মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী ভারতের সহযোগিতা, সমর্থনের কথা নিশ্চয়ই আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। আমাদের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল প্রতিবেশী বাঙালি অধ্যুষিত পশ্চিম বাংলা, আসাম ও ত্রিপুরা তিন রাজ্যের মানুষ। ওই রাজ্য তিনটি অবাঙালি অধ্যুষিত হলে পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে না-ও থাকতে পারত। জাতীয়তার টান যে কত গভীর ওই সময়ে শরণার্থীমাত্রই সেটা বুঝতে পেরেছিল। নানা সীমাবদ্ধতার পরও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আশ্রয়সহ সব ধরনের সহযোগিতা করেছিল এই তিন রাজ্যের বাঙালি। এজন্য ভারতের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা নিশ্চয় রয়েছে। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব দ্বিপক্ষীয় হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তেমনটি হয়নি, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই বন্ধুত্ব একপক্ষীয়।
বৃহৎ ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গেই ছিল তাদের সর্বাধিক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। বৃহৎ রাষ্ট্রের কর্তৃত্বপরায়ণতায় প্রতিবেশী দেশের সরকারগুলো নিশ্চুপ থাকলেও জনগণের মধ্যে অসন্তোষ কিন্তু বিরাজমান। আমাদের দেশবাসীর ক্ষেত্রেও সেটা দেখা গেছে। কারণগুলোও অমূলক নয়।
ফারাক্কা বাঁধ পরীক্ষামূলক চালুর অনুমতি নিয়ে বিগত অর্ধশত বর্ষব্যাপী ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে আন্তর্জাতিক আইনকে তোয়াক্কা না করে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে আমাদের মরুদেশে পরিণত করেছে। তিস্তার পানি না দিয়েও একই পন্থা অবলম্বন করেছে। কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেও প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার অভিযান চলছে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রেও রয়েছে একচ্ছত্র ভারতের রপ্তানির আধিপত্য। ভারতকে প্রতিদানহীন একতরফা করিডোর সুবিধা প্রদানে দেশের জনগণের মধ্যে ব্যাপক জনরোষ সৃষ্টি হয়। প্রাপ্তিশূন্য করিডোর প্রদানে শেখ হাসিনা সরকারের নতজানু নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছিল, কিন্তু সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষে কোনো আন্দোলন দানা বাঁধতে পারেনি। অথচ আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পশ্চিম বাংলা সফরে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি তারা তা কোনো দিন ভুলতে পারবে না। তবে বাংলাদেশ বিনিময় চায় না। আমরা দিতেই ভালোবাসি, পেতে নয়।’ দ্বিপক্ষীয় স্বার্থরক্ষা করেই সব রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরূপ একতরফা নজির বোধ করি পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা প্রয়াত এইচ টি ইমাম ‘থিঙ্কট্যাঙ্ক’ অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের আলোচনা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছিলেন, ‘ভারতের মন ভোলানোর হাজার চেষ্টা চালালেও বিএনপি নেতারা সফল হবে না।’ তিস্তা চুক্তি না হওয়ার বিষয়ে বলেছিলেন, ‘অধরা তিস্তা চুক্তি নিয়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলবেই। কিন্তু তিস্তা এখন আর মোটেও কোনো সমস্যা নয়। আজ হোক কাল হোক তিস্তা চুক্তি সই হবেই। দুই প্রতিবেশীর কারো কাছেই এটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না।’ তিস্তাকে সমস্যা না বলা এবং আজ অবধি চুক্তি না হওয়া আমাদের প্রতি ভারতের অবিচার বললে নিশ্চয় অন্যায় হবে না। ভারতের সঙ্গে বহু অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান না করে আমাদের শাসকরা ভারতকে দিতেই ভালোবাসেন, পেতে নয়।
আমাদের ভূখণ্ডে বিভিন্ন রাজনৈতিক বাঁকে বিপদগ্রস্ত হয়েছে দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। যার সূচনা ঘটেছিল ১৯৪৭-এর দেশভাগে। এরপর ১৯৫০-এর দাঙ্গা, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ, একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যায় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে আক্রান্তের শিকার হয়েছিল বাঙালি জাতি। পাকিস্তান থেকে আগত সেনা সদস্যদের হিন্দু সম্প্রদায় পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তেমন বার্তাই দেওয়া হয়েছিল। যদিও গণহত্যাকালে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বাছ-বিচার করেনি হত্যাকারী সেনাবাহিনী। আত্মরক্ষায় প্রতিবেশী ভারতে এক কোটি শরণার্থীর বড় অংশই ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বী।
এবারের ২০২৪-এর ৫ জুলাই ক্ষমতা পরিবর্তনের পরও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর মানবতাবিরোধী হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। তবে সম্প্রতি সনাতনীদের সমাবেশ থেকে একটি স্লোগান তারা তুলেছে, যা অত্যন্ত আপত্তিকর। সেটা হচ্ছে ‘জয় শ্রীরাম’। এর আগে আমাদের দেশে এ ধরনের স্লোগান সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেয়নি। এই স্লোগান হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের। সারা ভারতে কেবল হিন্দু জাতীয়তাবাদী আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি এই ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানটি দিয়ে থাকে। এ ছাড়া ভারতের অন্য কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক এমনকি সাধারণ আম-জনতা এই স্লোগানটি দেয় না। স্লোগানটি অনিবার্যরূপে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক আরএসএস, বিজেপির স্লোগান। আমাদের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কেন এই স্লোগান দিচ্ছে? অনেকে এরই মধ্যে এই স্লোগানের জন্য সনাতনীদের আরএসএস-ভুক্ত বলেও প্রশ্ন তুলেছে। অনতিবিলম্বে তাদের হিন্দুত্ববাদী এই স্লোগান পরিহার করতে হবে। নয়তো জনমনে ধারণা জন্মাবে তারা হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা শুরু করেছে।
ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের উত্থান এবং অহিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক নৃশংসতার ফলে বাংলাদেশের মানুষ ক্রমেই ভারতবিরোধী হয়ে পড়েছে। আর এতে বিগত সরকারের নতজানু নীতিতেও মানুষ ক্ষুব্ধ। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ভারতের হারকে কেন্দ্র করে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ ক্রিকেটপ্রেমী মানুষ ভারতীয় দলের সমর্থক ছিল। কিন্তু বাংলাদেশকে তাদের স্বার্থের স্থলে পরিণত করার ফলে মানুষ ভারতের প্রতি ক্রমেই বিরূপ হয়ে ওঠে। কিছু তরুণ ভারতের পরাজয়ে উল্লাস করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করার জেরে কলকাতার বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসায় যাওয়া বাংলাদেশি মানুষকে চরম অপমান করা হয়েছিল। পারলে গলা ধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ন্যায় আচরণ পর্যন্ত করেছে বিজেপির সমর্থকরা। রাজ্য বিজেপির সম্পাদক এবং পশ্চিম বাংলার বিধানসভার বিরোধীদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী গণমাধ্যমের ক্যামেরায় হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র আমরা প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছি। ওটা এখন ইসলামী রাষ্ট্র হয়েছে। ওদের আমরা ছাড়ব না। দেখে নেব।’
আমাদের দেশের সর্বাধিক মানুষ ভারতে ভ্রমণে যায়। অবাঙালি বিএসএফ, ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের হয়রানিমূলক তল্লাশি, শত্রুতুল্য আচরণ সহ্য করে। কিন্তু সম্প্রতি ভারতে যাওয়া ভ্রমণকারীদের সংখ্যা নেই বললেই চলে। ভারত আমাদের ভিসা প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে। কোনো বন্ধু দেশের নাগরিকদের প্রতি এমন আচরণ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে না-ঘটলেও বাংলাদেশিদের সঙ্গে ঘটেছে। এতে অসুবিধার সম্মুখীন হবে কলকাতার মার্কুইস স্ট্রিট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটসহ নিউ মার্কেট সংলগ্ন বিশাল এলাকার আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ী, খাদ্যের দোকানি এবং নিউ মার্কেট অঞ্চলের পণ্য বিক্রেতারা। এমনকি মানি এক্সচেঞ্জের দোকানগুলোও। বাংলাদেশিদের ওপর ভিত্তি করেই তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের রমরমা অবস্থায় এখন ভাটির টানে তারা দিশাহারা।
বাংলাদেশের ওপর ভারতীয় কর্তৃত্ব কারো অজানা নয়। আমাদের শাসকদের ভারতীয় ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা মোটাদাগে লক্ষ করা গেছে। জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার ব্যাপারেও আমাদের শাসকশ্রেণির দলগুলোর ভারতমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। ভারতের স্বার্থে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে ক্ষমতায় থাকা-না থাকা নির্ভর করে বলে আমাদের শাসকরা মান্য করেছেন।
১৯৪৭-এ পাকিস্তান এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দুইবার রাষ্ট্রের বদল ঘটেছে। ভারত আমাদের বন্ধু এবং নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তবে দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। ভারতের শাসকগোষ্ঠী এ যাবৎ বন্ধুত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপনে সমর্থ হয়নি। ভারত তার দুর্বল প্রতিবেশীদের প্রতি সুবিবেচনা-সুবিচার করতে অসমর্থ বলেই প্রতিটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জনগণই ভারতবিদ্বেষী হয়ে পড়েছে।
ভারতের শাসকশ্রেণি, আমলাতন্ত্রের শিকার ভারতীয় জনগণ। ভারতীয় জনগণও নিজ দেশের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। শোষণ-বঞ্চনা অবসানে আমাদের মতো তারাও অব্যাহত সংগ্রাম জারি রেখেছি। ভারতীয় জনগণ এবং আমাদের জনগণের সার্বিক অবস্থা অভিন্ন। ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্র এবং আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে কোনো তফাত নেই। ভারতের শাসকশ্রেণি নিজ দেশের সমষ্টিগত জনগণের প্রতিপক্ষ এবং শত্রুও বটে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে ভারত আমাদের নিকট-বন্ধু হিসেবে সর্বদা পাশে থাকবে, সেটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু ভারত আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ না করে বিপরীতে প্রভুত্ব জাহির করে এসেছে। তাই ক্রমে ভারতবিরোধী মনোভাব দেশে গড়ে উঠছে। যেটি কাঙ্ক্ষিত ছিল না।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh