যে অভিঘাতের ব্যাপকত্ব আমরা এখনো বুঝতে পারছি না তার নাম পাওয়ার সেক্টর। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বিদ্যুৎ সরবরাহ। দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনসক্ষমতা প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট। উৎপাদন করা হচ্ছে ১৩ হাজার থেকে সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। চাহিদা সাড়ে ১৩ হাজার থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াট। গ্যাস সংকটের মধ্যেই আর্থিক, আইনি ও কারিগরি সমস্যার কারণে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। পুরোপুরি বন্ধও হয়ে গেছে দুটি। ফলে সারা দেশে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের পরিমাণও বেড়েছে।
বর্তমানে দেশের সাতটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে তিন হাজার ১৯৯ মেগাওয়াটের মতো, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুতের উৎস ভারতের গোড্ডায় অবস্থিত আদানি পাওয়ার ঝাড়খন্ড লিমিটেড পিডিবির কাছে প্রায় ৮৪৬ মিলিয়ন ডলার বকেয়া আদায়ের অংশ হিসেবে গত সপ্তাহে সরবরাহ অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। অর্থাৎ ৭০০ মেগাওয়াট কমিয়ে দিয়েছে।
ভারতীয় কোম্পানি আদানি বাংলাদেশে বিদ্যুতের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার পর বকেয়া পরিশোধের জন্য চলতি মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত সময় দিয়েছে। এ সময়সীমার মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তি না হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশের কাছে আদানির পাওনা দাঁড়িয়েছে ৮৫ কোটি ডলার বা সাত হাজার ২০০ কোটি রুপি। এই পাওনা কবে পরিশোধ করা হবে, সে ব্যাপারে একটি পরিষ্কার ধারণা চায় আদানি গোষ্ঠী। এর আগে বকেয়া পরিশোধের জন্য বিপিডিবিকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দিয়েছিল আদানি পাওয়ার। পাশাপাশি পাওনা পরিশোধের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ১৭ কোটি ডলার বা এক হাজার ৫০০ কোটি রুপির ঋণপত্র দেওয়ার জন্য কোম্পানিটি বলেছিল।
টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, পিডিবি কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে বকেয়া অর্থের বিপরীতে একটি ঋণপত্র দিতে চেয়েছিল। তবে এ পদক্ষেপ বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। অন্যতম কারণ হিসেবে ডলারের সংকটের কথা বলা হয়েছে।
এর পরপরই আদানি পাওয়ার তাদের ঝাড়খন্ড বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৩১ অক্টোবর ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেয়, ফলে দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়।
বরাবরের মতো বাংলাদেশ সরকারের ইনটেলেক্টরা ঘরে বসেই ভেবে বসেছিলেন বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করলে আদানির গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবসায় ধস নামবে। কারণ বাংলাদেশ এই কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের একমাত্র ক্রেতা। প্রতি মাসে এই কেন্দ্র থেকে আদানির ১১০ কোটি ডলার বা ৯ হাজার কোটি রুপির বেশি অর্থ আয় হয়।
অথচ বাংলাদেশ সরকারের এসব শ্বেতহস্তি খবরও রাখেন না যে আদানি একজন ঝানু ব্যবসায়ী। নিজের ক্ষতি করে সে বকেয়া ডিল করতে যায়নি। গড্ডার পুরো উৎপাদন বাংলাদেশে না পাঠালে তা অপচয় হবে। তাই টাকা আদায় নিয়ে বাংলাদেশকে চূড়ান্ত চিঠি দেওয়ার আগে ভারত সরকারের কাছে আবেদন করেছে দেশের অভ্যন্তরে সরবরাহের জন্য। ভারত সরকার সে আবেদনে সাড়া দিয়ে বিহারের লাখিসরাইয়ে অবস্থিত একটি সাবস্টেশন থেকে সংযোগ দিয়ে দেশের ভেতরেই আদানির বিদ্যুৎ কনজিউম করা হবে বলে আশ্বস্ত করেছে।
এই নিশ্চয়তা পাওয়ার পরপরই আদানি বকেয়া পাওনা পরিশোধের জন্য কড়া চিঠি দিয়েছে। এই চিঠি পাওয়ার পরে এবং আদানির ৭০০ মেগাওয়াট সাপ্লাই কমে যাওয়ার পর আদানি গ্রুপের পাওনা দ্রুত পরিশোধ করা হবে বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। প্রেসসচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘আদানি গ্রুপকে গত মাসে ৯৭ মিলিয়ন ডলার পেমেন্ট করা হয়েছে। যেটা আগস্ট বা আগের মাসের চেয়ে দ্বিগুণ। আমাদের তরফ থেকে সর্বোচ্চ পেমেন্ট আরো দ্রুত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৭০০ মিলিয়ন ডলার পেমেন্ট বাকি আছে। সেটিও দ্রুত সময়ের মধ্যে করে দিতে পারব।
এই যে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে আদানির সঙ্গে মতবিরোধ, সেটা কেবলই টাকা বাকি পড়েছে- সে কারণে নয়। এর পেছনেও রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনীতি বিষয়ে অভিজ্ঞতা না থাকা এবং অতি আবেগে গত সরকারের সকল কাজকে ‘ফ্যাসিবাদীদের দেশবিরোধী কাজ’ মনে করে বসা এবং প্রতিবেশীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা। প্রধান উপদেষ্টা যেদিন ভারতকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে অশান্ত করতে চাইলে ভারতের সেভেন সিস্টারও অশান্ত হবে’, তার পরপরই “আদানির সঙ্গে ‘গোপন’ বিদ্যুৎ চুক্তি জাতীয় স্বার্থবিরোধী এবং তা পুনর্মূল্যায়ন করা হবে’ বলে শাসিয়েছিলেন। তখন তিনি বা তার উপদেষ্টারা জানতেন না আদানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে হলে ১২ বিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতে হবে বাংলাদেশকে। এরপর বাতিলের হুমকি থেকে সরে আসার ব্যাখ্যায় বলেছে, ‘বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানায়, প্রকল্পটি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় এক-দশমাংশ পূরণ করে। তাই আদানির চুক্তিটি সরাসরি বাতিল করা কঠিন হবে। দ্বিতীয় সূত্রটি জানিয়েছে, শক্তিশালী প্রমাণ ছাড়া আন্তর্জাতিক আদালতে এ-সংক্রান্ত আইনি চ্যালেঞ্জে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা আছে’।”
দেশের চাহিদার ১৩ হাজার থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের জায়গায় আদানির ৭০০ মেগাওয়াট সাপ্লাই কম হওয়ায় ১ নভেম্বর থেকেই মফস্বল শহরগুলোতে ব্যাপক লোডশেডিং শুরু হয়েছে। এখন ৭ নভেম্বরের মধ্যে সম্পূর্ণ বকেয়া শোধ না করলে ১৪০০ বা ১৫০০ মেগাওয়াট পুরোটাই বন্ধ হয়ে যাবে। এর মধ্যে শীতের দুই মাস পার হলেই স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুৎ ব্যবহার বেড়ে যাবে এবং লোডশেডিংও অসহনীয় হয়ে উঠবে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh