটা নেন না। প্রকাশনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রত্যেকটা প্রকাশনার একটা সাহিত্য সম্পাদক থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের যারা প্রকাশক তারা সম্পাদক রাখেন না বা সম্পাদনার দায়িত্ব নেন না। ফলে লেখক তার ইচ্ছেমতো লেখা দিয়ে দেয়। আরেকটা বিষয় প্রুফ রিডিংয়েও দক্ষতা দরকার। বানান নিয়েও একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। বানানের একটা ঐতিহ্য আছে, বানানের একটা ছবিও আছে। কিন্তু বিশৃঙ্খলার জন্য আমাদের চোখে যে বানানটা ভাসে সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, বাংলা একাডেমির যেখানে ইতিবাচক ভূমিকা থাকা দরকার, তারা তা করছে না। যেমন বাংলা একাডেমী বানান দীর্ঘ ই-কার (ী) দিয়ে ছিল, এখন তারা করেছে হ্রস্ব ই-কার (ি)। এটার দরকার ছিল না। ভাষা তো একটা চলমান নদীর মতো। সেখানে তার গতিপথ এভাবে ব্যাহত করে অন্য পথে চালানো যাবে না। এটা আমাদের ইতিহাসের অংশ, যা আমাদের স্মৃতিতে, দৃশ্যপটে এবং ব্যবহারের মধ্যে আছে। এগুলোকে বাদ দেওয়ার অধিকার তো কোনো একাডেমিকে দেওয়া হয়নি। একাডেমির কাজ হচ্ছে ভাষার ব্যবহারকে উৎসাহিত করা। ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা নয়।

-ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //