যশোরের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

যশোর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত প্রথম স্বাধীন জেলা। সে হিসেবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে যে গুরুত্ব, অর্থনৈতিক মুক্তি আসার কথা ছিল তার হিসাব করতে গেলে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে মিল পাওয়া কষ্টসাধ্য। সাধারণ জনগণের দৃষ্টিতে এখনো যেসব বিষয় উন্নয়নের প্রতীক বিবেচিত হয় তার মধ্যে সরকারি উদ্যোগের চাইতে বেসরকারি উদ্যোগ অনেক বেশি বলেই প্রতীয়মান। 

যশোরের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা ভাবতে গেলে এক সময়ের চিরুনি ও খেজুর গুড়ের খ্যাতি চিন্তা করতে হয়। ভাবতে হয় সারা দেশের যানবাহন, বিশেষ করে বাস-ট্রাকের বডি ও ইঞ্জিন তৈরির কাজ বিষয়ে। যেখান থেকে নিম্ন মূলধন বিনিয়োগ ও আধা-স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি দিয়ে হালকা প্রকৌশল শিল্পের বিকাশ। এ সবই স্বাধীনতার আগের কথা। সে সময়ে এ অঞ্চলে সরকারি বেশ কয়েকটা বৃহৎ শিল্প যেমন পাট ও বস্ত্র শিল্পের কারখানা থাকায় মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল এবং কৃষিনির্ভর জীবন থেকে বের হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে ভারী শিল্পগুলোকে বিরাষ্ট্রীয়করণের খেলায় অন্তর্ভুক্ত করে লোকসানের অজুহাতে একের পর এক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, শিল্পগুলোকে জনগণের সম্পদ থেকে ব্যক্তির সম্পদে হাত বদল করে ফেলা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে জনসাধারণের মনে এ বিশ্বাস প্রোথিত হলো যে, স্বজাতি শাসনে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই নিজেদের উদ্যোগী করে তুলতে সাধারণ মানুষ ফুল চাষ, সবজি চাষ, রেণুপোনা উৎপাদন, নকশি সেলাইসহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার কাজে এগিয়ে আসে। ব্যক্তি উদ্যোগের এ আন্তরিক প্রচেষ্টাগুলোর মধ্য দিয়ে তাদের সৃজনশীলতা যেমন বেড়েছে, উদ্যোগগুলো খ্যাতি পেয়েছে, তেমনি উদ্যোগগুলোর মধ্য দিয়ে এলাকার অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানো সম্ভব হয়েছে। এখানে হালকা প্রকৌশল বিকাশ প্রায় একই পথে এগিয়ে চলেছে। 

যশোরের বিখ্যাত চিরুনি বহুদিন আগেই পথ হারিয়ে ফেলেছে। গুড়ের কাঁচামাল রস সরবরাহকারী খেজুর গাছের বড় অংশ ইটভাটা খেয়ে ফেলেছে। কাঁচামালের সরবরাহ টান পড়ায় বিখ্যাত সেই গুড়ে চিনির প্রকোপ পড়েছে। যেহেতু এ চিত্র সারা দেশের তাই এখনো খ্যাতি বিবেচনায় যশোরের গুড়ের চাহিদা বিদ্যমান। যশোরের খেজুর গুড়-চিরুনির মতোই খ্যাতি লাভ করেছিল বাস-ট্রাকের বডি নির্মাণ ও ইঞ্জিনের কাজ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যানবাহনের সংখ্যা বাড়তে থাকায় এবং সরকার সড়ক পথকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়ার ফলে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলতে না পেরে সমন্বয় হারিয়ে ফেলে যশোরের ব্যক্তি উদ্যোগ। মূলত এ খাতের হাত ধরেই যশোরে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ বা হালকা প্রকৌশল শিল্পের সূচনা। বর্তমানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় সনাতনী শ্রমে আটকে পড়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে এ শিল্প। পরিকল্পিত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেলে, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে এ খাতের জয়রথ সামনের দিকে আবার এগিয়ে যাবে নিশ্চিত করে বলা যায়। কৃষি ও ভারী শিল্পের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগের কলকারখানাতে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এ শিল্পের ধারাবাহিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞানকে ধারণ করতে না পারায় এক ধরনের স্থবিরতার কবলে পড়ে তা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে দীর্ঘকাল। রাষ্ট্রপতি এরশাদ সরকারের আমলে দেশে হালকা প্রকৌশল শিল্পের বিকাশে ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠা ও সাব-কন্ট্রাকন্টিং বিধিমালা করে যে সুবিধা প্রদান করা হয়েছিল তা সংশ্লিষ্ট সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারেনি। ক্ষমতাবান তেলবাজরা সিংহভাগ সুবিধা খেয়ে ফেলেছে। 

হালকা প্রকৌশল শিল্প ব্যবস্থায় উৎপাদনে অব্যাহতভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা সম্ভব হলে শ্রমের উৎপাদনশীলতা এবং উৎপাদিকা শক্তি বিকাশ সুনিশ্চিত হতো। পরিকল্পনার অভাব এবং সমন্বয়হীনতা এ শিল্পকে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে না নিতে পারলেও ব্যক্তি উদ্যোগগুলো জাতীয় অর্থনীতিতে নিজেদের মেধা মনন দিয়ে সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখে চলেছে। কৃষি ও শিল্পের আমদানিনির্ভর যন্ত্রাংশই শুধু নয় পাশাপাশি জীবননির্ভর ছোট-বড় শত শত যন্ত্র তৈরি করে সাধারণ মানুষের ধরাবাঁধা ছকের জীবনকে সহজ করতে সক্ষম হয়েছে। এখানে পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি ধারা ও প্রয়োগের দক্ষতা বৃদ্ধি, ব্যবহৃত কাঁচামালের সরবরাহ সহজলভ্য করে গুণগত মান পরীক্ষার ব্যবস্থা করা গেলে উৎপাদিত পণ্যের মান বৃদ্ধি পাবে, শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাবে আর তা হলেই সম্মিলিত পরিকল্পনায় শুধু দেশ নয়, বিদেশে হালকা প্রকৌশল শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের যে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে সেখানে অবদান রাখার ভূমিকা জোরদার হবে। 

দিনে দিনে বেড়ে ওঠা কিছু ব্যক্তি উদ্যোগ আজ মহীরুহ হয়ে উঠেছে। যেমন-যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারার ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফুল চাষ আজ অর্থকরী ফসল হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে। নববর্ষ, পহেলা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, একুশে ফেব্রুযারি, স্বাধীনতা দিবস, বাংলা নববর্ষ, বিজয় দিবসসহ জাতীয় ও আঞ্চলিক অনুষ্ঠানগুলোতে এবং ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ধরনের ফুলের চাহিদা মিটিয়ে গদখালী-পানিসারার এ ফুল আজ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। প্রথাগত কৃষি উৎপাদন থেকে বের হয়ে সবজি চাষ লাভজনক হওয়ায় যশোরের কৃষক সমাজ আজ ৩২ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে ৩৩ ধরনের সবজি চাষ করছে যার আর্থিক মূল্য এক হাজার কোটি টাকা। যশোর সদরের চাঁচড়া এলাকায় স্বল্প পরিসরে আশির দশকে 

দেশি-বিদেশি জাতের যে মাছের রেণুপোনা উৎপাদন শুরু হয়েছিল তা আজ দেশের প্রধান রেণু সরবরাহকারীর সম্মান অর্জন করেছে। ৩৬টি হ্যাচারিতে বছরে প্রায় দেড় লাখ কেজি রেণু উৎপাদিত হয়। এক কেজি রেণু থেকে প্রায় তিন লক্ষ পোনা পাওয়া যায় যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে; যার বাজার মূল্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। দুঃখের বিষয় এই যে, যশোরবাসীকে সম্মানিত করা উল্লেখিত তিনটি উদ্যোগের ক্ষেত্রেই কতকগুলো এজমালি সমস্যা বিদ্যমান। তারপরও পদ্মা সেতু হয়ে চলাচলের কারণে ফুল, সবজি ও রেণুপোনা সব ক্ষেত্রেই পণ্য পরিবহন সহজ ও দ্রুততর হয়েছে। কিন্তু ফুল এবং সবজির ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ও মানসম্মত বীজ নিশ্চিত করে উৎপাদন, সংরক্ষণ, পরিবহন, প্যাকেজিং ব্যবস্থা উন্নত করতে প্রশিক্ষণসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ সরকারিভাবে গ্রহণ করা হলে হাজার হাজার পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে সহায়ক হতো।

ভৈরব নদসহ যশোর অঞ্চলের নদীগুলোর বহতারূপ দেওয়া সম্ভব হলে মানুষের জীবন জীবিকায় ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হতো। এভাবে আরও অনেক বিষয়ের অবতারণা করে নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি করা যাবে; কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। কারণ আমাদের দেশে সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য একজন ব্যক্তির প্রয়োজন হয়। যশোরবাসীর দুর্ভাগ্য-স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার করেও এমন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে তারা খুঁজে পায়নি, তাই ঝুলে আছে ৫০০ শয্যার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, নৌবন্দর, ঢিমে তালে হলেও চলমান যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন অথবা জলাবদ্ধতা সমস্যা দিনে দিনে জগদ্দল পাথর সম চেপে বসছে।

দেশের পরিসংখ্যানে খুলনা বিভাগের দারিদ্র্য বিবেচনায় বিশেষ কোনো অর্থনৈতিক প্রকল্প যশোরবাসীর অর্থনৈতিক মুক্তিতে গ্রহণ করা হয়েছে এমনটা কিন্তু সরকার বা এলাকার উন্নয়নের কারিগররা দাবি করতে পারবেন না। বরং ব্যক্তি উদ্যোগ আজ যতটা এগিয়েছে তাকে সহায়তা করার চাইতে পিছন থেকে টেনে গতি কমিয়ে দেওয়ার কার্যক্রম সর্বদা চলমান। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সর্বস্তরের পেশাজীবীরা রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্তি থেকে বের হয়ে এসে একযোগে কাজ করলেই যশোরের সকল সম্ভাবনার দ্বার প্রসারিত হবে এ কামনাই করি।

লেখক: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //