গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা ছেড়ে পালানোর মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে রাষ্ট্র ও সমাজের ৪ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়েছে। কারণ মানুষ শুধু ব্যক্তির বদল চায় না, বদল চায় ব্যবস্থারও।
দেশের উৎপাদন বাড়ছে, মানুষের মাথাপিছু আয় খাতা-কলমে বাড়ছে, জিডিপিও বাড়ছে; কিন্তু এটা তো সত্যি যে, মানুষের মধ্যে আয়-বৈষম্যও ভীষণভাবে বেড়ে যাচ্ছে। একদল মানুষের এত সম্পদ যে, তারা তা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে তৈরি হয়েছে এক অনিরসনযোগ্য সংকট। ফলে মানুষের ক্ষোভের একটা কারণ হলো- লাগামহীন সম্পদ পাচার। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-সংগ্রামে তাই এই স্লোগান উঠেছিল- ‘দেশের সম্পদ পাচারকারীদের বিচার চাই’।
মানুষ প্রতিদিনের পত্রিকায় হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক জালিয়াতির কাহিনি পড়তে চায়নি। জনগণের সম্পদের এ রকম লুণ্ঠন প্রতিরোধ করার কথা মন্ত্রী-এমপি-আমলা-পুলিশ-বিচারকের; কিন্তু তারা তো সেটা করেইনি, বরং তাদের লুণ্ঠনের যে খবর প্রকাশ হয়েছে তা দেখে মানুষ আঁতকে উঠেছে। রাগে ফুঁসে উঠেছে। তাদের বেতন, শান-শওকত- সব দরিদ্র জনগণের টাকায়, তারা ছড়ি ঘোরায় মানুষের ওপর, আবার তারাই লুটপাটকারী। এদেরকে জবাবদিহির আওতায় আনার কথা যেমন ভেবেছে, তেমনি আইনি উপায় দেখতে চেয়েছে মানুষ।
প্রজাতন্ত্রের নামে মানুষকে প্রজা বানিয়ে রাখার ব্যবস্থা এতো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, মানুষ ভুলেই গিয়েছিল; সে স্বাধীন। স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও স্বাধীন ব্যক্তির মর্যাদা পায় না মানুষ। বলা হতো বিচার বিভাগ স্বাধীন, পুলিশ স্বাধীন, প্রশাসন স্বাধীন আর মানুষ ভাবে শুধু সে-ই পরাধীন। ফলাও করে বলা হয়, ‘সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’; কিন্তু কার্যত ক্ষমতার যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষ মালিক হিসেবে দেখেছে ক্ষমতাসীনদেরকে। এমন এক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, যেখানে মন্ত্রী-এমপি-আমলা-পুলিশ সবাইকে একজন বিশেষ ব্যক্তির কাছেই কেবল জবাবদিহি করতে হতো। আর সেই মহান ব্যক্তি ছিলেন সমস্ত জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। এর অবসান চেয়েছিল ছাত্র-জনতা।
‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান’ বলতে বলতে আইনের মারপ্যাঁচে সমস্ত বেআইনি কার্যকলাপ চলেছে। চূড়ান্ত অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনও আইনসংগত ও বৈধ বলে বিবেচিত হয়েছে। এ রকম বৈধ নির্বাচন যে, তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে জনতার কোনো সংযোগই তৈরি করছে না, বরং পুরনো সংযোগও ছিঁড়ে ফেলছে, তার নজির দেখেছে সবাই। হয়তো এই সমস্ত নির্বাচন গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তিকে ধ্বংস করেছে আর মানুষের, বিশেষত যুবসমাজের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে। ক্ষমতায় থাকলে কোনো কিছুই অন্যায় নয়- এই মানসিকতার বিস্তার ঘটিয়েছে। তথাকথিত জনপ্রতিনিধিরা ভাবতে শুরু করেছিলেন এরকমভাবে নির্বাচনী আইন ও নির্বাচন কমিশনের ছত্রচ্ছায়ায় অবৈধ ক্ষমতা বছরের পর বছর ভোগ করতে থাকবেন। কেউ তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না।
এরা জনগণের ভোটের উৎসাহকে ধ্বংস করেছে, জনগণও ভোট বিমুখ হয়ে পড়ছিলেন দিন দিন। নির্বাচন কমিশন শুধু আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে চায়নি বরং উৎসাহের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের মনের আশা পূরণে ভূমিকা পালন করেছে। যার ফলে নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন করা যাবে- এমন ভাবনা মানুষ ছেড়ে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছাড়বে না কোনোভাবেই- এই ধারণা স্থায়ী হয়ে পড়েছিল। গণঅভ্যুত্থানের তাই বিকল্প ছিল না আর গণরোষে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না।
তা হলে শাসকেরা অত্যাচারী হলে, জনগণের সমর্থন হারালে ক্ষমতার পট পরিবর্তন কি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই বার বার হতে হবে। জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা এবং সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনের কোনো পথ কি তৈরি হবে না? ‘ভোটের ক্ষমতা’ প্রয়োগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা কি জনগণের হাতে আসবে না? এবারের অভ্যুত্থানের অন্তর্নিহিত প্রশ্ন এটা। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় রাষ্ট্রের সব স্তরের নির্বাহীরা পরিচালিত হন, তাই তাদের অবশ্যই এক ব্যক্তির বদলে জনগণের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি কিংবা সংসদীয় পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন, প্রধান বিষয় হলো- জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা। এই লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন ও আইনের প্রয়োগটাই গুরুত্বপূর্ণ।
সমস্যা প্রধানত শাসনতান্ত্রিক আইনে, সুতরাং আইনের সংস্কার জরুরি। ক্ষমতায় থেকে কেউই সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায় না বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্ন এসেছিল। এ ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের গণতান্ত্রিক ও যৌক্তিক কোনো ব্যবস্থা নেই, যে কারণেই ক্ষমতাসীনদের অধীনে পাঁচ বছর পর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে জাতীয় টেনশন ও গণতন্ত্রের নির্বাসন দেখেছে দেশের জনগণ।
ছাত্র-শ্রমিক-জনতা ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে নামাতে চাইলেও বিশেষ কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য রাজপথে নামেনি। সরকারের প্রতি ক্ষোভ থেকে জনগণ রাজপথে নেমে এসেছে তাদের সঙ্গে। তারা কাউকে ক্ষমতায় বসাতে চায়নি বরং শাসনব্যবস্থার সংস্কার চেয়েছে। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ছাত্ররা রাজপথে লিখেছিল- রাষ্ট্র সংস্কার চলছে, সে সময় হেলমেট বাহিনী দিয়ে তা দমন করা হয়েছিল; কিন্তু তাদের সেই কথা মানুষের বুকে ঠাঁই করে নিয়েছিল। এবারের আন্দোলনেও তারা বারবার সংস্কারের কথা বলেছে। ছাত্রদের এই দাবির সঙ্গে দেশের সচেতন মহল দাবি তুলেছে যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে যে ধরনের সংস্কার করতে হবে তাতে সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর ওপর নির্বাহী বিভাগের বিশেষ একজনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর্তৃত্বের অবসান করা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের পরিবর্তন, সংসদ সদস্যদের আইন প্রণয়নে এবং স্থানীয় সরকারের উন্নয়নকাজে পৃথক ভূমিকা নিশ্চিত করা, জাতীয় বাজেট প্রণয়নে জন-অংশগ্রহণ বাড়াতে সংবিধানের ৮০-৯২ অনুচ্ছেদের সংস্কার এবং বিশেষভাবে ভোটব্যবস্থার এমন এক সংস্কার, যাতে ভোট অনুযায়ী আসনের হিস্যা নির্ধারিত হয় অর্থাৎ সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা যায়। সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্তকে নির্বাচিত ঘোষণা করে অন্য প্রার্থীর সমর্থক ভোটারদের রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে মানুষের ভোটকে মূল্যহীন বানিয়ে ফেলার অবসান হওয়া দরকার। নির্বাচন ব্যবস্থা সংশোধন হলে প্রতিটি মানুষ ভাবতে পারবে যে, জাতীয় নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে তার মতেরও মূল্য আছে।
এই ভূখণ্ডের জনগণের যে কোনো গণ-আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা দমনকারী বাহিনী হিসেবেই দেখে এসেছে জনগণ। ১৮৫৮ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর যে উদ্দেশ্যে পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়েছিল- ব্রিটিশ, পাকিস্তান বিদায় হলেও সেই উদ্দেশ্য এখনও বহাল আছে। অর্থাৎ শাসকদের পাহারাদার হিসেবে কাজ করা, বিরোধী দল এবং মতকে দমন করা, জনগণের সামনে ভয়ের প্রতিমূর্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া যেন পুলিশের কাজ। ফলে স্বাধীন দেশেও পুলিশের মানসিকতা এবং জনগণের পুলিশের প্রতি মনোভাব পালটায়নি। এখনও পুলিশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নয়, বরং ক্ষমতাসীন দলের বাহিনী। আর দমন-পীড়নের বাহিনী- এই ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতির অবাধ সুযোগের বিষয়টি। পুলিশের চাকরি প্রত্যাশীদের বেশিরভাগেরই আকাঙ্ক্ষা জনগণের সেবক হওয়া নয় বরং বেতনবহির্ভূত রোজগার এবং বিধিবহির্ভূত ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া। এর জ্বলন্ত প্রমাণ বিগত ১৫ বছরে পুলিশের বড় কর্তাদের সম্পদ ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ। বিগত আন্দোলনে পুলিশ বাহিনী যে ভূমিকা রেখেছে, তাতে ঔপনিবেশিক শাসনামলের পুলিশ অ্যাক্ট, পরবর্তীকালের মেট্রোপলিটন পুলিশ আইনসহ সংশ্লিষ্ট আইনগুলোরও জনতার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সংস্কার প্রয়োজন। ফলে নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কার, প্রশাসনে সংস্কার, পুলিশে সংস্কার- সব কিছু কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করার ওপর।
কিন্তু কথা হলো- এসব সংস্কার করবে কে? সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা জনগণের আছে কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা পালন করতে হবে। জনপ্রতিনিধি যারা হয়ে থাকেন তারা যদি জনআকাঙ্ক্ষা ধারণ না করেন বা জন আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে চলতে থাকেন; তা হলে মানুষ প্রতারিত বোধ করবেন আবার। যদি ধনীদের দ্বারা ধনীদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়, তা হলে ধনীদের স্বার্থ রক্ষা করবে- এটাই তো স্বাভাবিক। যদি ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হয়, তা হলে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখবে। সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি না থাকলে সাধারণ মানুষের কথা কে বলবে?
সমাজের নানা বিষয়ে সংস্কার, পরিবর্তন, বা আমূল পরিবর্তন অর্থাৎ বিপ্লবের স্বপ্ন তুলে ধরে রাজনৈতিক দলগুলো। তারা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে, প্রস্তাব দেয়, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে, আন্দোলনে নামে। ফলে জনগণের মনন জগতেও পরিবর্তন ঘটে। মানুষ তাই চায় আরও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। অতীতের অন্ধকার নয়, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে চায় মানুষ।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh