১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জল হোসেনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে আদালতে এর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। এই ৬ জনের মধ্যে একজন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা; তিনি ফজলুল হক হল ছাত্রলীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপ-সম্পাদক ছিলেন। কোটা সংস্কার বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরুতে তিনি ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করে আন্দোলনের সব কর্মসূচিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন; অন্যদের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি।
দফায় দফায় মারা হলেও হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স তোফাজ্জল বারবার বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তিনি চোর নন, তিনি শুধু একটু খাবার চান। তা শুনে হলের ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে তোফাজ্জলকে ভাত-তরকারি খাওয়ানো হয়। ক্যান্টিনে খেতে বসা তোফাজ্জলের শরীরে অনেকগুলো জখম ছিল। আমরা সবাই তার খাওয়ার ভিডিও দেখেছি, তাকে যে আগে মারা হয়েছে তার কোনো প্রতিক্রিয়া তার চেহারায় ছিল না, তৃপ্তিসহকারে তিনি ভাত খেয়ে গেছেন। পাকিস্তানি সেনার কাছে আটক মুক্তিযোদ্ধা আজাদও ভাত খেতে চেয়েছিলেন, মা ভাত নিয়ে গিয়েছিলেনও, পাকিস্তানি সেনারা ভাত খাওয়ার আগেই তাকে মেরে ফেলেছিল, মা আমৃত্যু আর ভাত খাননি। তোফাজ্জলকে যে আবার মারা হবে সে বিষয়টি তাকে একটুও বিচলিত করেনি, তিনি ছিলেন শান্ত ও উদ্বেগহীন; ক্ষুধা নিবারণেই নিবিষ্ট। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগে যিশুও ধীরস্থির ছিলেন; লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অমর সৃষ্টি ‘দ্য লাস্ট সাপার’-এ যিশু খ্রিস্টকে তার ১২ শিষ্য নিয়ে নিশ্চিন্তে রাতের ভোজ করতে দেখা গেছে। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঠিক আগেই তিনি এই খাবার খেয়েছিলেন।
ভিডিওতে অনেক ছাত্রকে ঘটনায় উপস্থিত দেখা গেছে, তাই শুধু ৬ জন নয়, আরও ছাত্র দায়ী। ঘটনায় উপস্থিত যারা তোফাজ্জলকে মারেনি তারাও তার মৃত্যুর জন্য সমভাবে দায়ী। কারণ ঘটনায় উপস্থিত কোনো ছাত্রকে নির্যাতনে বাধা দিতে দেখা গেল না। সবাই তোফাজ্জলের করুণ মৃত্যুর দৃশ্য উপভোগ করেছে। ফজলুল হক হলের সংশ্লিষ্ট সব ছাত্রকে ডেকে নিয়ে বারবার জেরা করা দরকার, যেভাবে ফরাসি পুলিশ জুলফিকার আলি ভুট্টোর ছোট ছেলে শাহনওয়াজ ভুট্টোর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী রেহানাকে জেরা করেছিল। স্ত্রীর গোচরে স্বামী অতিরিক্ত ড্রিংক করে মারা গেল- এটাই ছিল স্ত্রী রেহানার অপরাধ। বিচার হওয়া উচিত তাদের, যারা তোফাজ্জলের মৃত্যুর দৃশ্য উপভোগ করে নিশ্চুপ ছিল। বিচার হওয়া উচিত আশপাশের সব ছাত্রের, যারা তোফাজ্জলের চিৎকার শুনেও তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি। বিচার হওয়া উচিত সেসব ছাত্রের, যারা উঁকি দিয়ে নির্যাতনের দৃশ্য দেখে আবার নিশ্চিন্তে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসেছিল। কোনো কৈফিয়ত ছাড়াই বিচার হওয়া উচিত ফজলুল হক হলের হাউস টিউটর ও প্রভোস্টের; বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। ছয়-সাত ঘণ্টাব্যাপী তোফাজ্জলকে পেটানো হলো, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানতে পারল না; কেন জানতে পারলো না সেজন্যই বিচার হওয়া দরকার। ঘটনার ভিডিও থাকা সত্ত্বেও অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের নামে হত্যার অভিযোগ করার জন্যও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিচার হওয়া উচিত।
দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনিতে হত্যার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। দুঃখজনক, ‘নতুন স্বাধীন’ বাংলাদেশে একজন লোকও রুখে দাঁড়ানোর নেই?
কিছু লোক দলীয় সরকারের আমলের মতো সব অঘটনের পেছনে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। দেশে বিরাজমান অরাজকতায় অনেকের মনে ধারণা হয়েছে যে, স্বৈরচারী সরকারের সহযোগী আখ্যা দিয়ে কাউকে নির্যাতন করা হলে জবাবদিহিতা থাকবে না, মামলার মুখোমুখি হতে হবে না। ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগ আমলে ছাত্রলীগের ছেলেরা বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্যাতন করে মেরে ফেলেছিল; এজন্য ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ড হলেও ছাত্রদের বেপরোয়া আচরণের অভিভাবক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিচার হয়নি।
আমি ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, আমার হল ছিল ফজলুল হক হল। লজ্জা হয়, এই হলেই তোফাজ্জলকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে অহঙ্কার করে থাকে, এখানে নাকি সবাই মেধাবী। মেধাবী হলে তো বোঝার কথা ছিল, পিটানোর পর একটি যুবক কী করে সব ভুলে নির্ভয়ে ভাত খেতে পারে। সুস্থ চোর হলে বাঁচার তাগিদটা ভাতের চেয়ে বেশি হতো। এত মার খাওয়ার পরও নির্ভাবনায় ভাত খাওয়ার দৃশ্য দেখে যারা তার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারেনি, তাদের দেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মেধাবী’ বললে মেধার অপমান করা হয়। ইতোমধ্যে সামাজিক মাধ্যমে ‘মেধাবী’ শব্দটির বিকৃত অর্থ ছড়িয়ে পড়েছে।
মা-বাবা জীবিত থাকাকালে তাদের শুশ্রূষায় মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জল মাঝেমধ্যে সুস্থ হয়ে যেতেন; কিন্তু মা-বাবার মৃত্যুর পর আর কখনো সুস্থ হননি। বাসায় থাকলে পায়ে থাকত শিকল, তাই তিনি বাসা থেকে পালিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন, কখনো কখনো খাবার জুটত, আবার না খেয়েই থাকতেন অনেকদিন। ফজলুল হক হলে সম্ভবত খাবারের সন্ধানেই গিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি পেটপুরে খেতে পেরেছেন, হয়ত তার মনে বিশ্বাস জন্মেছিল- তাকে আর মারা হবে না।
খাবার যে কত উপাদেয়, তা চরম ক্ষুধার্ত না হলে বোঝা যায় না। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক যুবককে দেখা গেল, রাস্তায় রাস্তায় পতিতাদের পেটাতে; এক পতিতা আধা কিলোমিটার দৌড়েও ওই যুবকের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি। খাবারের নিশ্চয়তা থাকলে কেউ পতিতা হতে চায় না। কক্সবাজারে গিয়েও ওই যুবক পুলিশের সম্মুখে মেয়েদের নাজেহাল করেছে। পুলিশ ভয়ে যুবকের লাঠিপেটাকে সমর্থন করেছে।
‘মব জাস্টিস’ নাম দিয়ে দেশের সর্বত্র যেসব ভায়োলেন্স হচ্ছে তা এক্ষুণি বন্ধ না হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে, অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে, যদিও সমন্বয়করা মব জাস্টিজের বিরুদ্ধে বলে যাচ্ছেন। দলীয় সরকারের প্রতি মানুষের কোনো দরদ নেই, জনগণ চায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের দীর্ঘায়ু; কিন্তু তাদের আস্থা ও বিশ্বাসে চিড় ধরলে জাতি আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।
আদিকালে মানুষ পশু হত্যা করত খাবারের জন্য, এখন মানুষ হত্যা করা হয় শখের বশে; হত্যাকারী এবং ভিকটিম কেউই জানে না, হত্যা কেন জরুরি। না জানা হত্যার জন্যই আমাদের গর্বের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের ললাটে লেখা হয়ে গেল-‘এখানে জীবনের বিনিময়ে ভাত পাওয়া যায়’।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh