১৯৮৯ সালে এসএসসি পাস করার পর থেকেই আমি সচেতনভাবে দেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলী দেখছি। যদি সংক্ষেপে বলি তাহলে ১৯৯০ এ এরশাদের পতন- ১৯৯১ সালে বিএনপির ক্ষমতায় আসা- ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ- ২০০১ সালে পুনরায় বিএনপি। মাঝের দুই বছর ১/১১- তারপর ২০০৮ সালে থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ।
এই রাজনৈতিক টাইমলাইন থেকে বুঝা যায় সঠিক এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক দলই পর পর দুইবার ক্ষমতায় আসতে পারেনি। কেন পারেনি? আমরা কি ভালোভাবে ভেবে দেখেছি? রাজনৈতিক দলগুলো কি এর বিশ্লেষণ এবং ইতিহাস থেকে সঠিক শিক্ষা নিয়েছে? কেন নিতে পারেনি? কি ছিল প্রতিবন্ধকতা? দেশের জনগণ? রাজনৈতিক কর্মী? প্রশাসনিক আমলা? নাকি অন্যকিছু? আসুন আমরা একেবারে গভীরে যাই। তবে আপাতত বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ ভীষণ সজাগ এবং অনেক স্মার্ট। এরা কাউকেই পর পর দুবার ক্ষমতায় আনছে না। নিশ্চয়ই কোন কারণ রয়েছে- কি সেগুলো? যদি সঠিকভাবে জানা যায় এবং সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে পর পর ২ বার নয়, বাঙালি অনেক বারই সঠিক দলকে ক্ষমতায় রাখতে চাইবে।
আমাদের অতীত অভিজ্ঞতায় বলে- যে দলই ক্ষমতায় গেছে তাদের মধ্যে ২টি বিষয়ে বেশ মিল পাওয়া যায়। একটি হলো ক্ষমতার মাধ্যমে অস্বাভাবিক অর্থ উপার্জন বা দুর্নীতি আর অন্যটি হলো ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয় কারণ ঘটতো না যদি প্রথম কারণটি বা দুর্নীতি না করতো। তার অর্থ হলো দুর্নীতির মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো ধীরে ধীরে জনগণের মন থেকে দূরে সরে যায়- ভোট হারায়। পুনরায় ক্ষমতায় আসতে পারবে না জেনেই ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা করে। আর এখানেই ভুল করে। জনগণ বুঝে ফেলে- জনগণের প্রতি দেওয়া গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার নমুনা দেখা মাত্রই জনগণ সে দলের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নতুন কাউকে নির্বাচিত করে।
আমরা দেখার চেষ্টা করি কিভাবে একটি রাজনৈতিক দল দুর্নীতিপরায়ণ হয় এবং কার দ্বারা বা কতজনের দ্বারা তাদের এই ক্ষতিটা হয়। একটি দল যখন ভোটে জিতে সরকার গঠন করে ধরে নিলাম তার সাপোর্ট ১০০% আর যখন পরাজিত হয় তখন তার সাপোর্ট ০%। এই অনুমানটি আমাদের বুঝতে সুবিধার জন্য। বাংলাদেশের বর্তমান ভোটার সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। একটি রাজনৈতিক দলের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী। এর সবাই দুর্নীতিপরায়ণ? হতেই পারে না। তাহলে সংখ্যাটা কেমন হতে পারে? যদি কোন রাজনৈতিক দল দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেয় তাহলে আমলারা বা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার সাহস পাবে না। দুর্নীতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকবে। কিন্তু যদি দলের প্রধান, তার আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধব দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তাহলে এটি মহামারী আকার ধারণ করে। তখন দলের উচ্চ, মাঝারি, নিম্নসারির নেতারা, তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই ধীরে ধীরে এ রোগে আক্রান্ত হয়। সাথে সাথে আমলা, তাদের পরিবার আত্মীয় স্বজন, বন্ধু- বান্ধব সবাই যোগ হয়। তারপর সমাজের নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, ব্যবসায়ীরাও এতে যোগ দেয়। ধীরে ধীরে মহামারি পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু সর্বোচ্চ নেতা সৎ হলে সব বন্ধ। অর্থাৎ একজনের উপরই নির্ভর করছে দেশটি দুর্নীতিগ্রস্ত হবে কি- হবে না। পুনরায় ভোটে জিতবে- নাকি জিতবে না। খুব সামান্য সমাধান নেতা ঠিক তো ভোট ঠিক- নেতা বেঠিক ভোট ০% । অর্থাৎ বলা যায়, মাত্র একজনের উপরই নির্ভর করে দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। তবে নেতাকে সৎ থাকার পাশাপাশি দুর্নীতি রোধের সঠিক বন্দোবস্ত করতে জানতে হবে। সেটি কিভাবে করা যাবে? সেটা অন্য আলোচনা। তবে সমাধান তো রয়েছেই।
দুর্নীতি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? এক দুর্নীতিই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হয় কিভাবে? চলুন কিছু বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি। ধরুন বিদ্যুতের একটি প্রকল্পের খরচ ১০০ টাকা। কিন্তু নেতার ইচ্ছা এখানে থেকে আরো ১০০ টাকা নিজের পকেটে ভরা। তাহলে প্রকল্পের খরচ দাঁড়ালো ২০০ টাকা। কিন্তু প্রশাসনিক কর্মকর্তা এক্ষেত্রে একটু সুযোগ নেওয়াই সমীচীন মনে করবেন। তার ছেলে মেয়েকে বিদেশে পড়ানোর খরচটা যোগাতেই চাইবেন। তাহলে উপায়? প্রকল্প পরিচালক পারলে প্রকল্প ব্যয় মোট ২৫০ টাকা করবেন অথবা প্রথম ১০০ টাকার জিনিসপত্র ৬০-৭০ টাকার মধ্যে কিনে নিজে ৩০-৪০ টাকা পকেটে ভরবেন। এবার সমস্যাটা দাঁড়ালো- খারাপ উপকরণ ও যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি প্রকল্পটি মাঝে মাঝেই খারাপ হবে কিংবা নিম্নমানের সার্ভিস প্রদান করবে। এখানে জনগণের ক্ষতি কিভাবে হলো? বুঝিয়ে বলছি- ধরুন প্রাথমিক ১০০ টাকা প্রকল্পটি ১০০ জনের কর্মসংস্থান করে। আর জনগণকে আগামী ২০ বছর ১ টাকা হারে বিদ্যুৎ বিল দিতে হবে। কিন্তু ২০০ টাকার প্রকল্প হাওয়ার কারণে জনগণকে ২ টাকা হারে বিদ্যুৎ কিনতে হবে এবং বাড়তি ১০০ জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাই হলো না। ফলে ১০০ জন ভবিষ্যতে বেকার থাকবে। সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে ২০০ টাকার প্রকল্পে মোট ২০০ জনের চাকুরি হতো। দুর্নীতি হাওয়ার ফলে ১৩০-১৪০ টাকাই গেল তিনজনের কাছে। ক্ষতি হলো অসংখ্য জনগণ এবং সৃষ্টি হল ১০০ বেকার।
অর্থাৎ দুর্নীতির দ্বারা বেকারত্ব তৈরি হলো আর জনগণকেও বাড়তি ১ টাকা বিদ্যুৎ খরচ গুনতে হবে। এবার চিন্তা করুন শত শত প্রকল্প, হাজার হাজার বেকার এবং জনগণের বাড়তি সংসার খরচ। যদি দুর্নীতি না হতো তাহলে একজন সৎ কর্মজীবী সংসার খরচ বাদে মাসে ২০০০ টাকা সঞ্চয় করতে পারতো। কিন্তু দুর্নীতির কারণে তার সঞ্চয় শূন্য। তার মধ্যে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, সন্তানদের ভালোভাবে লেখাপড়া করাতে না পারা, আত্মীয় স্বজনদের পাশে দাঁড়াতে না পারা, দুশ্চিন্তার কারণে রোগ বালাই বেড়ে যায়। সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পারা এবং সর্বোপরি আয়ুষ্কাল কমে যাওয়াই এর ফলাফল হিসাবে দেখা দেবে। মোট কথা তিনজনের কারণে হাজার জীবন-জীবিকা, সন্তানের লেখাপড়া সবই ক্ষতিগ্রস্ত। তাহলে ভোটের সময় এই হাজার হাজার লোকগুলো কাকে ভোট দেবে? উক্ত দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট সরকার— নাকি অন্য কাউকে? আপনিই বলুন। সঠিকভাবে হিসাব করে দেখুন গত ১৫ বছরে আমাদের গড় আয়ু একটু হলেও কমেছে আর দুর্নীতিপরায়ণ শাসকদের একটু হলেও বেড়েছে। সাধারণ জনগণ নিজের জীবন দিয়ে কি দুর্নীতিপরায়ণ শাসককে আবারও ভোটে নির্বাচিত করবে? আপনারা দুর্নীতিবাজ তিনজন আপনাদেরকেই ভোট দেন। আমরা হাজার হাজার জনগণ অন্য কাউকে বেছে নেব।
এবার ধরুন নেতা সৎ, কিন্তু তিনি দুর্নীতিদমন করতে পারছেন না। তাহলে কি হবে? দলীয় নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি করবে, অন্যের সম্পদ দখল করবে, বিচার ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার করবে। এতে সুযোগ নেবে পুলিশ, আইন ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। ফলে বাড়বে ঘুষ ও নিয়োগ বাণিজ্য। অর্থাৎ দলের মাত্র কয়েক হাজার দুর্নীতিপরায়ণ কর্মীর জন্য সৃষ্ট হবে দলীয় কোন্দল, মারামারি, হত্যাযজ্ঞ, গণমাধ্যমে এগুলোর খবরাখবর প্রকাশ এবং দলীয় শাসনের অক্ষমতার চিত্র। মানুষ ধীরে ধীরে বীতশ্রদ্ধ হবে। একপর্যায়ে নিজের সমর্থন তুলে নেবে। তার মানে কয়েক হাজার কর্মীর জন্য প্রশাসনের সকল পর্যায়ের ঘুষ ও দুর্নীতি মহামারি হিসাবে দেখা দেবে। মাত্র কয়েক হাজার দলীয় কর্মীর জন্য কোটি কোটি মানুষের সমর্থন হারাবে দলটি। নির্বাচনে পরাজয় অনিবার্য। ফলশ্রুতিতে নির্বাচনে কারচুপি করতে বাধ্য হবে সরকার।
ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে সম্পদের বণ্টন হবে দেশের সকল জনগণের মধ্যে। জীবন-যাত্রার ব্যয় কমবে-সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়বে- বিনিয়োগ বাড়বে- ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভালোভাবে শিক্ষিত হবে। পারিবারিক শান্তি বিরাজ করবে, সমাজের শান্তি ও সাংস্কৃতিক চর্চা প্রতিফলিত হবে, অর্থ পাচার রোধ হবে- দেশের সমৃদ্ধি বাড়বে। এসবের ফলস্বরূপ মানুষ ধীরে ধীরে নিজের প্রতি সচেতন হবে, পরিবারের ও সমাজের মঙ্গল কামনায় নিমজ্জিত হবে- রাজনীতি ধীরে ধীরে গৌণ হয়ে উঠবে— উন্নত বিশ্বের মতো। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন জনগণ তাকে পরিবর্তনে অনাগ্রহী হবে। ফলত: ঐ রাজনৈতিক দলটি পুনরায় নির্বাচিত হবে। অর্থাৎ কয়েক হাজার দলীয় কর্মীকে নিয়ন্ত্রণ করে কোটি কোটি মানুষের ভোট নিশ্চিত করা যাবে। তাহলে দলগুলোর কোনটি করা উচিত? ভেবে দেখা উচিত নয় কি?
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh