ইসরায়েল কর্তৃক প্যালেস্টাইনের গণহত্যায় বাইডেনের লজ্জাহীন সমর্থন

গত বছর ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ওপর হামাসের আক্রমণের পর থেকে ইসরায়েল প্যালেস্টাইনে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের নামে যা করছে তা এককথায় গণহত্যা। যদিও তা স্বীকার করছে না ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা সমর্থক শক্তিরা। গাজায় যেকোনো মানুষ মারা যাচ্ছে পারলে সে কথাটাও তারা অস্বীকার করে। আবার প্রকাশ্যে তারা ঘোষণা করছে প্রথমে গাজাকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করে, পরে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনের।

আন্তর্জাতিক আদালত, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ইসরায়েলকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছে। কিন্তু ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের কোনো কমতি নেই। গত মাসে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডা সিলভা প্যালেস্টাইনে সংঘটিত গণহত্যাকে ইহুদিদের ওপর পরিচালিত হিটলারিয় হলোকস্টের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘গাজা উপত্যকায় প্যালেস্টাইনের মানুষের সঙ্গে যা করা হচ্ছে তা ইতিহাসে কখনো হয়নি। তবে এটা ঘটেছে একবার: হিটলার যখন ইহুদি হত্যা শুরু করে।’ (Brazil’s Lula compares Israel’s war on Gaza with the Holocaust, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, আল জাজিরা)

৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েলি আক্রমণে প্রায় ৩২ হাজার প্যালেস্টিনিয়ান নিহত ও ৭৫ হাজার আহত হয়েছেন। এরমধ্যে ১৩ হাজার শিশু আর নারী, শিশু ও বৃদ্ধ মিলে দুই-তৃতীয়াংশ। জ্যাকোবিন সাময়িকীতে প্রকাশিত এক লেখায় (Israel’s Flour Massacre in Gaza Is a Horrific War Crime, 3 March 2024) Seraj Assi লিখেছেন, “প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে। অর্ধেক মানুষ না খেয়ে বেঁচে আছে। চলে যাওয়ার জন্য ইসরায়েলি নির্দেশ সত্ত্বেও কয়েক লাখ প্যালেস্টিনিয়ান এখনো উত্তর গাজায় আছেন, অনেকেই পশুখাদ্য খেয়ে প্রাণধারণ করছেন। কঙ্কালসার শিশু ও তাদের পশুখাদ্য বমি করে মৃত্যুবরণের করুণ ছবি অনেকেই দেখেছেন। গাজায় চিকিৎসকরা বলছেন, দুর্ভিক্ষ গাজার শিশুদেরকে কঙ্কালে পরিণত করছে।

সারা বিশ্বের মানুষের চোখের সামনে প্রতিদিন চলমান এই জায়নবাদী গণহত্যার অভিযান থেকে স্পষ্ট যে বৈশ্বিক ক্ষমতাকাঠামো এখন কতটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে যখন কিনা পশ্চিমা প্রধান রাজনৈতিক চর্চা মানবতা হারিয়ে ফেলার পথে। পশ্চিমা বড় বড় শহরগুলোতে এ গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে ও হচ্ছে যাতে অংশগ্রহণ করছেন বিশ্বের অনেক মানবতাবাদী ইহুদিও। তা সত্ত্বেও সেখানকার রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীনরা ইসরায়েলের জায়নবাদী রাষ্ট্রকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে চলেছে।

পশ্চিমা বিশ্বে ঘটে যাওয়া এই নৈতিক অবক্ষয় সেখানকার ব্যাপক মানুষকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করে তুলেছে আর প্রতিকারের কোনো উপায় না দেখে তা তাদেরকে হতাশাগ্রস্ত করছে। এরই এক আক্ষরিক অর্থেই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হলো আরোন বুশনেলের আগুনে আত্মাহুতি। বুশনেল যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর একজন সক্রিয় সদস্য। গাজায় ইসরায়েল পরিচালিত গণহত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় সমর্থনকে তিনি প্রতিবাদ করেছেন ওয়াশিংটনে ইসরায়েলি দূতাবাসের সামনে নিজ শরীরে গ্যাসোলিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তা সরাসরি সম্প্রচার করে। নয় ঘণ্টা পর ২৫ বছরের যুবক বুশনেল মৃত্যুবরণ করেন হাসপাতালে। তার কথা: “আমি এই গণহত্যায় অংশগ্রহণকারী নই।” আর চিৎকার করে বলতে থাকেন, “প্যালেস্টাইন মুক্ত করো।”

তার বন্ধু লেভি পিয়ারপন্ট একই বিবেক দংশনের কারণে ২০২৩ এ বিমান বাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি বুশনেলের প্রতিবাদী আত্মহত্যা নিয়ে গার্ডিয়ানে লিখেছেন ((Aaron Bushnell was my friend. May he never be forgotten, ২ মার্চ ২০২৪), “আমরা এখন যা করতে পারি তা হচ্ছে তার সেই বার্তাটি শোনা যার ওপর তিনি আলো ফেলেছেন: গাজায় গণহত্যার নির্মমতা এবং এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সরকারকে আয়কর প্রদানকারী ও সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে এই অপরাধে আমাদের সংশ্লিষ্টতা।”

অথচ আশ্চর্য হচ্ছে আজকের লজ্জাহীন পশ্চিমা গণমাধ্যম বুশনেলকে একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টায় লিপ্ত। জায়নবাদী মনোবিদ্যা বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিতদের পক্ষে এটা বোঝাই অসম্ভব যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন মানুষের পক্ষে নিজের জীবন হরণ করে কোনো চলমান অনৈতিক ঘটনার প্রতিবাদ করা অসম্ভব। তারা এটা বুঝতেই পারে না যে, মানসিক বিকার কোন পর্যায়ে পৌঁছালে ইসরায়েল কর্তৃক প্যালেস্টাইনে সংঘটিত এই ভয়ঙ্কর গণহত্যার দৃশ্যসমূহ কারো পক্ষে নির্বিকারভাবে দিনের পর দিন দেখে যাওয়া সম্ভব।

প্যালেস্টাইনে গণহত্যায় নিয়োজিত এই জায়নবাদী চক্র সম্প্রতি MSNBC-র Mehdi Hasan Show থেকে নির্ভিক সাংবাদিক ও মিথ্যুকদের আতঙ্ক মেহেদী হাসানকে সরিয়ে দিয়েছে। তার ওপর তাদের আক্রোশের খড়গ নেমে আসার কারণ তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর উপদেষ্টা মিথ্যাবাদী মার্ক রেগেভকে সাক্ষাৎকারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তাকে ন্যাংটা করে ছেড়েছেন। মেহেদী তার সকল মিথ্যাচারকে একে একে ধরার পরই তার ওপর জায়নবাদী চক্রের চূড়ান্ত আঘাত নেমে আসে ও তাকে MSNBC ছাড়তে বাধ্য করা হয়। সুখবর হচ্ছে আজকের দুনিয়ার অনন্য সাহসী, আপোষহীন ও মেধাবী সাংবাদিক মেহেদী তার নিজের নতুন স্বাধীন গণমাধ্যম হিসেবে চালু করেছেন Zeteo।

কিছুদিন আগে আবার গাজায় ঘটে গেল ট্র্যাজেডির ওপর ট্র্যাজেডি-গণহত্যার ওপর গণহত্যা। ক্ষুধার্ত মানুষেরা ত্রাণ হিসেবে আটা নেওয়ার জন্য ট্রাকের সামনে দাঁড়ালে তাদের মাথা ও বুক ঝাঁঝরা হলো ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলির বৃষ্টিতে। ইসারায়েলি ট্যাংক পিষে ফেলল তাদের মৃত ও আহত দেহগুলিকে। এই বর্বর আক্রমণে মুহূর্তে মৃত্যু হলো একশোর বেশি মানুষের ও আহত হলো এক হাজারের বেশি মানুষ।

Seraj Assi তার পূর্বোল্লিখিত লেখাটিতে বলেছেন, “এই হত্যাকাণ্ড যুদ্ধাপরাধের উপরে যুদ্ধাপরাধ, যেখানে ইসরায়েল প্যালেস্টাইনে মানুষকে মাসের পর মাস না খাইয়ে রেখে তারপর হত্যা করছে, যাদের একমাত্র অপরাধ হচ্ছে ক্ষুধার্ত পরিবারের সদস্যদের জন্য আটা সংগ্রহ করতে লাইনে দাঁড়ানো। প্যালেস্টাইনের সরকারি কর্মকর্তারা এই হত্যাকে বলেছেন ‘ঠাণ্ডা মাথার খুন।’ প্যালেস্টিনিয়ানরা একে বলছে ‘আটা হত্যাযজ্ঞ।’ মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া রক্তাক্ত আটার সঙ্গে মিল রেখে আরও সঠিকভাবে বললে এটি হলো ‘লাল আটা হত্যাযজ্ঞ।’

এসব রক্তাক্ত ঘটনার কোনো কিছুই ইসরায়েলকে দমাতে পারেনি। গাজাকে জনশূন্য করে সেখানে ইহুদি রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে একচুল নড়েনি নেতানিয়াহু। আর এই মানবতাবিরোধী পরিকল্পনা সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। প্যালেস্টাইনের মানুষের মাথার ওপর প্রতিদিন যে বোমাগুলো পড়ছে সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কারখানায় তৈরি। ইসরায়েলে অস্ত্র তৈরির টাকাও আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সেই অস্ত্র আবার বিক্রিও হচ্ছে আমেরিকার বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর কাছে। এর (কু) নীতি হলো- সমগ্র প্যালেস্টাইন দখল ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ইসরায়েলকে প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়ে দেয়া, অন্যদিকে আকাশ থেকে ফেলা খাদ্যসাহায্য নিতে আসা ক্ষুধার্ত মানুষদেরকে গুলি করে মেরে ফেলতে ইসরায়েলি সৈন্যদেরকে সদা প্রস্তুত রাখা।

Stephen Semler জ্যাকোবিনে প্রকাশ করেছেন (Joe Biden Is Shipping Weapons to Israel Every 36 Hours, ১৩ মার্চ ২০২৪), এ হামলার শুরু থেকে “জো বাইডেন এ পর্যন্ত একশোর বেশি যুদ্ধাস্ত্র-সজ্জিত জাহাজ পাঠিয়েছেন ইসরায়েলে।” তিনি লিখেছেন, “৭ অক্টোবর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাইডেন ২১ হাজার বোমা সরবরাহ করেছেন, যার অর্ধেক ইসরায়েল ইতিমধ্যে প্যালেস্টাইনের মানুষের মাথায় ফেলেছে।” আর “গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণ চলছে কারণ বাইডেন চায় এটা চলুক।”

বাইডেন যে মিষ্টি ভাষায় ইসরায়েলের সমালোচনা করছেন তা নেতানিয়াহুকে আরও উৎসাহিত করতে ভূমিকা রাখছে। বাইডেনের এক হাতে ইসরায়েলকে বোমা সরবরাহ ও অন্য হাতে প্যালেস্টাইনে খাদ্যসাহায্য পাঠানো এক ঐতিহাসিক দ্বিচারিতা যা এ গণহত্যাকে চলমান রাখতে সাহায্য করছে। এ গণহত্যা বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের যা করতে হবে তা হলো ইসরায়েলকে অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ এখনই বন্ধ করা। সম্মান করা উচিৎ আরোন বুশনেলের শেষ কথাকে: “প্যালেস্টাইন মুক্ত করো।”

লেখক : সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি (ছোটকাগজ)

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //