কেমন হলো বইমেলা ২০২৪

বাংলাদেশে বইমেলা শুরুর ইতিহাসের সঙ্গে তিনজনের নাম সম্পৃক্ত। বাংলা একাডেমির সরদার জয়েনউদ্দিন, স্টান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী এবং মুক্তধারার চিত্ত রঞ্জন সাহা। ১৯৬৫ সাল থেকে শুরু হলেও উদ্যোগটি নিয়মিত আকার ধারণ করে ১৯৭২ সাল থেকে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের দান একাত্তরের স্বাধীনতা আর একাত্তরের স্বাধীনতার দান একুশের বইমেলা। আজ অবধি বাঙালির মননের এবং চিত্ত বিকাশের অন্যতম নিয়ামক এই বইমেলা। বাংলা একাডেমি স্বয়ং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অবদান। বায়ান্ন সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল স্বাধিকার, জাতীয়তা, গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িকতার আন্দোলন। 

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ফলে আমাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু সে সুযোগের ভিত্তি দিয়ে আমরা কী কী গড়েছি, করেছি এবং কী করা প্রয়োজন তা একটি গুরুতর জিজ্ঞাসা। শুধু এইটুকু বলা যায়, যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার অন্তর্নিহিত সারবস্তু আজ অবধি অনর্জিত রয়ে গেছে। 

বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলা আগে একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হতো। এখন তা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। এই ব্যাপক বইমেলা আমাদের চিত্তকে দোলা দেয়। প্রতিটি স্টলে কমবেশি ভালো বই থাকে, কয়েকশ স্টলে প্রকাশকরা গ্রন্থ সাজান। জাপানি প্রবাদে বই হলো স্বর্গ- এখানে সকল বাঙালি মুক্তির নিঃশ্বাস নিতে পারবেন। 

বইমেলাকে উন্নীত করার জন্য কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। এ মেলা দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। কিন্তু এ চর্চায় বাধা হিসেবে কাজ করছে পাইরেসি। ভালো বই নীলক্ষেত, বাংলাবাজার এবং আরও কোনো কোনো জায়গা থেকে পাইরেসি হয়। ফলে প্রকাশক তার উৎসাহ হারান- প্রকাশকের পরিশ্রমের ফসল নিয়ে যায় পাইরেসি মাফিয়ারা। আর প্রকাশক বই ছাপান মাত্র শ তিনেক বা শ পাঁচেক। তারও কারণ এই পাইরেসি। পাইরেসির ফলে প্রকাশক লেখককে রয়্যালটি দিতে পারেন না। লেখকও হতাশ হয়ে পড়েন। বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত বিদেশি বই এবং ইংরেজি বইয়ের সমস্যা। এখানকার ইংরেজি স্কুলে এবং ইংরেজি-প্রিয় ইংরেজি-জানাদের কাছে যেসব ইংরেজি বই সরবরাহ করা হয় তার অধিকাংশই বিদেশাগত। এটা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ওপর আগ্রাসী ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক আক্রমণ। দরকার দেশি ইংরেজি বই, দেশি গবেষণার বই এবং দেশি সৃজনশীল বই। তা হলে মেলা সমৃদ্ধ হবে। 

রয়্যালটি প্রদান নিশ্চিত করার জন্য প্রকাশককে সচেতন থাকতে হবে। ভালো বই মানসম্মতভাবে মুদ্রিত হলে প্রকাশখরচ পরিমিত হবে। বই বেশি সংখ্যায় ছাপতে পারলে দামও কম রাখা যাবে। তবে বইয়ের মূল্য নির্ধারণে বিচক্ষণ নীতিমালা গ্রহণ আবশ্যক।

মেলায় গ্রন্থ সম্পর্কহীন স্টল অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে খাবারের স্টল প্রয়োজন আছে। 

কপিরাইট আইন নিয়ে সারাবছর সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও ওয়ার্কশপ করা বিশেষ প্রয়োজন। প্রকাশকদের এবং লেখকদের সেখানে মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে। তাহলে বইমেলায় ভালো প্রভাব পড়বে। 

মেলা মাঠের নকশা এবং সার্কুলেশন বিবেচনায় বিন্যাস করে নিতে হবে অভিজ্ঞ ঘরামিদের দ্বারা। সামঞ্জস্যপূর্ণ আয়তন নির্ধারণ করাও হবে যাদের অন্যতম দায়িত্ব। গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের প্রকাশকদের বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। জরুরি গ্রন্থ কী এবং কেন তা নিয়ে প্রকাশক-লেখক-রাজনীতিক-বিদ্বজ্জনদের নিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। গুণগত মানের একটি মানদণ্ড ঘোষণা করলে গ্রন্থ উৎপাদনে অসারতা লুপ্ত হবে বা কমে আসবে। এমনকি গ্রন্থ প্রচারেও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। অন্যদিকে দেশের লাইব্রেরিগুলোর গ্রন্থ ক্রয় নীতিমালার সঙ্গে গ্রন্থমেলার থাকতে হবে নাড়ির সংযোগ। 

শিশু-কিশোরদের মেলায় উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের বইমেলা ভ্রমণ এবং গ্রন্থ ক্রয় এবং পাঠের সঙ্গে সিলেবাস ও নম্বরের সংস্থান থাকা জরুরি। ছাত্রছাত্রীদের জীবন ও কল্পনার বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন প্রয়োজন। 

মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সীমাবদ্ধতা ও তার বাণিজ্যিক দিক সম্পর্কে জানানো প্রয়োজন। সর্বোপরি বাণিজ্যিক দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে এআই দখলি ধারাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার মধ্য দিয়ে মানুষকে হেয় করে ফেলার পুনঃপ্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দেওয়া ঠিক হবে না। বইমেলা আমাদের গ্রন্থবিহারী হওয়ার সুযোগ করে দিতে পারবে। গ্রন্থ অনুশীলনের বিকল্প সংস্কৃতির নামই গ্রন্থসংস্কৃতি, বইমেলা যার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। 

-শিক্ষক, গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //