১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর। অন্য সব দিনগুলোর মতো এই দিনটা নয়। এরশাদের স্বৈরশাসন যারা প্রত্যক্ষ করেছে তারা জানেন এই দিনটি কত স্মৃতিবহ। কতোটা বেদনার। এই দিন বেলা আনুমানিক ১০টা ৩০ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে গণগ্রন্থাগারের কোনায় ডা. মিলন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
শহীদ ডা. মিলনের ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি অ্যান্ড বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে ছিলেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ডা. মিলনের মতো অনেক মেধাবীর প্রাণ দিতে হয় স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে। ১৯৯০ সালে এরশাদ স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে চলছিল গণআন্দোলন। গণতন্ত্র উদ্ধারের সেই অভিযাত্রায় তাই ঢাকা শহর পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। অন্যান্য সংগঠনের মতো চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনও (বিএমএ) তখন অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। চিকিৎসকদের ২৩ দফার আন্দোলন যখন চলছিল ঠিক তখনই সামরিক স্বৈরাচারের দোসরদের সহায়তায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি। এই স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে বিএমএ-এর নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারা দেশে চলছিল চিকিৎসকদের কর্মবিরতি। চিকিৎসকদের কর্মবিরতির সেই আন্দোলনে ২৭ নভেম্বর তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চলছিল বিএমএ আহূত চিকিৎসক সমাবেশ। এতে যোগদানের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে রিকশাযোগে শাহবাগের পিজি হাসপাতালের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন বিএমএর যুগ্ম সম্পাদক ডা. মিলন ও মহাসচিব ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি-সংলগ্ন টিএসসি মোড় অতিক্রমের সময় তাদের রিকশা লক্ষ্য করে গুলি চালায় সামরিক জান্তার পেটোয়া বাহিনী। তাদের ছোঁড়া গুলি লাগে ডা. মিলনের বুকে। গুলিবিদ্ধ ডা. মিলন রিকশা থেকে লুটিয়ে পড়েন । ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হলে তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
ডা. মিলনের শহীদ হওয়ার সংবাদে তৎকালীন স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনে সংগ্রামরত ৫ দল, ৮ দল ও ৭ দল তথা তিন জোট, সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য, স্কপ, বিএমএসহ সব পেশাজীবী সংগঠন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠে। জেনারেল এরশাদের দীর্ঘ ৯ বছরের দুর্নীতি আর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ সেদিন রাজপথে ফেটে পড়ে। গণআন্দোলন মহান গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ফলে এরশাদ সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। ৯১-এর সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতন্ত্রের সূচনা হলেও গণমানুষের বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত সমতার চেতনায় অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা অর্জিত হয়নি। ইতিহাসের কালপর্বের দিকে আমরা তাকালে দেখি ১৯৭৫ সালে আাগস্ট ট্রাজেডির পরে আরেক রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াউর রহমান নিহত হন ১৯৮১ সালে ৩১ মে। তখন সেনাপ্রধান ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। জিয়া হত্যার পর কী ভূমিকা ছিল এরশাদের? এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি আজও। তারপর ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে খুব ঠান্ঠা মাথায় ক্ষমতার কাছাকাছি চলে আসেন জেনারেল এরশাদ। এক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয় ১৯৮১ সালের ৩০ মের কথা। তখন জেনারেল এরশাদ সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ৯ মাস পর তিনি সামরিক শাসন জারি করেন। আর ভেতরে ভেতরে চলে তার ক্ষমতা দখলের প্রস্তুতি। আর সেজন্য তিনি প্রেক্ষাপটও তৈরি করেছিলেন। এই সাবেক সামরিক শাসক এসময় কোন অভ্যুত্থানও করেননি। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সরকারকে হটিয়ে সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক শাসন জারি করেন।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। দিনটি ছিল বুধবার। ভোরে দেশে সামরিক শাসন জারি করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সেটি ছিল রক্তপাতহীন একটি অভ্যুত্থান। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে নেন জেনারেল এরশাদ। এক্ষত্রে আরো বলে রাখা ভালো যে, ১৯৮১ সালের নভেম্বরে ভোটের মাধ্যমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই নির্বাচনের এক মাস আগে ১৯৮১ সালের অক্টোবরে ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন জেনারেল এরশাদ। এর কিছুদিন পর তিনি বাংলাদেশের ‘হলি ডে’ পত্রিকায় আরেকটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। দুটি সাক্ষাৎকারেই জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর অংশীদারত্বের কথা বলেছিলেন। তা তিনি তখন বিচারপতি সাত্তারকেও জানিয়েছিলেন।
অন্যদিকে ২৪ মার্চের অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরিতে বিচারপতি সাত্তার সরকারের মন্ত্রীদের দুর্নীতি ও দেশের অর্থনৈতিক সংকট বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন জেনারেল এরশাদের পরামর্শে মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজন সদস্যকেও বাদ দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর ভেতরেও মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করা হয়েছিল। এরকম অজস্র অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ভেতর দিয়ে জেনারেল এরশাদ তার ক্ষমতা গ্রহণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন।
বর্তমান এলডিপির নেতা অলি আহমেদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে বলেছিলেন, এরশাদ ক্ষমতা দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ফলে তাকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে অপসারণ করা দরকার। কিন্তু রাষ্ট্রপতি তা আমলে নেননি বলে উল্লেখ করেন তিনি। অবশেষে ক্ষমতা দখল হয়। ১৯৮১ সালের ২৩ মার্চ দিবাগত রাতে সেনাসদস্যরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়েন। সংঘটিত হয় অভ্যুত্থান। ২৪ মার্চ ভোরে সামরিক শাসন জারি করেন জেনারেল এরশাদ। সেদিন বিকেলে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার টেলিভিশনে প্রচারিত এক ভাষণ দেন। তিনি বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে জাতীয় স্বার্থে সারা দেশে সামরিক আইন জারি করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারের সেই ভাষণের পরপরই ভাষণ দেন জেনারেল এরশাদ। সামরিক আইন জারি করার ১০ ঘণ্টা পর সেই ভাষণে জেনারেল এরশাদ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে শিগগিরই সাধারণ নির্বাচন করার কথা বলেছিলেন।
এরপর টানা ৯ বছর দেশ শাসন করেছেন জেনারেল এরশাদ। তার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব দলকে আন্দোলন করতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। তবে সামরিক শাসক স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এরশাদের ক্ষমতা দখলের প্রথম দিন থেকেই (২৪ মার্চ ১৯৮২) বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন।
বিশেষত ১৯৮২ সালের ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের নেতারা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে গিয়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। সাভার সেনানিবাস থেকে মিছিলের খবর শুনে সেনাবাহিনী চলে আসে। স্মৃতিসৌধে ছাত্রদের ওপর চলে নির্যাতন। একই বছরের ৮ নভেম্বর মধুর ক্যান্টিনে ১৪টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচির ঘোষণা দেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি সুশৃঙ্খলভাবে ছাত্র-ছাত্রীরা সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে যোগ দেন। মিছিলের প্রথম ভাগে শতাধিক ছাত্রী ছিল। সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে হাইকোর্টের কাছে মিছিলে পুলিশ বিনা উসকানিতে লাঠিচার্জ শুরু করে। সাধারণ ছাত্ররাও তখন পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করেন। এরপর ছাত্রদের ওপর চলে গুলিবর্ষণ। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল, জাফর, দীপালি সাহা। এভাবে এরশাদ তার ৯ বছরের শাসনকালে আন্দোলন-সংগ্রাম প্রতিহত করতে কতো মানুষকে যে হত্যা করেছে তার সঠিক হিসাব নেই। তার শাসনকালের পুরো সময়েই (১৯৮২-৯০) বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম-হরতাল-ঘেরাও কর্মসূচিতে গণতন্ত্রকামী ছাত্র-জনতার মৃত্যুর ঢল নেমেছিল।
যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নুর হোসেন, যার বুকে পিঠে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’, ডা. শামসুল আলম মিলন, কমরেড তাজুল, যুবনেতা টিটো, জেহাদ, সাহাদাত হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দেলোয়ার হোসেন ও ইব্রাহিম সেলিম, ঢাকা পলিটেকনিকের ছাত্র মনিরুজ্জামান, আওয়ামী লীগ নেতা ময়েজ উদ্দিনসহ অগোণিত মানুষের রক্তের স্রোতে ভিজে গিয়েছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে এরশাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বরের এই দিনে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে চিকিৎসক নেতা ডা. মিলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে সামরিক জান্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হন। ডা. মিলনের আত্মদানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দল, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দল ও বামপন্থীদের ৫ দলীয় জোট এবং ছাত্রদের তীব্র আন্দোলনের ফলে স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ৪ ডিসেম্বর রাতে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। পরেরদিন তিন দলীয় জোটের সকল রাজনৈতিক দলের অনুরোধে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণে সম্মত হন। ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যার মাধ্যমে সামরিক শাসক স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়। কিন্তু তারপরেও এরশাদ রাজনীতি করেছেন। জাতীয় পার্টি এখন বহুধা বিভক্ত হলেও এই দলের পক্ষ থেকে তিনি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিলেন। এত বড় ছাত্র আন্দোলন, এত ছাত্রের আত্মদান, এত অত্যাচার নীপিড়নের পর মানুষ কিভাবে সব ভুলে গেছে। শহীদ মিলন দিবসের এই দিনে আজ মনে হচ্ছে বারে বারে এত রক্ত, এত আত্মদান অথচ কদিনের মধ্যেই সবাই সব ভুলে বসে থাকলে এত আন্দোলন সংগ্রাম কি জন্য? যে গণতন্ত্রের জন্য এরশাদের স্বৈরশাসন থেকে আন্দোলন চললো তার শেষ কোথায়?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh